লুপ্তপ্রায় খেলা -- ১১
( ছবি -- সোমনাথ মুস্তাফি )
কুমির - ডাঙা
একসময় কচিকাঁচাদের অন্যতম প্রিয় খেলা ছিল কুমির-ডাঙা। অনেক জায়গায় খেলাটি ' জল ডিঙাডিঙ' নামেও পরিচিত।প্রাইমারি তো বটেই হাইস্কুল স্তরের ছেলেমেয়েরাও সময় পেলেই মেতে উঠত ওই খেলায়।বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই খেলাটির নাম জানে না বললেই চলে।তাই চর্চার অভাবে এই খেলাটিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
খেলার নামের সঙ্গে জল বা কুমিরের উল্লেখ থাকলেও খেলাটি অবশ্য স্থলেই হয় । তবে কাল্পনিক জলের আশ্রয় নিতে হয় খেলায়। মন্দির বেষ্টিত চত্বর , ঠাকুর দালান কিম্বা চারদিকে উঁচু ডাঙা বিশিষ্ট স্থান ওই খেলার উপযুক্ত স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়।
অর্থাৎ যেখানে খেলা চলে সেই চত্বর ঘিরে চারদিকে উঁচু জায়গা থাকাটা আবশ্যক। খেলার পরিভাষায় নিচু জায়গাটা জলাশয় এবং উচু জায়গাগুলোকে ডাঙা বলা হয়। ডাঙা হিসাবে চিহ্নিত জায়গাগুলি খেলায় নিরাপদ স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়।
১০ /১২ জন ছেলেমেয়ে একত্রে বা আলাদা আলাদা ভাবে ওই খেলা চলে। প্রথমে ' উবু-দশ-- ' বা অন্য কোন গণনা পদ্ধতির মাধ্যমে একজন খেলোয়াড়ের ' মোর ' নির্ধারণ করা হয়। খেলায় 'মোরধারী ' কুমির হিসাবে পরিগনিত হয়। বাকি খেলোয়াড়রা মানুষ হিসাবে চিহ্নিত হয়। খেলার নিয়মানুযায়ী , 'মোরধারী ' অর্থাৎ কুমিরকে জলাশয় হিসাবে চিহ্নিত নীচু জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।বাকি খেলোয়াড়রা অর্থাৎ মানুষেরা দাঁড়িয়ে থাকবে ডাঙায়।
সুযোগ বুঝে মানুষেরা কুমিরের ছোঁওয়া এড়িয়ে ঝুপ করে কাল্পনিক জলে নেমে ' কুমির তোর জলে নেমেছি , জলে নেমে জলঘোলা করেছি / পারলে ধর আমার পা , নইলে ঘোলাজল খা।' জাতীয় ছড়া কেটে ছোঁওয়া জন্য মোরধারীকে প্ররোচিত করে।
আর যেই তাকে ছোঁওয়ার জন্য ' মোরধারী ' তার দিকে ছুটে যায় তখন সেই খেলোয়াড় লাফিয়ে নিরাপদ স্থান অর্থাৎ ডাঙায় উঠে পড়ে। সেই সময় একই কায়দায় অন্য কোন খেলোয়াড় একা কিম্বা একসংগে একাধিক জন ছড়া আউড়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে । তখন তাকে ছুঁতে ছুটে যায় ' মোরধারী।' 'মোর' দশা ঘোচানোর তাড়নায় ওইভাবে ছোটাছুটি করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়ে ' মোরধারী।' অনেক সময় হোঁচট খেয়ে পড়েও যায় সে। তখন অন্যান্য খেলোয়াড়রা ডাঙায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দিতে ' বাতাসে নড়ে ধর্মের কল / যেমন কর্ম তেমনি ফল ' বা ' কুমির তোমার কেমন শিক্ষা হলো / লোভ-লালসা ভুলে এবার হরিগুরু বলো। ' জাতীয় ছড়া আউরে তাকে আরও উত্যক্ত করে তোলে।
কিন্তু সমস্ত প্ররোচনা উপেক্ষা করে ' মোরধারী ' যদি তার এলাকায় অর্থাৎ কাল্পনিক জলাশয় কোন খেলোয়াড়কে ছুঁয়ে দিতে পারে তাহলে তার ' মোর ' দশা ঘোচে। তখন সে ডাঙায় ওঠার সুযোগ পায়।আর ছোঁওয়া পড়া খেলেয়াড়কে ' মোর ' খাটতে হয়।
তবে কোথাও কোথাও আরও নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। তারই মধ্যে অন্যতম নিয়মটি হলো, কুমির তার এলাকার মধ্যে ক্রমান্বয়ে যাদের ছোবে তারাও ' মরা ' হওয়ার পরিবর্তে কুমিরে পরিনত হবে। তখন তারাও 'মাদার ' অর্থাৎ মুল কুমিরের সংগে জলে নেমে বাকিদের ছোওয়ার চেষ্টা করবে। সব থেকে শেষে যে খেলোয়াড় থাকবে সে'ই তখন সেরা মানুষ হিসাবে পরিগনিত হয়। কোথাও কোথাও শেষের জনকে পরবর্তী পর্বে কুমীর হওয়ারও নিয়ম রয়েছে। সেক্ষেত্রে তখন বাকিরা ডাঙায় ওঠার সুযোগ লাভ করে।
No comments:
Post a Comment