( কিস্তি --- ৫ )
সেই গল্প শুনতে শুনতে ঘুম নেমে আসে তার চোখে। সেদিন তার ঘুম ভাঙে মনোদার ডাকাডাকিতে। চোখ খুলে দেখে বিছানায় সে একা শুয়ে আছে। ঠাকুমা কখন উঠে গিয়েছে সে টের পায় নি। তাকে ঠেলা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করছে মনোদা। সে খুব অবাক হয়ে যায়। এত সকালে তো মনোদা সাধারণত আসে না। কাল রাতেই তো সে ওবাড়ি থেকে এলো। তার মধ্যেই আবার কি হলো ভেবে পায় না ছন্দা। সে পরিপূর্ণ ভাবে চাইতেই তার চোখে আটকে যায় মনোদার চোখে।
দুজনেরই কি যেন হয়ে যায় ? কি হয় তা অবশ্য আন্দাজ করতে পারে না ছন্দা। মনোতোষ কেবল টের পায় তার বুকে যেন একটা ধুকপুকুনি শুরু হয়েছে। ছন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখে ফুটে ওঠে মুগ্ধতা। সে অস্ফুটে বলে --বাহঃ সকাল বেলায় তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু ছন্দা।
মনোদার কথা শুনে খুব ভালো লাগে ছন্দার। কার না লাগে ভালো ? নিজের সৌন্দর্য্যের প্রশংসায় ভালো লাগাটা বোধহয় মেয়েদের সহজাত। মনোদাকে সেটা অবশ্য বুঝতে দিতে চায় না ছন্দা। তাই বলে , অঃ আর অন্য সময় বুঝি খারাপ দেখায় ?
---- তা তো বলতে পারব না রে। অন্যসময় তো তোকে এইভাবে দেখি নি।
---- এবার দেখে বলবে।
---- বেশ তাই বলব। এবার উঠে আয় দেখি।বলেই ছন্দার হাত ধরে টেনে তোলে মনো।
--- সাত সকালে এত তাড়া কেন বলবে তো ?
---- আরে পিকনিকে যেতে হবে। নে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
---- সে তো সেই পয়লা জানুয়ারি। অনেক দেরি আছে এখন ।
---- হ্যা তা দেরি আছে। কিন্তু আজ সকালেই বাবার বন্ধু মহুরাপুরের রামকাকা এসেছেন। ১ লা জানুয়ারী তাদের গ্রামে একটা অনুষ্ঠান আছে। সেখানে বাবাকে যেতে হবে।
--- তাহলে আমাদের পিকনিক ?
--- বাবাও সেই কথাই বলেছিলেন। তখন রামকাকাই প্রস্তাব দিলেন আজই লাগিয়ে দাও। তাহলে সবদিক রক্ষা হয়। আমিও তোমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে পারব।
সেই কথা শুনে বাবা বলেন , তাহলে অবশ্য মন্দ হয় না। আজও তো স্কুল ছুটি। কিন্তু কাউকে তো বলা হয় নি। তারপরই বাবা আমাকে খবর দিতে পাঠালেন।
সান্ধ্যআসরের বন্ধুদের পরিবারের লোকেদের নিয়ে প্রতিবার ধরণী পাহাড়ে ১ লা জানুয়ারি পিকনিকের প্রচলন করেন কাকু। ১ লা জানুযারি স্কুল ছুটি থাকে বলেই সাধারণত ওই দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়। সেই জন্য দুর্গা পুজোর মতোই দিনটার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে তারা। দিনটা খুব ভালো কাটে মনোদের। আরও অনেকে ওইদিন পিকনিক করতে আসে পাহাড়ে। ওইসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের সংগে টিফিন বিনিময় , খেলাধুলা - হুটোপাটি করতে করতেই ঝুপ করে যেন দিনটা শেষ হয়ে যায়।
