( কিস্তি --- ৬)
টের পায় বৃষ্টির আভাস। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অদুরে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে ছন্দা।অভিমানে তার ঠোট তির তির করে কাঁপছে। চোখের কোনে বৃষ্টির আভাস। কিছুক্ষণের মধ্যেই বর্ষণ অনিবার্য। ছন্দাকে দেখেই পা থেমে যায় মনোতোষের। সেটা ফুলমনিদের চোখ এড়ায় না। -- তুও আয় ক্যানে তা , বলে তারা এগিয়ে গিয়ে ছন্দার হাত ধরে নিয়ে এসে তাদের নাচে সামিল করে। নাচতে নাচতেই এক সময় ছন্দা মনোতোষের পাশাপাশি চলে আসে। ছন্দার কোমরে হাত রেখে নাচতে নাচতে এক অন্য রকম অনুভূতির জন্ম হয় মনোতোষের মনে।
মেঘ কেটে ছন্দার চোখে মুখেও ঝিলিক দেয় অন্যরকম আলো।নাচ শেষে ফুলমনিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের পিকনিকের জায়গায় ফেরে তারা।
তারপর টিফিন খেয়ে পাহাড়ে বেড়াতে বের হয় দুজনে। যেতে যেতে মনোতোষ ছন্দাকে বলে -- তখন মুখখানা ওই রকম করে রেখেছিলি কেন রে ?
--- আমার মুখখানাই ওইরকম তাই। বলে কপট রাগে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ছন্দা।
তাই দেখে তাকে আরও একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য মনো বলে , ঠিকই বলেছিস। স্কুলের পণ্ডিতমশাইও তোদের মতো মেয়েদের দেখে এই রকম একটি কথা বলেন।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মনোদার মুখের দিকে তাকায় ছন্দা।
মনো তখন পণ্ডিতমশাইয়ের গলা নকল করে বলে --- কাঁদছ কেন , কাঁদছ কেন মা জননী।কাঁদব কেন , আমার মুখ খানাই অমনি।
বলেই শব্দ করে হেসে ওঠে মনোতোষ। হাসি চাপতে পারে না ছন্দাও। সে চোখ পাকিয়ে বলে -- মনোদা তুমি না স্কুলের ভালো ছেলে। সৌমেনদাদের মতো স্যরদের গলা নকল করে কথা বলছ।কারও কানে গেলে কাকুর মান সম্মান থাকবে ? কি বলবে সবাই ?
--- কি বলবে ?
--- বলবে নিজে মাস্টার হয়ে ছেলেটাকে মানুষ করতে পারে নি।
--- দিন কে দিন তুই দেখছি পাকাবুড়ি হয়ে উঠছিস।
--- হ্যা , আসল কথা বললেই তুমি তো আমাকে পাকাবুড়ি বলবেই। কিন্তু আমার তো তাতে কানে দিলে চলবে না। কাকুর সম্মান আমি নষ্ট হতে দেব না। আজ সবার সামনে কাকীমাকে বলছি দাঁড়াও।
--- যা বল গে , তাহলে আমিও সেদিন তোর সেই সাঁকো নড়ানোর কথাটা কাকীমাকে বলব।
---- আমি তাহলে তোমার চ---কথাটা গিলে নেয় ছন্দা। সেদিন চড় মারার কথাটা সে বলতে পারে না। অভিমানে গলা বুজে আসে তার।
নিজেকে সামলে তাই সে বলে --- আমার বিরুদ্ধে তুমি কাউকে কিছু বলতেই পারবে না।
--- না পারার কি আছে ?
--- কি আছে জানি না। তবে আমি বকা খেলে তোমার খারাপ লাগে সে আমি জানি।
--- আর আমি বকা খেলে তোর বুঝি খুব ভালো লাগে ?
---- কেমন লাগে তুমি বোঝ না ?
