ছড়ায় ছন্দে অতনু বর্মন খুঁজে
বেড়ান জীবনের আনন্দ
অর্ঘ্য ঘোষ
ছড়া কিম্বা নাটক যাই হোক না
কেন , সবেতেই ছন্দ খোঁজেন অতনু বর্মন । কারণ ছন্দেই তিনি যেন খুঁজে পান জীবনের
আনন্দ । আদতে স্কুল শিক্ষক বছর পঞ্চান্নর অতনুবাবুর শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির
অঙ্গনে অবাধ বিচরণ । নাটক থেকে চলচিত্র , ছড়া থেকে গল্প প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিচিত
নাম হয়ে উঠেছেন তিনি ।
১৯৬৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম । আমোদপুরের বাসিন্দা অতনুবাবু ডাক নাম বাবুন ।
ছোট থেকেই মানুষ হয়েছেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে । কিন্তু ক্রিকেট-ফুটবল খেলা থেকে
শুরু করে চাঁদা তুলে সরস্বতীপুজো করা ,
সবেতেই তার সমান উৎসাহ ছিল । বাবা সুখরঞ্জন বর্মন ছিলেন ব্লক কর্মী । মা পারুল
বর্মন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমোদপুর জয়দূর্গা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন ।
পাশাপাশি জেলা প্রাথমিক স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও সামলেছেন । তিন
ভাইবোনের বড়ো অতনুবাবু আমোদপুরের মৃত্যুঞ্জয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পর
জয়দুর্গা হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন । তারপর হেতমপুর কলেজ থেকে বাংলায়
স্নাতক এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন ।
বর্তমানে সাইথিয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ।
তাঁর সংস্কৃতি চর্চার হাতেখড়ি স্কুলবেলা থেকে । মামার বাড়ির প্রভাবই তাঁকে সব থেকে বেশি
অনুপ্রাণিত করে । তাঁর এক মামা স্বরোজ কুমার রায়চৌধুরী ছিলেন উপন্যাসিক । আর এক মামা
প্রদ্যুৎকুমার রায়চৌধুরী নাটক লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । অভিনয়ের পাশাপাশি
নাটক মঞ্চস্থ করতেন । তার নিজস্ব একটি প্রকাশনা সংস্থা ছিল । সেখান থেকেই প্রকাশিত
হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘অঙ্কুর’ । তখন তিনি ছিলেন পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র । মায়েরও
লেখালিখির হাত ছিল । ঘরেবাইরে পত্রিকায় নিয়মিত ছোট গল্প লিখতেন । বালক অতনুর
পাঠানো প্রথম ছড়া গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয় সন্দেশ পত্রিকায় উপেন্দ্রকিশোর রায়
চৌধুরীর আঁকা সন্দেশ লোগোর পাশে । তারপরেও বার কয়েক একই
জায়গায় ছাপা হয় তার ছড়া । একই সঙ্গে সমান তালে নাটক , কবিতা , ছড়া , গল্প ,
প্রবন্ধ সব কিছুই লেখালিখি করেছেন । ছড়ায় বিভিন্ন মনীষীদের জীবনকাহিনী লিখে পাঠক
মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন । তাঁর ‘কহেন কবি কালিদাস’,‘ অরূপকথা’, ‘ নাসিরুদ্দিন
মোল্লা ’ ‘ তৃতীয় প্রকৃতি ’ ‘ শব্দ নৈশব্দ ’ ‘ ছায়া মানবী’ , ‘ গোবিন্দ গো গোবিন্দ
’ নাটক নাট্যমহলে সমাদৃত হয়েছে । তাঁর প্রকাশিত ‘ ছড়াশঙ্কর’ ‘ ‘খুড়ো হে ঘরকে চলো ’ , ‘ নাটুকে
ছড়া ’, ‘ খোলা হাওয়া ’ ‘ অঙ্কুর’, ‘ ছড়াতে নজরুল ’, ‘ বইবাহিত ’ , ‘ দুজনে
মুখোমুখি’ প্রভৃতি বইও পাঠকদের প্রশংসা অর্জন করেছে ।
লেখালিখির
পাশাপাশি ছাত্রাবস্থা থেকেই অভিনয়ের নেশা রয়েছে তাঁর । ছোটবেলায় মায়ের সাথে করেছেন ‘
কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ ’। দুই বোন পাপিয়া এবং পাপড়ি সহ পাড়ার ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে নিজের
লেখা ছোট ছোট নাটক পরিবেশন করেছেন । বালক কালের সেসব কথা আজও মনের মণিকোঠায় অক্ষয়
হয়ে আছে । একটা ঘটনার কথা উঠে আসে তাঁর স্মৃতিচারণে । তিনি তখন চতুর্থ শ্রেনীর
ছাত্র । নিজের লেখা মিনিট পনেরোর একটা নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি
নেওয়া হয়েছে পাড়ায় । রিক্সায় মাইক বেঁধে নিয়ে গোটা আমোদপুর সেই নাটকের প্রচার করে
এসেছেন স্বয়ং অতনুবাবু । তারপর অন্যন্যবারের মতোই প্রথম সন্ধ্যায় নাটক পরিবেশন করে
মঞ্চ ভেঙে যে যার বাড়ি চলে গিয়েছেন । ঠিক সেই সময়ই দর্শকরা হাজির হয়েছেন । কোথাই
তখন মঞ্চ , কোথাই বা নাটকের কুশীলবরা । তারা তো তখন ঘুমিয়ে কাদা । শেষ পর্যন্ত
পরিস্থিতির সামল দেন অতনুবাবুর মা । উপস্থিত দর্শকদের সামনে হাত জোর করে তিনি বলেন
, ও ছোটছেলে , ভুল করে ফেলেছে । ওটা ছেলে ভোলানো নাটক । অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে
। প্লিজ আপনারা কিছু মনে করবেন না । সেই কথা শুনে দর্শকরা হাসাহাসি করতে করতে বাড়ি
ফিরে যান । সেদিনের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে করতে আজও ভিজে যায় অতনুবাবুর চোখ ।
তিনি জানান , মা আমার সব কিছুতেই প্রেরণা
যুগিয়েছেন । আমি যে সব ছোট ছোট কবিতা লিখতাম তিনি সে সব অন্যকে পড়ে শোনাতেন ,
আমাকে শোনাতে বলতেন। যেমন খুশী তেমনি সাজোতে নিজে হাতে সাজিয়ে দিতেন। কিভাবে অভিনয়
করতে হবে দেখিয়ে দিতেন । আবৃত্তি করা শিখিয়ে দিতেন । সেদিন তিনি পথটা দেখিয়ে
দিয়েছিলেন বলেই আজও সেই পথটা অনুসরণ করে চলতে পারছি।
লেখালিখির মতোই
অভিনয়েও স্বীকৃতি মিলেছিল ছাত্রাবস্থায় । তিনি যখন ১৫/১৬ বছর বয়সের কিশোর তখন
হেতমপুর কলেজে একাংক নাটক প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের নাট্যদল স্টুডেন্টস কয়্যার
পরিবেশিত মনোজ মিত্র রচিত ‘ তেঁতুলগাছ ’এ
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা , শ্রেষ্ঠ নির্দেশক হিসাবে পুরস্কৃত হন । তারপর থেকে তাঁকে
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি । স্টুডেন্টস কয়্যারের পাশাপাশি নাট্যতীর্থ , বীরভূমের
আনন , কলকাতা অপেরা , কাঁচড়াপাড়া ব্রাত্যজন নামে বিভিন্ন নাট্যদলে বহু নাটকে অভিনয়
করেছেন অথবা করে চলেছেন। কলকাতার পেশাদার যাত্রাদলেও অভিনয় করেছেন ।
টিভি সিরিয়্যাল , রিয়েল্যাটি শো করার পাশাপাশি নামী পরিচালকদের ছবিতে অভিনয়ও
করেছেন । জনপ্রিয় একটি রিয়েলিটি শোতে চ্যাম্পিয়ানও হয়েছেন । ‘ জাকপট ’ , ‘ মউ বনে আজ ’ ‘ জানলা দিয়ে ’ ‘ বউ পালালো ’ , ‘
শেষ অঙ্ক ’ , ‘ মায়া মৃদঙ্গ ’ , ‘ ভাড়াটে ’ ‘তদন্ত’ , ‘ টুসকি ’ , ‘ আলেয়া ’ প্রভৃতি তার অভিনীত ছবি।
অভিনয়ের
পাশাপাশি আঞ্চলিক উপভাষার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছেন । একসময় স্ত্রী তনুশ্রী
বর্মণের সঙ্গে তার যুগ্ম গলার আঞ্চলিক ভাষার অ্যালবাম ‘ পাবলুর মা ঘুমিন গেলা ’
এবং ‘ শোন গো যতনে ’ মানুষের মুখে মুখে ফিরত।পরবর্তীকালে
বাংলাদেশ সরকারের বঙ্গীয় সংস্থার আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়েও বীরভূমের উপভাষার আবৃত্তি পরিবেশেন প্রশংসা অর্জন করেছেন ।তাঁর একটা দীর্ঘ ইংরাজী স্বাক্ষৎকার
আনন্দবাজার নেট সংস্করণ ‘আই লাভ কলকাতা ’
তে প্রকাশিত হয় । পরবর্তী কালে মাই
আনন্দবাজার ডট কমে ‘ খোলা হাওয়া ’ নামে ধারাবাহিক রম্যরচনা লিখেছেন ।
‘ নাটুকে ছড়া ’
নামে অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সুখ দুঃখ নিয়ে আননায়ুধ নামে একটি পত্রিকায়
ধারাবাহিক ভাবে ছড়া লিখে চলেছেন । এ পর্যন্ত সেই ছড়ার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। ওইসব
ছড়া নিয়ে প্রকাশিত ‘ নাটুকে ছড়া ’ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে । বর্তমানে শিল্পী
কাকলী দাসের সঙ্গে ওইসব নাটুকে ছড়া এবং থিয়েটারের গানের যুগলবন্দীর অন্য স্বাদের
অনুষ্ঠানও করে চলেছেন । কোন আক্ষেপ
, অনুতাপ বা অনুশোচনা তাঁর নেই। জীবনের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ । তিনি মনে করেন , জীবনে যা পেয়েছেন , যেটুকু পেয়েছেন , যা পেয়ে
চলেছেন তা তাঁর জীবন ভরিয়ে দিয়েছে । বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তার জীবনপাত্র পূর্ন হয়ে
গিয়েছে । খারাপ অভিজ্ঞতাও তার প্রাপ্তি বলেই মনে করেন । তাই তিনি বলেন , চলার পথে
জীবন মাঝে মধ্যে ছন্দ হারায় । কিন্তু আমি সবেতেই আনন্দ খুঁজে পাই ।
Sir এ সম্পর্কে এত কিছু জানতাম না ।অনেক কিছু জানতে পারলাম । sir আবৃত্তি ক খন ও ভোলার নয় ।sir কে প্রণাম জানায় ।
ReplyDelete