সাহিত্যচর্চায় ব্যতিক্রমী রীনা
অর্ঘ্য ঘোষ
মেয়েদের মধ্যে অনেকে গোপনে সাহিত্যচর্চা করেন । কিন্তু প্রকাশের মাধ্যম অভাবে অল্পদিনেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। ওইসব নিভৃতবাসিনীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়ে সাড়া ফেলেছেন রীনা কবিরাজ। ২০০৭ সালে থেকে মেয়েদের নিজস্ব একটি পত্রিকা প্রকাশ করে সাহিত্য জগতে পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন তিনি।
১৯৫২ সালের ২ ডিসেম্বর রীনা কবিরাজের জন্ম। বর্তমানে দুবরাজপুরের বাসিন্দা হলেও তাঁর আসল বাড়ি ব্যারাকপুরে।
বাবা প্রয়াত হরিপদবাবু ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। মা যুথিকাদেবী গৃহবধু। ছয় ভাইবোনের বড়ো রীনাদেবীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাবার কর্মস্থল দুবরাজপুরের কোটা গ্রামে। তারপর দুর্গাপুর প্রোজেক্ট গালর্স হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং পলতা প্রিয়নাথ দাস কলেজ থেকে বাংলায় বি,এ পাশের পর বীরভূমেরই বিশালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন।তারপর স্থানীয় বড়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকমাস শিক্ষকতার পর নলহাটি হাইস্কুল ফর গার্লস -এ যোগ দেন। সেখান থেকে বাংলার শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দেন দুবরাজপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। ওই স্কুল থেকেই অবসর নিয়েছেন।
লেখাপড়া এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি ৬৫ বছর বয়েসেও সমানতালে সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন তিনি। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে জন্ম তাঁর। তিনকাকা প্রয়াত ক্ষীরোদ , গৌরপদ এবং শক্তিপদবাবু লেখালিখি করতেন। বড়ো কাকা ক্ষীরোদ কবিরাজ আবার ছিলেন ‘পথ সংকেত ’ পত্রিকার সম্পাদক। বাবা নিজে লেখালিখি না করলেও সাহিত্যের বোদ্ধা মানুষ ছিলেন। বর্তমানের বেশকিছু লেখককে তিনি লেখা সংক্রান্ত পথ নির্দেশ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে বিশিষ্ট সাহিত্যকর্মী ফজলুল হককে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেন। আজও দু'জনে সমানতালে সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন।
স্কুলবেলাতেই রীনাদেবীর লেখালিখির সূত্রপাত। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে বকা খেয়েছিলেন। সেই ঘটনাকে উপজীব্য করে স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা লেখার মধ্যে দিয়ে তার সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি হয়। ইতিমধ্যে শতাধিক প্রবন্ধ এবং বেশ কিছু কবিতা সহ ছোটগল্প লিখেছেন।
বিভিন্ন সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকা , যুগান্তর , পথসংকেত , দিদিভাই , চন্ডীদাস , প্রতিদ্বন্দ্বী , বীরভূমি , জাগৃতি প্রভৃতি পত্রিকায় সেইসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে তদানীন্তন লেখক বন্ধু ফজলুল হকের সহায়তায় দুবরাজপুর থেকে ‘তমসুক ’ নামে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেখানে অনেক সাহিত্যকর্মী আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করেন। বছর তিনেক চলার পর নানান প্রতিকূলতায় সেই পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মনের মধ্যে পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছাটা সুপ্ত থেকে যায়।
সেই ইচ্ছারই ফসল হিসাবে ২০০৭ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ষান্মাসিক পত্রিকা ‘ আলোরবেণু '। সেই পত্রিকার লেখক থেকে প্রকাশক গোষ্ঠী সকলেই মহিলা। লেখা , বিজ্ঞাপন সংগ্রহ এবং বিক্রি সবই নিজের হাতে করেন মহিলারা।
প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনেরাও সেই পত্রিকায় আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করেছেন। শ্যামলী খাস্তগীর , মীরাতুন্নাহার , যুথিকা বসু , মণীষা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রতিষ্ঠিত লেখিকাদের পাশাপাশি ওই পত্রিকায় প্রথম আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন নানুরের গৃহবধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় , কথাকলি ঘোষরা। তারা জানিয়েছেন , ‘ আলোরবেণুই আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছে।’
পত্রিকাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উর্মিলা চক্রবর্তী , মুক্তি রায়চৌধুরী , পুষ্প কর , পার্বতী ভট্টাচার্যদের মতো সাহিত্যকর্মীদের সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। সাহিত্যে ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালনের জন্য ‘ কুনুর কথা ’ পত্রিকা গোষ্ঠীর পক্ষে থেকে ‘ আলোরবেণু ’ পত্রিকাগোষ্ঠীকেও সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। পত্রিকাগোষ্ঠীর উপদেষ্টা শর্মিলা চক্রবর্তী , সহ সম্পাদিকা মধুমিতা সরকার , প্রচারসচিব কোয়েলী ঘোষরা জানিয়েছেন , তাঁর জন্যই মেয়েরা তাঁদের আত্মপ্রকাশের নিজস্ব একটা জগত খুঁজে পেয়েছেন।
রীনাদেবী মূলত কবি। তার কবিতায় উঠে আসে নারীদের বঞ্চনা-লাঞ্ছনার কথা। সেই অমোঘ উচ্চারণ শোনা যায় তার কথাতেও ‘ জন্মজন্মান্তরের কৃতকর্মের ফলে / নাকি পরিণত আবেগের ভুলে / কেন যে এতো অপবাদ-অপমান / জলাঞ্জলি দিতে হয় আত্মসম্মান।
No comments:
Post a Comment