মুখে কিছু না বললেও মনোতোষ জানে তাকে কেউ কিছু করলে ছন্দা সইতে পারে না। এমনিতে সে বাবা - মায়ের কাছে বিশেষ একটা বকা খায় না। কিন্তু কেউ তার নিন্দে -মন্দ করলে তাকে আচ্ছা করে দু'কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না ছন্দা।কথাটা মনে পড়তেই ছন্দার হাতটা নিজের হাতে তুলে নেয় মনোতোষ। তারপর হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছে যায় পাহাড় চূড়ার মন্দিরে।
বাবার মুখে মনোতোষ শুনেছে এই পাহাড়েই রয়েছে একটি মাজারও। বাবা বলেন , প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই পাহাড়। শুধুই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই নয় , ধরণী পাহাড় সংলগ্ন এলাকা অকৃপণ হাতে আমাদের জীবিকা অর্জনেও সাহার্য করে চলেছে। মাঠে চাষ শুরু হলে গোচরণ ভূমির সমস্যা দেখা দেয়। তখন পাহাড়ি উপত্যকা আমাদের গোচারণ ভূমির সেই সমস্যা দূর করে। বীরভূম থেকে গোপালকেরা তাদের পোষা গরু-মোষ নিয়ে পাহাড়ি এলাকায় ভীড় জমায়। অস্থায়ী চালাঘর করে গবাদি পশু নিয়ে সেখানেই থেকে যায় কয়েকটা মাস। তারপর মাঠ খালি হলে গ্রামে ফেরে। পাহাড় এলাকায় খাদ্যাভাব হলে পাহাড়ি এলাকার মানুষজনও তাদের গবাদি পশু নিয়ে সমতলে আসে।
মন্দিরে আসতে আসতেই ওই রকম অস্থায়ী চালাঘর নজরে আসে তার। বাবার কথাগুলো যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। পরের বার মাজারটাও দেখে আসবে। পাহাড়ি শোভা দেখতে দেখতে শিবমন্দিরে চত্বরে পা রাখে তারা। শিবকে প্রনাম করে উঠে দাঁড়াতেই একজন পুরোহিত এগিয়ে এসে তাদের হাতে প্রসাদ দেন। কপালে একে দেন সিঁদুরের ফোটাও। তারা পুরোহিতকে প্রণাম করার উপক্রম করতেই সভয়ে তিনি কয়েক পা পিছিয়ে যান। তারা আশ্চর্য হয়ে তার মুখের দিকে চাইতেই তিনি বলেন -- দেবস্থলে প্রণাম করতে কিম্বা নিতে নেই। দেবস্থলে দেবতাই একমাত্র প্রণম্য। এখানে তুমি আমি সবাই এক। সবাই তার সন্তান।
পুরোহিতের কথা শুনে তাদের খুব ভালো লেগে যায়। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।পুরোহিত মশাই বলেন, তোমরা নিশ্চয় পাহাড়ে পিকনিক করতে এসেছো তাই না ?
তারা দুজনেই হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়ে। তারপর তাদের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন দেখেন তিনি। এক সময় বলেন , আমি তোমাদের দাদুর মতো। একটা কথা জিজ্ঞেস করব , কিছু মনে করবে না তো ?
---- না , না করুন। মনে করব কেন ?
-------তোমরা কি সহোদর ভাই বোন ? তোমরা দেখতে অনেকটা একই রকম।
-------না দাদু আমরা সহোদর নই।
---------তোমাদের কি সম্পর্ক জানি না ।কিন্তু দুটোতে মিলন হলে খুব মানাবে।জানি না ঠাকুরের কি ইচ্ছা।পুরোহিতের কথা শুনে লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠে ছন্দা। সে মাথা নামিয়ে নেয়। লজ্জায় কথা বলতে পারে না মনোতোষও।
তাই দেখে পুরোহিত বলেন -- আমার কথায় তোমরা রাগ করলে না তো ভাই ? তোমাদের সম্পর্ক ব্যাপারে কিছু না জেনেই কথাগুলো বলে ফেললাম। আসলে বুড়ো হয়েছি তো। আজ আছি কাল নেই। তাই বোধ হয় কাউকে ভালো লাগলে কথায় পেয়ে বসে। যা মনে আসে তাই বলিফেলি।
মনোতোষ বলে, না - না রাগ করি নি। আমাদের বাড়ি একই গ্রামে। ও আমার বাবার কাছে টিউশানি পড়ে। বাবা-মা ওকে মেয়ের মতোই দেখে। আমার থেকেও বেশি ভরসা করেন।
--- তাহলে তো ভাই আমি ভুল কিছু বলি নি। ঠাকুরই হয়তো আমার মুখ দিয়ে তার অভিলাষের কথাটাই প্রকাশ করেছেন।
প্রত্যুত্তরে তারা দুজনেই কথা বলতে পারে না। পুরোহিতই বলেন , তোমরা পিকনিকে এসেছো ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। ওদিকে আবার খোঁজাখুঁজি পড়ে যাবে।পারলে পরের বার বাবা- মা'কেও নিয়ে এসো। ঠাকুরের অভিলাষের কথাটা তাদেরও বলব। জানি না ততদিন থাকব কি না ?
ছন্দা বলে, থাকব না বললেই হোল। আমাদের দু'জনেরই দাদু নেই। আজ থেকে তুমিই হলে আমাদের দাদু।
মনোতোষ বলে, নিশ্চয় আসব দাদু। তোমার কথা কোনদিন ভুলতে পারব না।
---- তাই আসিস ভাই। তোদের দুটিকে দেখে যেন চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। তোদের পথ চেয়ে থাকব।
পুরোহিতদাদুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তারা পাহাড় থেকে নামতে শুরু করে। পুরোহিতদাদুর কথাগুলো তাদের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। লজ্জায় কেউ কারও দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না। কিন্তু দুজনেই মাঝে মধ্যে আড় চোখে মুখের ভাব দেখে মনের কথা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। ওইভাবে দেখতে গিয়েই একসময় একে অন্যের কাছে ধরা পড়ে যায়। দুজনের মুখেই তখন চাপা হাসি ফুটে ওঠে।
আবার ছন্দার হাত নিজের হাতে তুলে নেয় মনোতোষ। একে অন্যের দিকে আবেশ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অপলক। একসময় মনোতোষ ছন্দার চিবুকটা তুলে ধরে বলে ওঠে , না রে তোকে অন্যসময় ও দেখতে ভালো লাগে। ঠিক যেন ঘোষেদের দূর্গা প্রতিমার মতো। কথাটা কানে যেতেই ছন্দার সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। মনোদার প্রতি তার অনুরাগ ছিলই। এদিন যেন সেই অনুরাগের
ছোঁওয়ায় উকি দেয় প্রেমের মুকুল। হাত ধরে দুজনে নিঃশব্দে হেটে চলে। কিন্তু তাদের নিস্তব্ধতায় অনেক কথার জন্ম হয়। সেই কথা কেবল ওরাই শুনতে পায়। দুজনে পিকনিকের জায়গায় পৌঁছোতেই মা, কাকীমারা বলে উঠেন -- কোথাই গিয়েছিল তোরা এতক্ষণ ? তোদের কপালে ফোটাই বা কে দিল ?
তারা মন্দিরের যাওয়ার কথা বলতেই বাবা বলেন , ভালো করেছিস। আমরা দুর-দুরান্তে মন্দির মসজিদ দেখতে ছুটি। অথচ বাড়ির আশেপাশেই যে কত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তা আমাদের চোখেও পড়ে না। সাধে কি আর কবি বলেছেন -- " দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু , শুধু দেখা হয় নি চক্ষু মেলিয়া ধানের শিসের উপর একটি শিশিরবিন্দু।"
ভূবনবাবুর কথা শেষ হয় না। স্ত্রী বলেন -- সে নাহয় এবার থেকে চোখ মিলে আমরা শিশির বিন্দুই দেখব। এখন তুমি চোখ মেলে ছেলে মেয়েগুলোর মুখগুলো একটু দেখ। শুধু ছেলেমেয়েগুলোই নয়, খিদেতে তো সবারই পেটে ছুঁচোয় ডন টানছে।
স্ত্রীর কথায় লজ্জা পেয়ে ভূবনবাবু হাকডাক শুরু করে দেন -- এই রাম, ও সুকুমার সব পাতা দাও। তারপর গাড়ির চালকেও ডেকে নেন -- ক্ষীরময় তুমিও বসে পড়ো।
ক্ষীরুকাকা কিছুতেই তাদের সংগে বসবে না। বাবাও ছাড়বে না। শেষে জোড় করে তার পাশেই ক্ষীরুকাকাকে বসিয়ে দেয় বাবা। এজন্য বাবাকে নিয়ে তার গর্ব হয়।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment