পৌষ আগলানোর কথা
অর্ঘ্য ঘোষ
"এসো পৌষ , বসো পৌষ , না যেও ছাড়িয়ে / ছেলেপুলে ভাত খাবে সোনার থালা ভরিয়ে। কিম্বা ''পরের পৌষ একমাস / আমার পৌষ বারো মাস"। শেষ পৌষের রাত কিম্বা ভোরে কান পাতলে আজও শোনা যায় মহিলাদের সমবেত গলায় ওই জাতীয় ছড়া।আসলে পৌষ আগলানোর জন্যই আজও মহিলারা অনেকটা পাঁচালি পড়ার ঢঙে সুর করে ওই জাতীয় ছড়া আওড়ান।প্রায় সমস্ত ধরণের শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁওয়া লাগলেও পৌষ আগলানোর ওইসব ছড়া আজও অবিকৃত রয়েছে । দরিদ্রের পর্ণকুটির থেকে ধনীর প্রাসাদেও একই সুরে সমোচ্চারিত হয় ওইসব ছড়া। শাশুড়ি কিম্বা মায়ের মাধ্যমে মেয়ে কিম্বা বৌমা'দের মধ্যে পরম্পরা বাহিত হয়ে চলে আসছে ওইসব ছড়া ।আধুনিকতার ছোঁয়াচ এড়িয়ে আজও অধিকাংশ পরিবারে টিকে রয়েছে পৌঁষ
আগলানোর উৎসব । ওই উৎসব পালনের জন্য এদিন সকাল থেকেই কার্যত সাজো সাজো রব পড়ে যায় । উৎসব পালনের জন্য প্রয়োজনীয়
উপকরণ সংগ্রহ করতে গিয়ে পরিবারের মহিলারা হিমসিম খেয়ে যান ।
কিন্তু পরিবারের
সমৃদ্ধি কামনায় বছরের পর বছর তারা হাসিমুখে ওই ধকল সহ্য করেন।
গ্রামাঞ্চলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে , " পৌষমাসে ইঁদুরেরও সাতটা মাগ( স্ত্রী)"। ওই আপ্তবাক্যই পৌষমাসের আর্থিক সমৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করে । ওইসময় একটি ইঁদুরেরও সাতটি স্ত্রীর ভরণপোষণ করার সামর্থ্য থাকে। ওই সময় মাঠে থেকে ধান ওঠে।ইঁদুর সেই ধান গর্তে সঞ্চয় করে রাখে। তা দিয়েই সে তার স্ত্রীদের প্রতিপালন করে বলেই প্রচলিত ধারণা। আসলে ‘ পৌষ মাস
লক্ষী মাস ’। এইসময়ই চাষিদের বাড়িতে ধান ওঠে । সমৃদ্ধির মুখ দেখে পরিবার । শুধু
জমি মালিকেরাই নন , ধান তোলা-ঝাড়াই বাছাই সহ অন্যান্য কর্মসংস্থানের সুবাদে
জমিহীনরাও কিছুটা স্বাচ্ছল্যের মুখ দেখেন । বিশেষত এইসময়ই ধান-চালের দাম তুলনামূলক
হারে কিছুটা কম থাকায় হতদরিদ্র পরিবারের মানুষজনও তাদের সন্তানদের পাতে ভরপেট ভাত
দিতে পারেন । সেই প্রাচীনকাল থেকেই পৌঁষমাস সবার আদরের মাস । সবাই চান
বারোমাসই যেন পরিবারে পৌষের সমৃদ্ধি থাকে । তাই ওই রীতির মাধ্যমে কার্যত লক্ষীমাসের
বন্দনা করেন পরিবারের মহিলা।এখন উন্নত কৃষি প্রযুক্তি , সেচের সংস্থান সহ
বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার জন্য বছরে একাধিক বার ধান ওঠে চাষি পরিবারে । সেই সুবাদে
কর্মসংস্থানও বেড়েছে । তবুও আদর কমে নি পৌষের । আজও পৌষকে আগলে রাখার জন্য মহিলারা
হাড় কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে পৌঁষ আগলান ।
পরিবারের আধুনিকতা ছোঁয়া মলিন করতে পারে
নি ওই উৎসব ।
কেমন সেই উৎসব ? কেমনই বা তার
প্রস্তুতি ? সকাল থেকেই গোবর দিয়ে তকতকে করে নিকানো হয় উঠোন । বাড়ির বাইরেও ছেটানো
হয় গোবর জল । তারপর হরিমন্দির সহ বাড়ির প্রায় সর্বত্র আলপনা আঁকেন মহিলারা । দিনভর
বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করে যোগাড় করা হয় বকনা গরুর গোবর , ধান-দূর্বা , সিঁদুর ,
ছোট ছোট খড়ের আঁটি , সরষে – গাঁদাফুল সহ আরও নানা উপকরণ।রাতে সবার খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু
হয় পৌঁষ আগলানো। পাট ভাঙা কাপড় পড়ে মহিলারা প্রথমে বাড়ির সদর দরজার
মুখে বসে গোবর দিয়ে গোলাকার পৌষবুড়ি তৈরি করেন । পৌষবুড়ির উপরে ধান-দুর্বা সহ
অন্যান্য উপকরণ দিয়ে শুরু হয় পৌষ আগালনো । সুর করে মহিলারা একসঙ্গে ছড়ার মতো বলেন –
‘ এসো পৌষ , বসো পৌঁষ না যেও ছাড়িয়ে / ছেলেমেয়ে ভাত খাবে সোনার থালা ভরিয়ে । কোথাও
বলা হয় ‘ পৌঁষমাস লক্ষী মাস যাইও না ছাড়িয়ে / ছেলেপিলেকে ভাত দেব থালা ভরিয়ে ।
এরপর একই ভাবে গোয়ালঘর , রান্নাঘর এবং ঠাকুরঘরেও পৌঁষ আগলানোর রীতি প্রচলিত আছে ।
তারপর সদর দরজা থেকে ঠাকুরঘর পর্যন্ত উলুধ্বনি সহ জলের ধারা পৌঁছে দেওয়ার পরই শেষ
হয় পৌষ আগলানোর পর্ব । কোথাও কোথাও অবশ্য এদিন ভোরে পুকুরে তিন ডুব দিয়ে পৌষ আগলানোর
রীতিও প্রচলিত আছে । কিন্তু পৌষ আগলানোর অন্তর্নিহিত মূল সুরটি কিন্তু সর্বত্র একই।পৌষ আগলানোর পাশাপাশি এদিন অধিকাংশ পরিবারে
পিঠে-পুলি তৈরি নিয়েও মহিলাদের ব্যস্ততা তুঙ্গে ওঠে। পৌষ মাস পিঠেপুলিরও মাস । তাই শেষ পৌষের দিনে বিকাল
থেকেই অধিকাংশ পরিবারে নানা ধরণের পিঠেপুলি তৈরি চল রয়েছে।
No comments:
Post a Comment