Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৩











      নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


      শুরু হল ধারাবাহিক উপন্যাস -- 















                    কালের কারিগর

              

                                 অর্ঘ্য ঘোষ




           

                   ( কিস্তি --- ৩ ) 





আর তারা সুর করে ' লেবুর পাতা করমচা , যা বৃষ্টি ছেড়ে যা ' বলতে বলতে বাড়ি দিকে ছুট লাগায় দুজনে। একছুটে একেবার কাকীমার হেসেলঘরে পৌঁছোয়। ততক্ষণে তারা দুজনেই ভিজে একসা। তাদের দেখেই ছুটে আসেন কাকীমা। বকাবকি শুরু করে দেন। কাকুকে উদ্দেশ্য করে বলেন , দুটির কাণ্ডকারখানা এসে একবার দেখে যাও। ওরে এই ঠান্ডায় এমন করে ভিজে এলি দুটিতে একসংগে অসুখে পড়লে কে সামলাবে শুনি ? কোথাও  দাঁড়াতে কি হয়েছিল ? একটু দাঁড়ালে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত শুনি ?  বৃষ্টি ছাড়লে আসা যেত না বুঝি ?
সে হাতের টিফিন কৌটোটা দেখিয়ে বলে , তা হয়তো যেত, কিন্তু হাতে এইটা ছিল যে। তোমরাই তো বলো রাতের বেলা খাবার নিয়ে বাইরে কোথাও বেরোতে নেই।  খাবারের লোভে ভুতেরা নাকি পিছু নেয়।
--- হ্যা , ভুতেদের আর খেয়ে দেয়ে কাজকর্ম নেই যে খাওয়ার লোভে ওদের পিছু নেবে। ওদের যে খাবারের বড্ড অভাব।  কি আছে কি ওতে ?
---- নলেনগুড়ের পায়েস গো কাকীমা। মা সবার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। আমিও খাই নি। তোমার ছেলে অবশ্য একবাটি খেয়ে এসেছে।
ছন্দা মাঝে মধ্যে কাকীমাকে রাগাতে মনোদার পরিবর্তে তোমার ছেলে বলে। কাকীমা কপট রাগ দেখিয়ে বলে -- ও আবার কি কথা , মনোদা বলতে কি হয় ? ফের যদি তোমার  ছেলে তোমার ছেলে বলবি তো এক চাঁটি খাবি তা বলে রাখলাম কিন্তু। 
আজ আর অবশ্য কাকীমা চাঁটি মারার কথা তোলার অবকাশই পান নি। নিজের আচল দিয়ে একবার তার আর একবার মনোদার মাথা মুছিয়ে দিতে শুরু করেছেন।সে আঁচলের তলা থেকে ততক্ষণে হি হি করে কাঁপতে শুরু করেছে। ঠক ঠক করে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। সেই অবস্থাতেই সে বলে , জানো কাকীমা পায়েস নিয়ে আসতে আসতে সত্যিই আমার ভুতের ভয় লাগছিল। মনে মনে বলছিলাম , " ভুত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি , রাম--লক্ষ্মণ বুকে আছে করবে আমার কি ? "মনে হয় ওই ছড়া শুনেই ভুত-পেত্মীরা আর আমাদের পিছু নেওয়ার সাহস পায় নি। 
--- না মা তা নয় , আসলে তোমাদের মতো মুর্তিমান জলজ্যান্ত দুজন ভুত - পেত্নীকে দেখে তেনারাই আর পিছু নেওয়ার সাহস পান নি।
তারপর তাকে ঠক ঠক করে কাঁপতে দেখে কাকীমা চোখ পাকিয়ে বলেন , যা তাড়াতাড়ি   জামা প্যান্ট পাল্টে আয়।নইলে জ্বর বাঁধিয়ে বসবি শেষে। 
তাদের মাথা মোছাতে গিয়ে  কাকীমার কাপড়খানাও ততক্ষণে ভিজে সপসপে হয়ে উঠেছে। সেটা দেখিয়ে ছন্দা  বলে , আর ভিজে কাপড় পড়ে থাকলে তোমার বুঝি অসুখ করবে না ? তখন তোমাকে কে দেখবে শুনি ?
--- কেন তুই তো আছিস ?আমার অসুখ হলে তুই পারবি না সব সামলে দিতে ?
--- জানি না যাও। তুমি চলো আগে শাড়ি পাল্টে নেবে। তবেই আমি জামা-প্যাণ্ট বদলাব।
বলেই সে কাকীমাকে টানতে টানতে রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসে। বৈঠকখানা ঘর থেকে কাকু সেই দৃশ্য দেখে বলে ওঠেন -- আচ্ছা জব্দ হয়েছে মায়ের কাছে আমার। একেই বলে যেমন কুকুর তেমনই মুগুর।
কথাটা কানে যেতেই কাকীমা রাগ দেখিয়ে বলেন , কি ? তুমি আমাকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করলে ?
---- এই দেখ ছি,ছি। তোমাকে কুকুরের সংগে তুলনা করতে পারি ? তাহলে যে আমাকেও কুকুর হতে হয়। কারণ আমি তোমার স্বামী। কুকুর তো কখনও মানুষের স্বামী  হতে পারে না ? ওটা আসলে একটা কথার কথা। আমি বললে তো তুমি ভিজে কাপড় পাল্টানোর কথা বলে কানেই তুলতে না। কিন্তু ছন্দা  মায়ের কথা শুনে তো দেখছি দিব্যি সুর সুর করে কাপড় বদলাতে চললে।
--- বেশ করছি। ছন্দা  আমার সব কথা শোনে। তুমি আমার সব কথা শোন ? কতবার করে বলেছি বিড়ি-সিগারেট খেও না। রাতে কাশি হয়। শুনেছ আমার কথা ?  
কাকীমার কথা শুনে যেন জোকের মুখে নুন পড়ার মতো অবস্থা হয় কাকুর। কোন কথা বলতে পারেন না। সত্যিই তো কাকুর কাশির ধাত রয়েছে। বিড়ি-সিগারেট খেলেই কাশিটা বেড়ে যায়। কাকীমা কতবার পইপই করে বারণ করেছেন। কাকু কানে তোলেন নি। ছন্দা  মনে মনে ভাবে , কাকু যদি শুধুই কাকু হতেন তা হলে সে একবার চেষ্টা করে দেখত। কিন্তু কাকু যে তার শিক্ষকও। কাকু হিসাবে উনি তার খুব কাছের মানুষ। কিন্তু  শিক্ষক হিসাবে স্বাভাবিক একটা দুরত্ব থেকেই গিয়েছে। সেটা অতিক্রম করে বিড়ি-সিগারেট বন্ধ করার চেষ্টার কথা  ভাবতে কেমন যেন বাধো বাধো লাগে তার। যদি কোনদিন দুরত্বটা অতিক্রম করা সম্ভব হয় তাহলে কাকুকে সে ধুমপান ছাড়াবেই ছাড়াবে। অস্ত্র 
তো তার হাতেই আছে। টিভিতে তো হরদমই দেখাচ্ছে - ' ধুমপান করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ' ওই বিজ্ঞাপনটা দেখিয়েই তো সে অনায়াসে কাকুকে চাপে ফেলে দিতে পারবে। 


         ওইসব কথা ভাবতে ভাবতেই ছন্দা লক্ষ্য করে কাকীমা রাগে তখনও সমানে গজগজ করছেন। সে জানে রাগটা আসলে কপট। দু'জনে দু'জনকে খুব ভালোবাসেন। বলা যায় চোখে হারান।  মাঝে মধ্যে তার মনে হয় কাকু বোধহয় কাকীমাকে একটু সমীহ করে চলেন। কাকীমাও কাকুর কোন বিষয়ে পান থেকে চুন খসতে দেন না। সবদিকে খেয়াল রাখেন।কাকুও তাই সব ব্যাপারেই কাকীমার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন ততক্ষণ শুধু সাধনা- সাধনা আর সাধনা।  সারাদিন কাকু যেন  সাধনারই সাধনা করেন। কখনও বলেন -- সাধনা আজ কোন জামাটা পড়ে স্কুলে যাব ? কখনও বা বলেন --  সাধনা খাবার আগের ওষুধটা কি শেষ হয়ে গিয়েছে , খুঁজে পাচ্ছি না তো ? কাকীমাও রান্না করতে করতেই ছুটে এসে কাকুর হাতের কাছে সব একে একে এগিয়ে দিয়ে যান।কাকু--কাকীমার সম্পর্কের এই বোঝাপড়া নিয়ে তার বাবা--মায়ের মধ্যে তুলনা টানাটানি চলে। ছন্দা বাবাকে বলতে শুনেছে -- দেখ গে আমাদের ছন্দার কাকীমাকে , তার কাকাকে কুটোটি কেটেও দুটো করতে দেয় না। সব কিছু হাতে হাতে এগিয়ে দেয়। 
জবাবে মা বলেছে , তুমি আর বলো না। নিজে গিয়ে বরং দেখে এসো দিদিকে দাদা কেমন মাথায় করে রেখেছে। 
বাবা মায়ের এই উতোরচাপানে খুব মজা পায় ছন্দা। কারণ সে ভালো করেই জানে তুলনা টানাটানি করলেও তার বাবা-মায়ের মধ্যেও পারস্পরিক টান কিছু কম নেই।জামা-প্যাণ্ট পাল্টে রান্নাঘরের দিকে ফেরার পথে ছন্দা  দেখতে পায় বৈঠকখানা ঘরে তখন কাকুর সান্ধ্য আসরের সংগীরা সব ছাতা মাথায় হাজির হয়েছে। তাদের মধ্যে  তার বাবাও রয়েছেন। আজ আর বোধ হয় তাস খেলা হবে না। কারণ রেডিওতে তখন শুরু হয়েছে নট্ট কোম্পানির যাত্রা -- "মা -মাটি- মানুষ।" সবাই সেই যাত্রাতেই মজে রয়েছেন। মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে সমবেত উচ্ছাস -- আহা কি গলা। শুনে মন প্রান জুড়িয়ে গেল।তারই মাঝে সে নিজে হাতে চা বানিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে বৈঠকখানা ঘরে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই কাকু বলে উঠেন - এ চা নিশ্চয় আমার ছন্দা  মায়ের হাতের তৈরি। হতেই হবে। 
সে হ্যা সূচক ঘাড় নাড়তেই কাকু বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন -- মলয়, মেয়েটা তোমার সত্যিই খুব লক্ষ্মীমন্ত।
বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে সে দেখে বাবার মুখটা খুশীতে ভরে উঠেছে। ছেলেমেয়ের প্রশংসাতে বাবা মায়ের তো খুশী হওয়ারই কথা।রান্নাঘরে যেতেই কাকীমা তার হাতে দুটো পায়েসের বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলেন , যা তো 
একটা বাটি মনোকে দিয়ে আয়। আর ওই সংগে তুইও খেয়ে নে। যেটাতে কম আছে, সেটা মনোকে দিবি। তোদের বাড়িতে তো ও একবার খেয়ে এসেছে।
---- আর তোমরা ? 
---- আমরা একেবারে পিঠের সংগে খাব। তুই খেয়ে তাড়াতাড়ি আয়। হাতে হাতে পিঠে ক'টা বানিয়ে ফেলি। তারপর বৈঠকখানা ঘরে সবাইকে দিয়ে আসবি।
আর বলতে হয় না। বাটি দুটো হাতে নিয়ে সে মনোদার পড়ার ঘরে যায়। নিজে অবশ্য কমটা নিয়ে বেশিটা মনোদাকেই দেয় সে।
মনোদা সেটা লক্ষ্য করে বলে, আমি তো একবার খেয়েছি। আমাকে বেশিটা দিলি কেন ? মা নিশ্চয় তোকে কমটা নিতে বলে নি ?
--- না তা বলেন নি বটে। আমিই দিলাম। তুমি তো মহা পেটুকরাম। তাছাড়া বেশি করে খেয়ে দেয়ে বল করে নাও , নাহলে আবার আমাকে মারবে কেমন করে ? 
--- তবে রে ?  খেতে দিয়ে আবার খোঁটা দেওয়া হচ্ছে  ?
বলে মনোদা তাকে মাথায় চাটি মারার ভান করে তেড়ে আসে। আর সে একছুটে রান্নাঘরে কাকীমার কাছে পৌঁছে যায়।
তারপর কাকীমার সঙ্গে পিঠে তৈরিতে হাত লাগায়। পিঠে তৈরি করতে করতে কাকীমা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসেন -- হ্যারে , তোর কি হয়েছিল রে  আজ ? স্কুলে যাওয়ার জন্যই তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলি। তারপর তোর কাকুর মুখেই শুনলাম তুই নাকি স্কুলেই যাস নি। মনোকেও জিজ্ঞেস করলাম, সেও কিছু জানি না বলল।
খুব অপ্রস্তুতে পড়ে যায় সে। ভেবেছিল কাকীমা হয়তো আর ওই প্রসঙ্গ তুলবেন না। তাই কি বলবে ভেবে উঠতে পারে না সে। মনোদা যে কায়দা করে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি থাকে না তার। সেই বা কি করে এখন সত্যি কথাটা বলে মনোদাকে বকা খাওয়ায় ? তখন রাগের মাথায় হলে কি হত বলা যায় না। কিন্তু এখন যে রাগ অনুরাগে পরিনত হয়েছে।


                    তাই সে বলে , হঠাৎ শরীরটা কেমন খারাপ লাগল। তাই মাঝপথ থেকেই বাড়ি ফিরে যায়।
--- ওমা, সেকি,  কি হয়েছে ? ওষুধ খেয়েছিস? এতক্ষণ বলিস নি কেন ? তোর কাকু তো তাহলে দিবাকর ডাক্তারের কাছে একবার দেখিয়ে আনতে পারত। কাকীমার কথা শুনে প্রমাদ গোনে ছন্দা। মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে কি শেষ পর্যন্ত ফেঁসে গেল সে ? এখন যদি তার অসুস্থতার কথা শুনে কাকু তাকে ধরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় তাহলেই হয়েছে আর কি ? এমনিতে অসুখ হলেই সে ওষুধ খেতে চায় না। তার উপরে ইঞ্জেকশানে তার খুব ভয়। 
দিবাকর ডাক্তার নাকি রোগী পেলেই ধরে ইঞ্জেকশান দিয়ে দেন। তাই সে তাড়াতাড়ি বলে , না- না ওসবের দরকার নেই। আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।
---- অমনি বললেই হলো সম্পূর্ণ সুস্থ আছি?  তুই ডাক্তার না কবিরাজ, যে ওই কথা বলে দিলি ?
---- ছাড়ো তো ওসব। কাকুদের সব কি ঠান্ডা হয়ে গেলে তবে পিঠে খাওয়াবে ?
---- ও হ্যা হ্যা, কথায় কথায় ভুলে গিয়েছিলাম। যা তো মা দিয়ে আয় সবাইকে।
হাফ ছেড়ে বাঁচে সে। কাকীমাকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তাই চরম দোটানায় পড়েছিল। সত্যি কথা বলে কিছুতেই আর মনোদা বকুনি খাওয়াতে ছন্দা  চাইছিল না। আপাতত পিঠের দোহাই দিয়ে তো কাকীমার জেরার হাত থেকে রক্ষা পেল সে। পিঠে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরে পৌঁছোতেই সবাই উচ্ছস্বিত হয়ে পড়ে। সে সবার হাতে প্লেটে প্লেটে পিঠে তুলে দেয়। ততক্ষণে রেডিওতে যাত্রা শেষ হয়ে গিয়েছে। সবাই  পিঠে খাওয়াও শেষ করে ফেলেছে। তারা বাড়ি যাওয়ার জন্য উশখুশ করছে। কিন্তু বৃষ্টির বিরাম নেই। তাই কেউ বেরোতেও পারছে না। কারণ যে তোড়ে বৃষ্টি পড়ছে তা ছাতাতে আটকাবে না।তাই সবাই বৃষ্টিটা একটু ধরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। সেও বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরবে।কাকীমা তার পায়েস নিয়ে আসা টিফিন কেরিয়ারে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য খান কতক পিঠে ভরে দিয়েছেন। সেটা রান্নাঘরে রেখে সে আর মনোদা পিঠে খেতে খেতে আবার বৃষ্টি থামানোর সেই ছড়াটা আউড়ায় -- " লেবুর পাতা করমচা, যা বৃষ্টি ছেড়ে যা। "




                      ( ক্রমশ )






     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                              ( ১ ) 
                                  


                            ( ২) 





                        ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )


         



                          ( ৫ )

                               ( খেলার বই )


                                                                                 


                 ----০----


               









No comments:

Post a Comment