Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কালের কারিগর -- ৭



      


         নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


                শুরু হল ধারাবাহিক উপন্যাস -- 















               কালের কারিগর

              

                             অর্ঘ্য ঘোষ


                 ( কিস্তি --- ৭ ) 





এইজন্য বাবাকে নিয়ে তার গর্ব হয়। তাদের গ্রামে অবস্থাপন্নদের বাড়িতে ডাইভার ,কাজের লোকেদের সবার শেষে আলাদা করে খেতে দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। সে ভোজকাজই হোক, কিম্বা পুজোর প্রসাদই হোক বাড়ির কাজের লোকেদের পাতে জোটে হতশ্রদ্ধার ছিটেফোঁটা করুণা। এই তো সৌমেনদের বাড়িতেই সেদিন নিজের চোখে দেখেছে বাড়ির কাজের  লোকেদের কি অবমাননা। সৌমেনের বাবা কুনালকাকুরা বিরাট বড়োলোক। জমিজমা তো আছেই , আছে পাথর খাদান, বাস ট্রাকের ব্যবসাও। কুনালকাকু আবার শাসকদলের নেতাও। মঞ্চে যখন ভাষণ দেন তখন গলায় গরীবদের জন্য দরদ  উথলে পড়ে। কিন্তু নিজের বাড়িতে গরীবদের সঙ্গে ব্যবহার করেন সম্পূর্ণ উল্টো। সে নিজের চোখেই দেখে এসেছে সব। সেদিন ছিল সৌমেনের জন্মদিন। সে এক এলাহি আয়োজন। নিমন্ত্রিতদের খাওয়া দাওয়ার পর এঁটো পাতা তুলে টেবিল পরিস্কার করছিলেন সৌমেনদেরই বাড়ির দুই কিসাণ সুকদেব আর কম্ফিকাকুর স্ত্রী। দু'জনের সঙ্গেই ছিল  রোগা-পাতলা দুটি করে ছেলে মেয়ে। তারা প্যাণ্ডেলের বাইরে বসে খাওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছিল আর বলছিল, অ মা মিষ্টি দে- না। আইসক্রিম দে- না মা।  তাদের মা'রা একবার করে সাত্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, দাঁড়া সবার খাওয়া হোক। তারপর উচ্ছিষ্ট পাতা এনে ডাই করে জমা করছিলেন ছেলেমেয়েদের পাশেই। ক্রমশ রাত বাড়ছিল। এক সময় ধৈর্যহারা হয়ে ছেলেমেয়েগুলো ডাই হয়ে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট পাতা থেকেই কুকুরের সঙ্গে বের করে খাচ্ছিল আধ খাওয়া মিষ্টি, মাছ কিম্বা মাংসের হাড়। তারপর একসময় উচ্ছিষ্ট পাতার পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে বাচ্ছাগুলো। কারও নজর পড়ে না বাচ্চাগুলোর দিকে। কেউ বলে না ওদেরও খাইয়ে দাও। মায়াবী আলো আর  সুরের মুর্ছনায় কেউ বাচ্চাগুলোর দিকে ফিরেও তাকানোর সময় পায় না। সবার খাওয়া শেষে বাবা মায়েরা বালতিতে নিজেদের খাবার নিয়ে ছেলেগুলোকে বগল দাবা করে বাড়ি ফেরেন।সেদিন কিছুতেই খাবার গলা দিয়ে নামছিল না মনোতোষের। কেবলই মনে হচ্ছিল নিজের খাবারটা বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে আসে। কিন্তু সৌমেনরা অপ্রস্তুতে পড়ে যাবে ভেবেই সেটা করতে পারেনি। তবে নিজেদের বাড়িতে কিছুতেই সে এমন ঘটনা ঘটতে দেবে না। আশ্চর্য্য হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল মনোতোষের। সেদিন রাত্রি হয়ে যাওয়ায় আর তাকে বাড়ি ফিরতে দেয় নি সৌমেন। রাতে ভালো ঘুম হয় নি তার। কেবল ছেলেমেয়েগুলো মুখ মনে পড়ে যাচ্ছিল। আর এক অপরাধ বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল তাকে। কেন সে  কে কি বলবে তার তোয়াক্কা না করে নিজের খাবার ওদের খাওয়াল না ? নিজের মনের কাছে সেই জবাবদিহি োকরতে করতে শেষ রাতে একটু চোখ লাগে তার। ভোরে কম্ফিকাকুর গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে শুনতে পায় সৌমেনের মা নীতাকাকীর উদ্দেশ্য কম্ফিকাকু বলছেন -- মা ঠাকরুন গোয়ালের চাবি দেন। গরু বের করতে হবে।কাকীমা দোতলার জানলা থেকে চাবিটা ফেলে দিয়ে ফের বিছানা নেন। সৌমেনদের গোয়াল ভর্তি গরু মোষ।  এর আগেও সে বার কয়েক সৌমেনদের বাড়িতে রাত্রিবাস করেছে। তখনই দেখেছে কি শীত -কি বর্ষা কম্ফিকাকু ওই ভাবে চাবি নিয়ে গোয়াল থেকে গরু বের করেছেন। ২০/২৫ টা গরু মোষ বের করে খেতে দিতে দিতেই সকাল হয়ে যায়। তারপর সবাই উঠে চা-টা খায়। 



                         সেদিনও তার অন্যথা হয় না। কিন্তু সেদিন তার সামনে যে ঘটনাটা ঘটে , সেটা আজও অপরাধ বোধ হয়ে থেকে গিয়েছে তার মনে। এর আগে তার চোখে পড়ে নি। কিন্তু সেদিন সে সৌমেনের সংগে রান্নাশালে বসেই চা খাচ্ছিল। কাকীমা তাদের চা-বিস্কুট দেওয়ার পর চা করার শশপ্যানটাতেই  জল ,  কিছুটা গুড় আর আগেরবার করা চা পাতাটাই দিয়েই ফুটিয়ে নিয়ে ডাক দেন --- কম্ফি কাপ নিয়ে আয়।
চা খেতে খেতেই মনোতোষ লক্ষ্য করে -- কম্ফিকাকা ধানের গোলার নিচে থেকে কানা আর ডাঁট ভাঙা একটা কাপ বের করে নিয়ে পেতে ধরেন। কাকিমা সেটাতে নিকশ কালো রঙের  দ্রবনটা ঢেলে দেন। সেটা আর গামছার আঁচলে চাট্টি মুড়ি নিয়ে কম্ফিকাকা চলে যান গোয়ালচালার দিকে। সেদিনও তার গলা দিয়ে চা - বিস্কুট নামছিল না। নিজের চা-বিস্কুটটা কম্ফিকাকার হাতে তুলে দিয়ে আসতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু তখনও সৌমেনরা অস্বস্তিতে পড়বে ভেবেই  তাকে ফের মনের ইচ্ছে মনেই চেপে রাখতে হয়। কিন্তু কিছুতেই সে ভেবে পাচ্ছিল না কাজের লোকেদের জন্য কেন এভাবে আলাদা চা করতে হবে। যাদের পরিচর্যায় গাই দুধ দেয় , তারা কেন চায়ে একটু দুধ পাবে না ? ওদের ভালো চা দিতে ক'চামচ বা আর বেশি চিনি-দুধ লাগে ? কই তাদের বাড়িতে তো এমন কখনো  হয় না। তাদের তো অভাবের সংসার। বাবার সামান্য বেতনে মা'কে খুব টিপেটিপে সংসার চালাতে হয়। তাদের অবশ্য বাঁধা ধরা কোন কাজের লোক নেই। মাঝে মধ্যে একে-তাকে ডেকে টুকটাক কাজ করানো হয়। কই মা তাদের জন্য তো আলাদা করে কিছু করেন না। বরং ভালো কিছু হলে বাবার সান্ধ্য আসরের বন্ধুদের তো বটেই , ওইসব অস্থায়ী মজুরদেরও না দিয়ে মা তাদের পাতে দেন না। তাই বোধহয় সৌমেনদের বাড়ির ঘটনাটা তার মনের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ঘটনার কথাটা বলতেই মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন , " তোর উপরে তো নেই ভূবনের ভার। সেটা ভগবান দেখবেন। তাই কে কি করল দেখে মন খারাপ করিস না। শুধু নিজের মনটা বড়ো কর। মনটা বড় হলে তবেই বড়ো কিছু করতে পারবি তুই।"



                                      শুধু সৌমেনদের বাড়ির ওই ঘটনাই নয় , রাজীবদের বাড়ির একটা ঘটনাও তার মনে তীব্র রেখাপাত করে।রাজীবও তার বন্ধু। তার বাবা সুশীলকাকু এমনিতে কিছু করেন না ঠিকই কিন্তু  বনেদী পরিবার বলতে যা বোঝায় রাজীবরা হলো তাই। গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলাভরা ধানের মতোই বাড়িতে রয়েছে দোল দুর্গোৎসব। বন্ধুরা অধিকাংশই তাদের বাড়িতেই দুর্গাপুজো দেখতে যায়। গতবারই পুজো দেখতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে যায় মনোতোষ। দুর্গা দালান পরিস্কার , মন্ডপে মাকে চাপানো থেকে যাবতীয় ভারী কাজগুলো ওদের বাড়ির মাহিন্দাদের তদারকি করে করিয়ে নিচ্ছিলেন সুশীলকাকু। মাহিন্দাদের ছেলেগুলোও  বাবার পিছনে পিছনে ঘুর ঘুর করছিল। তখন কিছু ছিল না।  কিন্তু যেই ওইসব কাজ সম্পন্ন হয়ে যায় তখনই ঠাকুরদালানে প্রবেশাধিকার হারিয়ে যায় ওদের।মাহিন্দাররা বিষয়টি জানত বলেই ওরা অবশ্য আর ওইদিক মাড়ায় নি। কিন্তু বাচ্চাগুলোর তো সে সব জানার কথা নয় , তাই প্রসাদের আশায় ঘুর ঘুর করতে থাকে ঠাকুর দালানে। বাড়ির কর্তা-কর্ত্রীদের নজরে পড়তেই হই হই করে ওঠেন তারা। কুকুর বেড়ালের মতো কার্যত ছেই -ছেই করে নামিয়ে দেন নিচে। এমন কি ঢাকির কাঁসর বাজাতে আসা ছোট ছেলেটির গতিবিধিও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। তবু ছোট ছেলেমেয়েগুলো কিছু গায়েই মাখে না। ঠায় নিচে দাঁড়িয়ে থাকে প্রসাদের জন্য। পুজো শেষে বাড়ির লোকেদের আগে প্লেটভর্তি প্রসাদ দেওয়া হয়। তারপর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ওইসব ছেলেদের ছোঁয়াচ বাঁচাতে উপর থেকে হাতে আলগোছে ফেলে দেওয়া হয় প্রসাদ। ঢাকির ছেলেটিও সেই লাইনে কাঁসর উল্টে ধরে। সেই কাসরেও আলগোছে ফেলে দেওয়া হয় সামান্য কিছু প্রসাদ। তার কিছু হাতে কিম্বা কাঁসরে পড়ে। বাকিটা পড়ে মাটিতে। কুকুরের সঙ্ছংলেমেয়েগুলো সেই প্রসাদ কুড়িয়ে কুড়িয়ে খায়। তাদেরই সমবয়সী বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলোর হাতে তখনও প্লেট ভর্তি প্রসাদ। ছেলেমেয়ে গুলো লোভার্ত দৃষ্টিতে নসেদিকে চেয়ে থাকে।তা দেখে বাবুদের বাড়িদের ছেলেমেয়েগুলো প্লেটের প্রসাদ ছুড়ে ছুড়ে ফেলতে থাকে। কুকুরের সাথে কাড়াকাড়ি করে সেই প্রসাদ কুড়িয়ে খায় ছেলেমেয়ে গুলো। মজা পেয়ে বাবুদের বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো হাততালি দিয়ে ওঠে। কেউ কেউ মাকে জিজ্ঞাসা করে -- মা ওরা কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাচ্ছে , ওদের অসুখ করবে না ? 
মায়ের বলেন , ওরা ছোটলোক, ওদের অত অসুখ-বিসুখ করে না।


                   কথাটা শুনেই তার কান্না পায়। প্রসাদগুলো যেন পেটের ভিতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। খুব বমি পায় তার। সে ভেবে পায় না যাদের হাতে মা বেদীতে  ওঠেন , যাদের হাতের বাজনায় মায়ের নাকি প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় , তারাই কি করে অছ্যুৎ হয়ে যায় ? সবাই তো মায়েরই সন্তান। তাহলে মা সন্তানের এত অবমাননা সহ্য করেন কি করে ? ওইসব কথা ভাবতেই কখন তার খাওয়া থেমে গিয়েছে টের পায় নি। টনক নড়ে ক্ষীরুদার কথাতে। ক্ষীরুদা বলেন , আমাদের খাওয়া শেষ হতে চলল। তুমি তো দেখছি তখন থেকে নাড়াচাড়ায় করে চলেছে। খাবে কখন ?
সে তাকিয়ে দেখে ক্ষীরুদার পাতা পরিস্কার। মুখে কেমন পরিতৃপ্তির ছাপ। খুব ভালো লাগে তার। এক লহমায় মুছে যায় এতদিন ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা ওইসব অপরাধ বোধ। খাওয়া শেষ করতে সে দ্রুত হাত চালায়। মনে মনে ভাবে , ভাগ্যিস এতক্ষণ তার পাতের দিকে কারও নজর পড়ে নি। নাহলে জবাবদিহির মুখে পড়তে হত তাকে। সে খুব অস্বস্তির ব্যাপার হত। না পারত সবার সামনে বন্ধুদের বাড়ির সম্পর্কে সত্যি কথাটা বলতে, না পারত বানিয়ে মিথ্যা কথা বলতে। খাওয়া শেষ হতেই বেলা পড়ে আসে। সব গোছগাছ করে গাড়িতে তোলেন বাবা--কাকারা। সে আর ছন্দা গাড়িতে সামনের সিটে ক্ষীরুদার পাশে গিয়ে বসে। পাহাড়ি পথ ভেঙে গাড়ি এগিয়ে চলে বাড়ির পথে। কিছু দূর গিয়েই দেখা হয়ে যায় ফুলমনিদের ম্যাটাডোরের সঙ্গে। গাড়ি থেকে তার ওদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে। ওরাও হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দেয়। একসময় ম্যাটাডোরেই ধামসা মাদল বাজিয়ে গান ধরে ফুলমনিরা। শুনে শুনে তারাও গলা মেলায়। তাদের দেখাদেখি বাবা-কাকা, মা -- কাকীমারাও গলা মেলান। পাহাড়ে পাহাড়ে সেই গান প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে অপূর্ব এক সুরের মুর্ছনা সৃষ্টি করে।



                           ( ক্রমশ )





  নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


 দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার উপন্যাস ------
  

                              ( ১ ) 
                                  


                            ( ২) 





                        ( ৩ )

                                       
                            


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  

                      ( ৪ )


         



                      ( ৫ )

                            ( খেলার বই )


                                                                                 


                 ----০----


              




No comments:

Post a Comment