Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

শহিদের মা -- ৩ /

 


                        শহিদের মা 


                               অর্ঘ্য ঘোষ 

                                                    ( ৩ ) 


সায়িন কাজীর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বুক ফাটা কান্নায়  শোক বিহ্বল হয়ে পড়ে গোটা রূপসা গ্রাম। শুধু সায়িন কাজীর স্ত্রী পাপিয়া তিন নাবালক সন্তানকে বুকে চেপে নির্বাক হয়ে পাথরের মুর্তির মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কাল খবরটা আসার পর থেকে সমানে কেঁদে কেঁদে হয়তো কাঁদার ক্ষমতাটাই বুঝি সে হারিয়ে ফেলেছে। বাড়িতে তখন ভেঙে পড়েছে গ্রামের লোক। সায়িন পরোপকারী ছিল। লোকেরা সেইসব পরোপকারের স্মৃতিচারণ করছিল। মহিলারা কেউ কেউ তাদের বুকে জমাট বেঁধে থাকা স্বজন হারানোর লুকোনো কান্না ঝরিয়ে দিয়ে বুকটা হালকা করে নিচ্ছিল। তাদের মধ্যে জাহেদাও ছিল। তবে তার তো আর কান্না  লুকোনো নয় , দশ বছর ধরেই যে সে এমনি করে কেঁদে চলেছে। গত রাতেও কেঁদেছে। রাতে অবশ্য শোকের পাশাপাশি গ্রামের মানুষের একটা চাপা আতঙ্কও ছিল। এমনিতে রূপসা গ্রাম এখন অরুণোদয় পার্টির দখলে। গণমঞ্চ পার্টির লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে গ্রাম ছাড়া হয়ে রয়েছে। কিন্তু শাবলডাঙ্গা গ্রাম খুব একটা দূরে নয়। জাহিরুলের ছেলে লালু সহ গণমঞ্চ পার্টির দু'জন লোক খুন হয়ে গিয়েছে। ওই গ্রামের বেশ কিছু বাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে অরুণোদয় পার্টির লোকেরা। তারপর থেকেই পাল্টা হামলা আর পুলিশের ধরপাকড়ের ভয়ে অরুণোদয় পার্টির লোকেরা গাঢাকা দিয়েছে। কয়েকজন সায়িনের দেহ ময়না তদন্ত করাতে নিয়ে গিয়েছে। গ্রাম ছিল পুরুষ শুন্য। তাই শোকের পাশাপাশি শংকায় নির্ঘুমে কেটেছে রাত। তারপর সকাল হতেই আবার সবাই দফায় দফায় ভীড় জমিয়েছে সায়িনদের বাড়িতে।  মৃতদেহের প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে বিকেল গড়িয়ে যায়। 

          সন্ধ্যার মুখে গ্রামে ফেরে সায়িনের মরদেহ। ফুল দিয়ে সাজানো শববাহী শকটের পিছনে পিছনে কলকাতা থেকে আসেন অরুণোদয় পার্টির নেতা সুকুল ব্যানার্জী , রণজয় মিত্র। জেলা নেতা অমল অধিকারীই তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সুকুলদের ততদিনে ভালোই চেনা হয়ে গিয়েছে জাহেদার। দশ বছরে তো ওদের কম দেখল না। তাই অন্যান্যবারের মতোই সুকুলবাবুদের কাছে এগিয়ে যায় সে। সুকুলবাবুরা কিন্তু তাকে চিনতেও পারেন না। তাকে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে নেন তারা। জাহেদা ভেবে পায় না সুকুলবাবুরা কি সত্যিই তাকে চিনতে পারেন না , নাকি না চেনার ভান করেন ? কই তার তো সুকুলবাবুদের চিনতেঅসুবিধা হয় না। পরক্ষণেই মনে হয় কার সঙ্গে কার তুলনা টানছে সে ! তার মতো কত জাহেদা আছে। সবার কথা কি সুকুলবাবুদের মনে রাখা সম্ভব ? কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে জাহেদা। এই শোকের আবহে সে নিজের দুর্দশার কথা মুখ ফুটে বলতেও পারত না। মনে মনে ভেবেছিল সুকুলবাবুরা তাকে দেখে নিজে থেকেই একান্তে কিছু সুরাহার কথা বলবেন। কিন্তু সুকুলবাবুরা তো তাকে চিনতেই পারলেন না , সুরাহা হবে কি করে ? মনের দুঃখ মনে চেপেই সায়িনের  পারলৌকিক কাজে নিজেকে সামিল করে জাহেদা।যথাসময়ে মাটি হয়ে যায় সায়িনের। কবরে মাটি দিয়ে সুকুলবাবুরা সায়িনের বাড়ির লোকেদের সান্ত্বনা দিয়ে ফেরার উপক্রম করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন সবাই। সায়িনের মা  আয়েসা বিবি সুকুলবাবুর হাতে জড়িয়ে ধরে বলেন , ' বাপজান আমার কাজের ছেলেটা চলে গেল। এখন আমাদের কি করে চলবে ? কে দেখবে আমাদের ? ' 

' চিন্তা করছেন কেন ? সায়িন দলের জন্য মৃত্যু বরণ করে শহীদ হয়েছে। আপনি তো শহিদের মা। আমরা সবাই আপনার সন্তান। আপনাদের পরিবারের দায়িত্ব আমাদের। ' সান্ত্বনা দিয়ে চলে যান সুকুলবাবুরা। আর ওই কথা শুনে ম্লান হাসি ফুটে ওঠে জাহেদার মুখে। এক লহমায় ফিরে আসে দশ বছর আগের সেই সন্ধ্যাটা। সেদিনও এমনি করেই শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল গোটা গ্রাম। ছুটে এসেছিলেন দলের কর্ত্রী অঞ্জনা রায়। সুকুলবাবুরা সেদিনও তার সঙ্গে এসেছিলেন। সেদিনও জাহেদার হাত ধরে একই কথা বলেছিলেন দলনেত্রী। কথাগুলো যেন আজও কানে বাজে জাহেদার। কেউ বলছে , ' আম্মি তুমি তো শহিদের মা। সুরবান গিয়েছে তো কি হয়েছে ? আজ থেকে আমরা সবাই তোমার ছেলে, সবাই তোমার পোলাপান। '

কেউ বা বলছে, ' আজ থেকে তুমিই আমাদের মা। আমরাও শহীদের মায়ের সন্তান। '

সেদিন ওইসব কথা বলতে গিয়ে সবার গলা আবেগে অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। জাহেদারও শুনে সব যেন কেমন সত্যি মনে হয়েছিল। আবার অবাকও লেগেছিল। ওইসব সুবাস ছড়ানো চকচকে পোশাক পরা মানুষগুলোকে তার সন্তান বলে মনে হচ্ছিল না। কারণ তার সুরবানের গায়ে ওদের মতো সুবাস তো দুরের কথা ,  নতুন পোশাক জোটে নি কোনদিন। মঙ্গলার হাট থেকে  ওর বাবার এনে দেওয়া ছেঁড়াফাটা সেকেণ্ডহ্যাণ্ড পোশাক পড়েই তো কেটেছে সুরবানের। সেই সুরবানের মতো এই চকচকে পোশাকের লোকগুলো কি করে তার সন্তান হবে ? 

                   সেই প্রশ্নটা আজও তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। আর প্রশ্নটা মনে জাগলেই সেদিনের সেই বীভৎস ছবিটাও মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। অরুণোদয় পার্টির লোকেরা ধান কাটতে যাওয়ার কথা বলে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন ফিসফাস শুরু হয়ে যায় গ্রামে। জাহেরদারা অবশ্য কোন কিছু আঁচ পায় না। সকালে সুরবানদের ডেকে নিয়ে যায় রানা আর মালেক। সুরবানরা বেরিয়ে যেতেই গুলিগোলার আওয়াজ কানে আসে জাহেদার। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে তার। আল্লার দোয়া প্রার্থনা করে সে। মনে মনে বলে , ' আল্লা মেহেরবান ,  সুরবানকে তুমি দেখো। আল্লার কানে সেদিন জাহেদার সেই প্রার্থনা পৌঁছোয় নি। কয়েক ঘন্টা পরেই তার প্রমাণ মেলে। ছুটতে ছুটতে তাদের বাড়ি এসে পৌঁছোয় রানা। তাকে দেখেই অজানা আশঙ্কায় জাহেদার বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে। গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। কথা বলার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত লোপ পায়। শুকনো গলায় কোনরকমে বলতে পারে , ' হ্যা বাপ তুমি চলে এলে , আমার সুরবান কই ? ' 

সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে রানা বলে, ' চাচী খুব বড়ো বিপদ হয়ে গিয়েছে। আমাদের এখনই একবার মহকুমা হাসপাতাল যেতে হবে। কলকাতা থেকে নেতা নেত্রীরা সব আসছেন।'

বিপদের কথা শুনে ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায়। সুরবানের খারাপ কিছু হয়েছে কিনা তা জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না। যে কাপড়ে ছিল সেই কাপড়েই বাড়ির সবাই বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির বাইরে বেরিয়েই দেখতে পায় মসজিদের সামনে ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। তাতে গ্রামের আরও অনেকে বসে রয়েছে। তারা গিয়ে চাপতেই ট্রাক ছেড়ে দেয়। যেতে যেতেই শুনতে পায় , সুরবানরা নাকি মাঠে নামতেই গণমঞ্চের লোকেরা বোমা বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রাণ ভয়ে যারা কাজে গিয়েছিল তারা যে দিকে পারে পালিয়ে যায়। যারা পালাতে পারে নি তারা বোমা-বন্দুকের মাঝে পড়ে যায়। গণমঞ্চের লোকেরা তাদের নৃশংসভাবে পিটিয়ে খুন করে। পুলিশ আহত আর নিহতদের উদ্ধার করে মহকুমা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। 

             ওই কথা শুনে হাড়হিম হয়ে যায় জাহেদার। সে ভেবে পায় না সুরবানদের কেন গণমঞ্চের লোকেরা মারবে। ওরা তো মজুর খাটতে গিয়েছিল। তবে কি ভিতরে অন্য কোন ব্যাপার ছিল ? সেইজন্যই কি এক দুপুর কাজের বিনিময়ে পাঁচশো টাকা মজুরী দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় ? আরও নানা প্রশ্ন ভীড় করে আসে তার মাথার মধ্যে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছোয় তারা। ট্রাক থেকে নামতেই গা'টা শিউরে ওঠে জাহেদার। মর্গের সামনেই তখন সার দিয়ে শোয়ানো রয়েছে সাদা কাফনে ঢাকা  এগারোটি মৃতদেহ। এক পুলিশকর্মী তাকে একের পর এক মৃতদেহের সামনে নিয়ে গিয়ে মুখের ঢাকা সরিয়ে জিজ্ঞেসা করে চলে ' --- এইটা -- এইটা-- এইটা ? ' সে যে কি মানসিক চাপ তা আজও মনে আছে জাহেদার। একের পর এক নিহতদের মুখ দেখে না সূচক ঘাড় নাড়তে নাড়তে তার মনে হতে শুরু করে তাহলে বোধহয় নিহতদের মধ্যে সুরবান নেই।  অনেকে তো পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। তার মধ্যে সুরবানও নিশ্চয় ওই দলে আছে। সনাক্তকরণের জন্য যখন একটার পর একটা নিহতদের মুখের ঢাকা খোলা হচ্ছিল তখন আল্লার কাছে সেই প্রার্থনাই করছিল সে। 

          ওইসব পলাতকদের তালিকাতেই যেন থাকে তার সুরবান। কিন্তু শেষ মৃতদেহের ঢাকাটা খুলতেই নিথর হয়ে যায় জাহেদা। ওই তো কেমন নিচিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে তার একমাত্র পুত্র সন্তান। সবে গোঁফের রেখা গজিয়েছে। গালে চিকন দাড়ি। ঠোঁটের কোনে যেন তখনও লেগে রয়েছে মিলিয়ে যাওয়া হাসির রেশ। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না জাহেদা। ছেলের মুখটা নাড়াতে নাড়াতে ডুকরে কেঁদে ওঠে,  ' বাপজান একবার আম্মা বলে ডাক। তুই যে বলে গেলি বাপ , চপ সানা দিয়ে পান্তা ভাত খাবি। আমি পান্তা ভাত বেড়ে রেখেছি , লক্ষ্মী বাপ আমার খেয়ে যা। ' 

ছেলের সেলাই করা মাথার খুলির ভিতর থেকে রক্তরস চুঁইয়ে ভিজিয়ে দেয় মায়ের হাত। মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে কিম্বা হোঁচট খেয়ে সামান্য রক্ত ঝড়লে কেঁদে সারা হত সুরবান। দুব্বো ঘাস কিম্বা গাঁদা ফুলের পাতা থেঁতলে ক্ষতস্থানে টিপে ধরে থাকতে হত জাহেদাকে। রক্ত পড়া বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কান্না থামত না তার। বেরিয়ে যাওয়া রক্তের ঘাটতি পূরণ করতে ওর বাবা হাজার অভাব  স্বত্তেও পরদিন ছেলের জন্য গোস্ত আনত মুন্সীপাড়ার বাজার থেকে। আর সেই সুরবানের শরীরেই আজ আর একফোঁটাও রক্ত নেই। শুধু জলের মতো বের হছে রক্ত রস। তা দেখে আবার ডুঁকরে কেঁদে উঠে জাহেদা। তাকে জড়িয়ে কাঁদে সুরবানের বাবা এবং বোনেরাও। তাদেরই মতো আরও দশটি পরিবারের কান্নায় ভারী হয়ে উঠে মহকুমা হাসপাতালের মর্গের বাতাস। চেতনা লুপ্ত হওয়ার আগে জাহেদা টের পায় তাকে সুরবানের কাছে থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকটা সুগন্ধী পোশাক পড়া হাত। সদ্য সন্তান হারানো ক্ষতে তাদের  কথাগুলো কেমন যেন সান্ত্বনার প্রলেপ দিচ্ছিল। সবাই বলছিল , ' তুমি আজ আর শুধু সুরবানের মা নও, তুমি আমাদেরও মা। তুমি এক সন্তানকে হারিয়েছো, কিন্তু চেয়ে দেখ আজ আমরা তোমার হাজারো সন্তান।তুমি যে শহিদের মা।' 

          হাসপাতালেই ফুলে ফুলে ঢেকে দেওয়া হয় এগারোটি মৃতদেহ। কলকাতা থেকে আসা নেতা নেত্রীরা সার বেঁধে শোওয়ানো মৃতদেহের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। সন্ধ্যার মুখে ফুল ঢাকা ট্রাকে মৃতদেহগুলি গ্রামে ফিরিয়ে আনা হয়। লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে রূপসা গ্রাম। হাসপাতাল থেকে মৃতদেহের সঙ্গে আসেন দলনেত্রী অঞ্জনা রায় , সুকুল ব্যানার্জী , বদন মুখার্জী  রণজয় মিত্ররা। সঙ্গে ছিলেন অমল অধিকারী , বানী ব্যানার্জী , সুভাশিস মণ্ডলের মতো জেলার নেতারাও। সংবাদ মাধ্যমের লোকেরাও ভীড় জমায়।  ভিড়টা মূলত জাহেদাদের উঠোনেই ভেঙে পড়েছিল।  কারণ নিহতদের মধ্যে সুরবানই ছিল সবার ছোট। পরিবারের একমাত্র সক্ষম পুরুষ। পুরুষ কি তখন আদৌ হয়ে উঠেছিল সুরবান ? অর্থাভাবে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেনি জাহেদা। মেয়েরা ছাগলগরু চড়ায় , ঘাস কাটে , জ্বালানী কুড়িয়ে আনে। আর খুন  হওয়ার কিছুদিন আগে পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে হাঁসের পাখা , গরুর গোবাচি , প্লাস্টিকের জুতো ছেঁড়া কিনে বেড়িয়েছে সুরবান। সবে ছোটখাটো ঠিকার কাজ আর দিনমজুরী শুরু করেছিল। সেটাই যে ওর কাল হয়ে দাঁড়াবে তা ভাবতেও পারে নি জাহেদা।

              সেই সুরবানের নিথর দেহ শোয়ানো রয়েছে উঠোনের মাঝে। উঠোনে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই বললেই চলে। রূপসা গ্রাম জুড়ে তখন কান্নার রোল। এগারোটি পরিবারে এগারোটি মৃতদেহ ঘিরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন পরিজনেরা। প্রতিবেশীরা পালাক্রমে এবাড়ি  - সেবাড়ি সান্ত্বনা দিয়ে আসছেন। জাহেদাকেও জড়িয়ে ধরে রয়েছেন কয়েকজন। ছেলের মৃতদেহ জড়িয়ে নাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে তখন ঘন ঘন মুর্ছা যাচ্ছে জাহেদা। আবার চেতনা ফিরলে প্রতিবেশীদের জড়িয়ে ধরে বলে উঠেছে , 'ও হোসেনের আম্মা , ওগো সানোয়ারের খালা , হ্যা গো এবার কি হবে ? কে দেখবে আমাদের ? '

সন্ধ্যার অধো অন্ধকারের মধ্য জাহেদার ওই আকুতি ভরা প্রশ্ন সমস্ত কলরব ছাপিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে পরিবেশটাকে আরও যেন শোকবহ করে তোলে। প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দেয় , ' সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। তাছাড়া আমরা তো আছি। 'একই আশ্বাস দেন পার্টির লোকেরাও। কিন্তু সেই সান্ত্বনা শান্ত করতে পারে না জাহেদাকে। অনাগত ভবিষতের কথা ভেবে দিশাহারা হয়ে পড়ে সে।  মাথায় মাথায় পাঁচ - পাঁচটা মেয়ে। তার মধ্যে আবার ছোটটা প্রতিবন্ধী। বলের মতো চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে প্রতিদিন। ডাক্তার অপারেশান করাতে বলেছেন। সে অনেক টাকার ব্যাপার। অত টাকা কোথাই তাদের ? চোখের জ্বালা কমাতে নিয়মিত একটা মলমই কিনে দিতে পারে না মেয়েকে। সুরবানের বাবাও চোখে ভালো দেখে না। তাই কেউ খুব একটা কাজেও ডাকে না তাকে। এক ছটাক জমি জিরেতও নেই। থাকার মধ্যে এক কামরার খুপড়ি ঘর। তাতেই গরু - ছাগল ,  হাঁস -- মুরগীর সঙ্গে গাদাগাদি করে মাথা গুঁজে পশুর মতোই থাকে তারা। তাদের সংসারে যে মানুষের থেকে ওইসব পশুদেরই দাম বেশি। ওইসব পশু থেকে সংসারে অনেক সুসার হয়। বেহাল সংসারের হালটা সুরবানই কিছুটা ধরেছিল। সেই কথা মনে পড়তেই আবার ছেলের মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে জাহেদা। সেই সময় পিঠে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে।


                      ( ক্রমশ ) 


2 comments:

  1. হলপ করে বলতে পারি আপনার মতো এমন নিখুঁত হতদরিদ্র মুসলিম পরিবারের কথা কোনো মুসলমান লেখক আঁকতে পারবে না, ঐ চপসানা কখনও সস্তায় চানাচুর সানা দিয়েও ভাত খাওয়া,ঐ রকম বাবু কমরেডদের চরিত্র বড় নিখুঁত বড় আগ্রহ নিয়ে পড়ছি,আপনার মতো শক্তিশালী লেখকের জয় হোক

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম। এভাবেই পাশে থাকুন।

    ReplyDelete