আর মনটা কেমন যেন করে ওঠে তাদের। নতুন বন্ধুদের ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হয়। পরের বার আবার দেখা হওয়ার আশা নিয়ে ফিরে যায় সবাই। পরের বার অধিকাংশেরই সঙ্গে আর দেখা হয় না। কিন্তু মনে পড়ে যায় তাদের ঘিরে নানা সুখস্মৃতি। ছন্দার হাত ধরে নিচে নিয়ে আসে মনোতোষ। নিচে নামতেই ছন্দা দেখে বেরোনোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। মা -- বাবা ঠাকুমারা সব একেবারে তৈরি হয়ে গিয়েছেন। তাকে দেখে মা বলে ওঠেন -- মেয়ের আমার এই ঘুম ভাঙল ? নে-নে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আমাদের গোছগাছ সব হয়ে এল। তোর হলেই বেরিয়ে পড়ব।
এই সুযোগে ছন্দাকে রাগাতে ছাড়ে না মনোতোষ। সে বলে, হ্যা , হ্যা যা তোর তো আবার আঠোরো মাসে বছর , তার উপরে সাজগোজের যা বহর , কতক্ষণে শেষ হবে তা তুইও জানিস না।
তার কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। আর রাগ দেখিয়ে ছন্দা দুমদাম করে পা ফেলে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। আজ সে আর মনোদার উপরে রাগ করতে পারে না। মনোদা আজ তার সকালবেলা সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করেছে। তবে মনোদার উপরে তার কিছুটা অভিমান হয়। সারাদিনই তো সে মনোদার আশেপাশেই ঘোরে। অথচ মনোদা নাকি তাকে সেই সময় সেই ভাবে দেখেই না। আজ মনোদার কাছে জানতে হবে অন্যসময় তাকে কেমন লাগে ? তাই সে আজ নিজেকে একটু যত্ন করেই সাজায়।সাজগোজ করে বেরোতেই তাকে দেখে বিনীতাকাকী বলে --- ছন্দামা আজ তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রে।
কাকীর কথায় ছন্দা একটু লজ্জা পায়। চোখ চলে যায় মনোদার দিকে। সে দেখতে পায় এক পলক দেখেই মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে মনোদা। কিন্তু মনোদার চোখে মুখে মুগ্ধতার ছাপটা চোখ এড়ায় না তার। তারা সবাই তৈরি হতে না হতেই তাদের বাড়ির সামনে এসে গাড়ি নিয়ে কাকু-কাকীরা পৌঁছে যান। আর তারাও সবাই হই-হই করে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে।
শীতের শুরু থেকেই পাহাড়ে পিকনিকের ধুম পড়ে যায়। সেদিন তারা পৌঁছোনোর আগেই বহু পিকনিক পার্টি তাবু খাটিয়ে রান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। ওইসব পিকনিক পার্টির মধ্যে তাদের গ্রাম থেকে আসা আদিবাসীরাও রয়েছে। ওই দলের পুরুষেরা রান্নাবান্নার যোগাড় করছে।মহিলারা ধামসা মাদলের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে গান করছে আর নাচছে। খুব সুন্দর করে সেজেছে ওরা। ওদের মধ্যে সুখী, ফুলমনি, মনমতিদের দেখে খুব আনন্দ হয় মনোতোষের। একসময় ওরা তার সংগেই পড়ত। কিন্তু প্রাইমারীর গন্ডী ছাড়ানোরআগেই স্কুল ছেড়ে দিয়ে সব বাবুদের বাড়িতে ঝিগিরি করতে শুরু করে। স্রেফ দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য তাদের স্কুল, সোনালী শৈশব ছেড়ে তাদের ওইসব কাজে নাম লেখাতে হয়। তবু তাদের অভাব ঘোচে না। সারা শরীর জুড়ে ফুটে ওঠে অভাবের চিহ্ন। সেইসব চিহ্ন যেন আজও তার চোখে কাটার মতো বিঁধে আছে। ওরা যখন বাবুদের বাড়িতে কাজে ঢোকে তখন ওদের পরনে থাকে কেবল মাত্র সস্তার একটা ইজের। উর্ধাঙ্গ পুরোপুরি ফাঁকা। প্রথম দিকে তেমন কিছু মনে না হলেও পরে খুব দৃষ্টিকটু দেখায়।
কারণ কাজ করতে করতেই ওদের শরীরে যৌবনের কুড়ি ফুটতে শুরু করে। তখন উর্ধাঙ্গে জোটে শুধু বাবুবাড়ির মেয়ে বৌদের বহুল ব্যবহারে ফিনফিনে হয়ে যাওয়া কাটা ফাটা ব্লাউজ। যৌবনের কুড়ি বিকশিত হয় , কিন্তু ফুলমনিদের উর্ধাঙ্গের পোষাক বদলায় না। শীতের সময় ব্লাউজের উপর জোটে বড়োজোর ছেঁড়া গামছা।ওই আচ্ছাদনে তাদের সম্ভ্রম রক্ষা হয় না , বরং আরও বেশি বেআব্রু হয়ে পড়ে। বড়ো বেশি প্রকট হয়ে উঁকি দেয় মুকুলিত যৌবন। তবে তা নিয়ে অবশ্য বাবুদের কারও কোন মাথাব্যথার বালাই থাকে না। মানুষ নয় , তাদের বাড়ির কাজের মেয়েটি যেন একটা রোবট। কেউ কেউ চোরা চাউনিতে নষ্টসুখ উপভোগ করেন। সেই ফুলমনিদের দেখে আজ খুব ভালো লাগে মনোতোষের। চোলি -- লোহেংগাতে তাদের দেখতে যেন পরীদের মতো লাগছিল। গ্রামেই বিয়ে হয়েছে ফুলমনিদের। তাদের স্বামীরাও প্রায় মনোতোষের সমবয়সী। প্রাইমারীর বেশি পড়া এগোয় নি তাদেরও। অভাবের তাড়নায় পড়া ছেড়ে বাবা যাদের জমি চাষ করত তাদের বাড়িতেই গরু মোষ দেখা শোনার কাজে যোগ দিতে হয়। কার্যত ক্রীতদাসের মতো বাবার দাসখত খাটতে খাটতে তাদেরও দিন কেটেছে।
তাই আজকের আনন্দটা তারা পুরোপুরি উপভোগ করছে। আদিবাসীরা এ রকমই। তারা আজকের জন্য বাঁচে। কাল কি হবে ভাবে না। আর ভাবে না বলেই বোধ হয় সব ভুলে ওরা এভাবেই অনাবিল আনন্দে মেতে উঠতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলমতির হাতে এক থালা কষা মাংস আর দু'বোতল মদ দিয়ে যায় ওর বর কালীচরণ।মদ মাংস ঘিরে গোল হয়ে বসে ফুলমতিরা।
তারপর মদ আর মাংস খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ধামসা-মাদলের তালে তালে জমে ওঠে ফুলমতিদের নাচ গান। একসময় সুখীর বর কালীরাম বাঁশি ধরে। তার বাঁশির মন কেমন করা সুর পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে। মনোর খুব ভালো লাগে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ওদের আনন্দ - উচ্ছাস। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফুলমনিরা এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় তাদের আনন্দ যজ্ঞে। ফুলমনি তার হাতের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে নাচতে শুরু করে। তাই তাকেও তালে তালে পা মেলাতে হয়। সেই সময় সুখী তার সামনে একপিস কষা মাংস এনে তার মুখের সামনে ধরে বলে -- নে খা, তু তো আর বাবুবাড়ির ছেলেদের মতো মদ খাবি না। তু মাস্টারবাবুর ছেলে, তাই তু আমাদের রান্না মাংসই খা।
ফুলমনিদের আন্তরিকতায় আপ্লুত হয়ে পড়ে। আর ওদের মরদরা মাংস চিবোতে চিবোতে মনোতোষকে ওইভাবে নাচতে দেখে রান্না ভুলে হাততালি দিয়ে ওঠে। মনোতোষভাবে এমনটা বোধহয় ওদের পক্ষেই সম্ভব।হঠাৎ তাল কেটে যায়। মনোতোষ যেন মেঘের শব্দ শুনতে পায়। টের পায় বৃষ্টির আভাস।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment