( কিস্তি --- ৪ )
সেটা রান্নাঘরে রেখে সে আর মনোদা পিঠে খেতে খেতে আবার বৃষ্টি থামানোর সেই ছড়াটা আউড়ায় -- " লেবুর পাতা করমচা , যা বৃষ্টি ছেড়ে যা। " কিছুক্ষণ ওই ভাবে ছড়া আউড়ানোর মধ্যেই বৃষ্টিটা একটু ধরে আসে। আর তারা ' ছেড়ছে, বৃষ্টি ছেড়ছে বলে হাততালি দিয়ে ওঠে। মনোদা বলে দেখলি তো , ছড়ার কেমন শক্তি। বৃষ্টি থামিয়ে দিল।
সে বলে , তা বটে।
কাকু অবশ্য সেদিন বলেছিলেন , এসব হচ্ছে কাকতালীয় ব্যাপার। সে তখন সাহসে ভর করে জিজ্ঞেস করেছিল -- কাকতালীয় ব্যাপার কি কাকু ?
কাকু তার প্রশ্নে একটুও বিরক্ত হন নি। বরং সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন কাকতালীয় কথার অর্থ। স্কুলে পড়ানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে কাকু খুব জনপ্রিয়। তিনি বুঝিয়ে দেওয়ার পর সব জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায়। সেই রকম ভাবেই কাকু বলেন -- মনে কর একটা তাল পেকে আছে। সেটার এমনিতেই সকাল ১০টার সময় গাছ থেকে খসে পড়ার কথা। ঠিক সেই মুহুর্তে তালটার উপরে একটা কাক উড়ে এসে বসল। আর তালটাও নির্ধারিত সময়ে খসে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে কাকটা তালের উপর বসল বলেই সেটা খসে পড়ল। এই ব্যাপারটাকেই কাকতালীয় বলে।
-- কিন্তু তাহলে সবাই বলে কেন ছড়া ?
-- বলে কেন সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না। বংশ পরম্পরায় বাহিত হয়ে চলে আসছে ওইসব ছড়া। মনে হয় বৃষ্টির সময় মানুষকে তো ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয় , বিশেষ করে বাচ্চাদের। তাই সময় কাটানোর জন্য ওইসব ছড়ার জন্ম হয়েছিল।
সেদিন আরও একটা প্রশ্ন তার মনে জেগেছিল। কিন্তু সাহস করে প্রশ্নটা আর করা হয় নি কাকুকে। কিন্তু প্রশ্নটা তার মনের মধ্যে সেই সময় থেকেই ঘুরপাক খায়। তারা ছোটরাই কি শুধু কাকতালীয় ঘটনায় বিশ্বাস করে ?
বড়োরাও তো কম যান না। বৃষ্টি না হলে ছোটরা যেমন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলে -- " আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে। " তারপর দৈবাৎ যদি বৃষ্টি নামে তাহলে তারা লাফিয়ে ওঠে। তাদের ছড়ার সৌজন্যেই বৃষ্টি হয়েছে বলে দাবিও করে। বড়োরাও তো তাইই করেন। এই তো সেবার বৃষ্টির অভাবে মাঠের ধান মরতে বসেছিল। ওপাড়ার কান্তকাকা আর সোনা জ্যেঠু মহা ধুমধাম করে ব্যাঙের বিয়ে দিয়েছিলেন। সোনা জ্যেঠু পাত্রের বাবা আর কান্তকাকা পাত্রীর বাবা হয়েছিলেন।
রীতিমতো পালকি সাজিয়ে , ব্যান্ডের বাজনা সহ লোক খাইয়ে হয়েছিল সেই বিয়ে। কাকু নিজেও সেই বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। আর হবি হ , দীর্ঘদিন পর সেই রাতেই ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও হয়। তখন সোনাজ্যেঠু আর কান্তকাকাকে দেখে কে ? ছোটদের মতো তারাও ব্যাঙের বিয়ের জন্যই বৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করে বসেন। গ্রামের অধিকাংশ লোক তাদের কথা বিশ্বাসও করেন। সেই থেকেই দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলেই তাদের গ্রামে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়াটা দস্তুর হয়ে গিয়েছে। ছন্দা জানে প্রশ্নটা করতে পারলে কাকু খুব সুন্দর ভাবে এই বিষয়েও ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। কাকুর প্রতিটি কথাই তাদের খুব যুক্তিপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু অভ্যাস বশে ওইসব ছড়া আউড়াতেও ছাড়ে না তারা।
মনে পড়ে সেবারে তার শেষ দুধ দাঁতটা ভেঙেছিল মনোদাদের বাড়িতে। তখন সে ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ে। তখন কাকুর কাছে পড়তে আসত না।কিন্তু খেলাধুলা করতে আসত মনোদাদের বাড়িতে। তখন মনোদাই তাকে খুঁজে খুঁজে ইঁদুরের গর্তের কাছে নিয়ে যায়। তারপর বলে ওই গর্তের মুখে দাঁত ছুড়ে দিয়ে বল -- ইঁদুর ভাই ইঁদুর ভাই, আমার দুধ দাঁতটা নিয়ে তোমার ছোলা দাঁতটা দাও। সে 'ও বিনা বাক্য ব্যয়ে মনোদার নির্দেশ পালন করে। কিন্তু তার মনে পড়ে যায় এর আগে তো সে জলে দাঁত ছুড়ে বলেছিল , জলকুমড়ী জলকুমড়ী আমার দুধ দাঁতটা নিয়ে তোমার ছোলা দাঁতটা দাও।
সেই কথা তুলতেই মনোদা সেদিন বিজ্ঞের মতো বলেছিল , একই ব্যাপার। কুমিরের দাঁত কি ইঁদুরের চেয়ে বেশি শক্ত না বেশি সুন্দর ? তাছাড়া এখন জলে কুমীর কোথাই পাবি ? শুধু শুধুই বলা হবে। তার চেয়ে গর্তে ইঁদুর থাকলেও থাকতে পারে। সে তোর প্রার্থনা শুনে ছোলা দাঁত দিয়ে দেবে। তখন মজা করে ছোলাভাজা চিবিয়ে চিবিয়ে খাবি।
ওই রকম ছড়া আউড়াতে গিয়ে কাকুর কাছে একবার চরম বকুনিও খেতে হয়েছিল তাদের। সেদিন তাদের পিছনে পিছনে যে কাকুও আসছিলেন তা কেউ লক্ষ্য করে নি। অন্য দিনের মতো হই-হুল্লোড় করতে করতে স্কুলে যাচ্ছিল তারা। কখনও কাটান , কখনও বা সমস্বরে ছড়া বলতে বলতে যাচ্ছিল। সঞ্চিতা জিজ্ঞেস করেছিল, বল দেখি কি হবে, ঝিক ঝিক কাজললতা , ডাট নেই তার ধরব কোথা ? তারা সমস্বরে বলে ওঠে, খুব সহজ খুব সহজ , ডিম ডিম।
তারপর তাপসদা বাহাদুরি করে বলে উঠে -- বল দেখি ডাকালে যায় না , না ডাকালে যায় কি হবে ?
অমনি সবাই বলে ওঠে, এমা এ তো আরও সহজ। কানকোটারি, কানকোটারি ( কেন্নো)। বেশ চলছিল , আচমকা তাদের কি দুর্মতি হলো কে জানে ? রাস্তার ধারের জমিতে লাঙ্গল দিচ্ছিল এক চাষি , তাকে দেখে সবাই সুর করে বলে ওঠে --- আদারে বিদারে টিকটিকির বাসা। কালো মেঘে জল হয় না গরু খেকো চাষা।
তাদের ছড়া শুনে চাষির অবশ্য কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। বরং সে দাঁত করে হাসে আর বলে , তা যা বলেছে গো দাদা--দিদিরা। সত্যিই জলের খুব আকাল। মাঠের ফসল শুকিয়ে মরতে বসেছে।
কিন্তুচাষির কথা শেষ হতে না হতেই পিছন থেকে ভেসে কাকুর রাগী গলা -- এই দাঁড়া , শোন সব।
কাকুর গলা শুনে তো ভয়ে সবার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার যোগাড়। কাকু যে এভাবে পিছনে পিছনে আসতে পারেন তা ভাবতেও পারে নি তারা।
তাই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভয়ে কার্যত কাঁপতে থাকে সবাই। মনোদার অবস্থা হয় সব থেকে করুণ। কাকু তাদের কাছাকাছি পৌঁছে বলেন , আয় এবার আমার সঙ্গে সঙ্গে। তারা তখন রীতিমতো ধন্দে পড়ে যায়। কাকু তাদের কি করবেন তা ভেবে পায় না তারা। স্কুলে নিয়ে গিয়ে কি সবার সামনে কোন শাস্তি দেবেন নাকি? সে বড়ো লজ্জার ব্যাপার হবে।
কাকুই তাদের সেই আশংকা দূর করে দেন। যেতে যেতে তিনি বলেন , এই যে ছড়াটা তোরা বললি তাতে দুটো সম্প্রদায়কে অসম্মান করা হয় তা কি তোরা জানিস ? এক যারা গোমাংস খায় তাদের , আর যারা চাষি তাদের। চাষি মাত্রই কিন্তু গোমাংস খায় না। আবার গোমাংস খান এমন অনেকেও রয়েছেন যারা চাষি। তাছাড়া গোমাংস খাওয়াটা তো গর্হিত কোন কাজ নয়। নিজস্ব খাদ্যাভাসের ব্যাপার। আর গোমাংস কেন কোন কিছু খাওয়ার উপরেই বৃষ্টি হওয়া না হওয়া নির্ভর করে না। কথাটা মনে থাকবে ?
তারা ঘাড় কাত করে বলে --- হ্যা -আ।
ততক্ষণে তারা স্কুল গেটে পৌঁছে গিয়েছে। তাই কাকু বলেন -- যা এবার সব স্কুলে যা।আর তারপর সবাই এক ছুটে যে যার ক্লাসে ঢুকে যায়। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে সবার। তারপর থেকেই ওই ছড়াটা তারা আর বলে না। সেদিনের সেই ঘটনাটাতেই যেন এতক্ষণ ডুবেছিল ছন্দা। আচমকা মনোদা তাকে নাড়া দিয়ে বলে, ওঠ এই ছন্দা কি ভাবছিস রে এত?
--- মনোদা চাষিদের নিয়ে ছড়া বলার সেই দিনটার কথা মনে আছে ?
--- ওরে বাবা, আমি তো সেদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
--- সে তো আমিও।
তারমধ্যেই একসময় বৃষ্টি কমে আসে। ছাতা নিয়ে বাবা ডাকেন -- আয় ছন্দা , বৃষ্টিটা ধরেছে। কে জানে, আবার ঝমঝমিয়ে নামবে কিনা !
সে তখন রান্নাঘরে কাকীমার কাছে বিদায় নিতে ছোটে। কাকীমা বলেন , বেশ আয়।
মনোদা বাইরের দরজা বন্ধ করতে আসার সময় বলে , ছন্দা সকাল সকাল চলে আসিস। অনেক পিঠে বাড়তি থেকে গেল। দুজনে খাব। বাসি পিঠে খেতে খুব ভালো লাগবে।
রাস্তায় পা রেখে সে বলে -- পেটুকরাম।
মনোদা ' তবে রে ' বলে তার দিকে এগিয়ে আসতেই সে ছুটে বাবার ছাতার ভিতরে ঢুকে পড়ে বলে --- হেরো - হেরো।
তাদের কান্ড দেখে কাকু আর বাবা হেসে ওঠেন।এক অন্যরকম ভালো লাগা নিয়ে বাড়ি ফেরে ছন্দা। ঘুরে ফিরে শুধুই তার মনোদার কথাই মনে পড়ে।
মনে হয় কখন সকাল হবে, আবার মনোদার সঙ্গে ওই রকম দুরন্তপনা করবে।
মনোদার সঙ্গে দুরন্তপনা করতে তার খুব ভালো লাগে। বেশি বিরক্ত করলে মনোদা অবশ্য তাকে বকা লাগায়। কিন্তু সে গায়েই মাখে না। উল্টে সে কাকীমার কাছে মনোদার নামে নানা রকম মিথ্যা দোষারোপ করে। আর কাকীমা তাকে বকা দেয়। তখন আরও রেগে মনোদা তাকে মারতে আসে। সে কাকীমার আড়াল থেকে বুড়ো আঙুল দেখায়। ওইসব কথা ভাবতেই বাড়ি ফেরে ছন্দা।
মায়ের হাতে টিফিন ক্যারিয়ারটা তুলে দিয়ে ছন্দা বলে -- কাকীমা পিঠে দিয়েছে।
মা হেসে বলে , দিদি কি পায়েসের শোধ দিল নাকি রে ?
--- তা আমি কি করে বলব ? সেটা গিয়ে তোমার দিদিকেই জিজ্ঞেস কোর।
---- ওরে বাবা আমার সে সাহস নেই। ধার -- শোধ এসবের কথা তুললে দিদি আমার সঙ্গে আর কথাই কইবেন না হয়তো।
---- তাহলে তুলছো কেন তেমন কথা। কাকীমা কি তোমার পায়েসের জন্য হাঁ করে বসেছিলেন ? তুমি পায়েস না দিলে কি উনি পিঠে পাঠাতেন না , না এর আগে কখনও কিছু পাঠান নি।
---- মেয়ের দেখছি গায়ে জ্বালা ধরছে। ঘাট মানছি , মা তোমার কাকীমার কথা বলে ভুল করে ফেলেছি , ক্ষমা দাও।
মায়ের কথা বলার ধরণ দেখে হেসে ফেলে ছন্দা। ইদানিং সে লক্ষ্য করেছে ওই বাড়ির কাকীমার সম্পর্কে কেউ কিছু বললেই সে সহ্য করতে পারে না। আচ্ছা করে দু'কথা শুনিয়ে দেয়। এইতো সেদিন তার গঙ্গাজল খুকীর মা বিনীতাকাকী তাকে রাগানোর মাকে বলছিল , দিদি যাই বলো বাপু আমাদের মনের কাকীমায়ের নাকটা যেন একটু বোঁচা বোঁচা মনে হয়।
ওমনি সে বলে ওঠে , মোটেই না, কাকীমা নাকটা খুব সুন্দর।
তার কথা শুনে মা আর বিনীতা কাকী হেসে বলেন -- হ্যা মা, তোমার কাকীই গ্রামের সেরা সুন্দরী।
---- বটেই তো।
আর কথা বাড়ান না বিনীতা কাকীরা। সেদিন পিঠে আর পায়েস খেয়ে পেট ভর্তি ছিল। তাই মাকে আর কিছু খাব না বলে সে ঠাকুমার বিছানায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে না তার। কেবলই মনোদার কথা মনে হয় তার। আর বিছানায় এপাশ--ওপাশ করে। খাওয়া-দাওয়ার পর শোবার ঘরে এসে নাতনির অস্থিরতা টের পান শান্তিলতা। ছন্দাকে উশখুশ করতে দেখে জিজ্ঞেস করেন এখনও ঘুমোস নি ভাই ?
--- ঘুম আসছে না। এসো গল্প বলো।
--- যাই দাঁড়া।
বাটা থেকে এক খিলি পান সেজে মুখে পুরে নিয়ে নাতনির পাশটিতে এসে শুয়ে পড়েন শান্তিলতা। তারপর শুরু করেন মহাভারতের গল্প। আর ছন্দা ঠাকুমার গায়ের উপর পা তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরে শোয়। এটা তার অনেকদিনের অভ্যাস। ঠাকুমা কোন প্রসাধনী মাখেন না। কিন্তু তার গায়ে যেন সব সময় একটা চন্দনের গন্ধ পায় ছন্দা। সেই গন্ধের খোঁজে ঠাকুমার বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে সে। আর ঠাকুমা সুরেলা গলায় একের পর এক বলে চলেন রামায়ণ--মহাভারতের গল্প। সেই গল্প শুনতে শুনতে ঘুম নেমে আসে তার চোখে।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment