শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ৪ )
ঘাড় ঘোরাতেই দেবদত্ত দেখতে পায় তার পিঠে হাত রেখে দাঁত বের করে হাসছেন গণমঞ্চের প্রভাবশালী নেতা সুরঞ্জন সেনগুপ্ত। সৌমেন আর সে উঁচপুর টারজান ক্লাবের সামনে নীচু হয়ে রক্তের দাগ পরীক্ষা করছিল। মাঠ থেকে তুলে নিয়ে এসে নাকি এই ক্লাবের সামনেই ওই এগারোজনকে পাথর দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। তারপর থেকে সংবাদমাধ্যমকে গ্রামে ঢুকতেই দেয় নি গণমঞ্চের লোকেরা। ' লাশ গায়েব ' করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গ্রামের বাইরে থেকেই সবাইকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই হুমকি তুচ্ছ করে সৌমেনকে নিয়ে গ্রামে ঢুকে খবর সংগ্রহ এবং ছবি তোলার কাজ শুরু করে দেয় দেবদত্ত। কখন যে সুরঞ্জন সেনগুপ্ত পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা টের পায় নি তারা। সুরঞ্জন সেনগুপ্তকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে যায় দেবদত্ত। মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে যাদের মৃতদেহ শোওয়ানো তাদের রক্তের শুকিয়ে যাওয়া দাগ এখনও এই গ্রামের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। বাতাসে মিশে রয়েছে তাদের যন্ত্রণা কাতর মৃত্যু আর্তনাদ। সেই গ্রামে দাঁড়িয়ে কেউ যে এভাবে হাসতে পারে তা তার জানা ছিল না। রোম যখন পুড়ে যায় তখন নাকি সম্রাট নিরো বেহালা বাজিয়ে ছিলেন। রাজনীতিতে সুরঞ্জন সেনগুপ্ত সেই রকম শিল্পী-সম্রাট। রাজনৈতিক বহু অপকর্মকে এক একটা শিল্পের মোড়কে উপস্থাপন করেছেন বহুবার। এই গণহত্যাকে কোন শিল্পের মোড়কে বাজারজাত করবেন কে জানে !
বিস্মিত হয়ে সে প্রশ্ন করে , ' কি খবর দাদা আপনি এসময় এখানে ? '
' এখানে কি আর সাধে রে ভাই ? পার্টি অফিসেই বসেছিলাম। শুনলাম তোমরা গ্রামে ঢুকেছ। সেই শুনেই তো ছুটে এলাম। না হলে কি গল্প লিখে দেবে তার তো ঠিক নেই। তোমরা তো সব গল্প লিখতে ওস্তাদ। '
' কি বলছেন , গল্প লিখে দেব ? '
' তা নয় ? সেদিন মীরপুর গ্রামে আমাদের দু'জন কর্মী ওদের গুলি খেয়ে মরল আর তোমারা লিখে দিলে রহস্যজনক গুলিতে মৃত্যু। অথচ ওদের যে লোকটা মরেছে সেটার দায় আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে। '
' দাদা আপনারা তো পার্টি অফিসে বসে সব কলকাঠি নাড়েন আর কিছু সব কিছু দেখেন - শোনেন। আমরা কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে যা দেখি , যা শুনি তাই লিখি। সেদিন গুলিটাকে আমাদের রহস্যজনকই মনে হয়েছিল। আর অরুণোদয় পার্টির কর্মীর মৃত্যুটা তো আর মিথ্যা হয়ে যেতে পারে না। '
' মৃত্যুটা মিথ্যা তা তো বলি নি। কিন্তু মৃত্যু কারণ হিসাবে তোমরা যা লিখেছিলে সেটাই মিথ্যা বলছি। '
' তাহলে কি ভাবে মৃত্যু হয়েছিল ? '
' ওদের দলের লোকেরাই ওকে মেরেছে। '
' দলের লোকেরা মেরেছে ? দলের লোকেরা কেন মারতে যাবে ওকে ? '
' আলবাৎ! আরে সেটাই তো লাখ টাকার প্রশ্ন কেন মারতে যাবে ? সেই একটা কথা আছে না ' মূলে মাগ নাই , ফুলে সজ্জা ! ' ওরা সব এখন ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছে। তাই কেউ মাথাচাড়া দিলেই তাকে ওইভাবে সরিয়ে দিয়ে পথেরকাঁটা পরিস্কার করে নিচ্ছে। অথচ তোমরা আমাদের নামে খুনের অপবাদ চাপিয়ে দিলে। '
কথাটা খট করে কানে লাগে দেবদত্তর। সুরঞ্জনবাবুকে সে শিক্ষিত মানুষ বলেই জানে। ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। কলেজের জি ,এস ছিলেন। একসময় দলের সংস্কৃতি সম্পাদকের দায়িত্বও সামলেছেন। একজন সংস্কৃতি মনস্ক শিক্ষিত মানুষ যে কি করে অবলীলায় এই রকম কথা বলে কে জানে ! কথাটা শুনে মনে মনে খুব বিরক্ত হয় সে। মনের ভাব চেপে রেখে বলে , ' দাদা আপনারা তো সংবাদ মাধ্যমকে কোন গুরুত্বই দিতে চান না। তাহলে খবরের কাগজে কি বের হলো না হলো তা নিয়ে এত মাথাব্যথা করেন কেন ? '
' আরে আমাদের তো কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তোমাদের গল্পগুলো পাবলিক গোগ্রাসে গেলে। বিরোধী পার্টির লোকেরা কাগজ হাতে করে ধরে ধরে সবাইকে পড়িয়ে বেড়ায়। তার উপরে তো এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য কলকাতা থেকে ওদের নেত্রী ছুটে এসেছেন। তোমাদের তোল্লাই পেয়ে তিনি তো এখন ' কাগুজে বাঘ ', না-না বাঘিনী হয়ে উঠেছেন। গল্প বানাতে তো তার জুড়ি মেলা ভার। জানি না এক্ষেত্রে আবার কি গল্প বানিয়ে তোমাদের খাইয়ে দেবেন। তাই তো আসল ঘটনাটা বলতে ছুটে এলাম। '
' বেশ বলুন , আপনাদের গল্পটাই কি শুনি ? '
' ওই দেখ , আমাদের আবার গল্প কেন হবে ? যেটা সত্যি সেটাই বলছি শোন। ওরা সব এক - একটা ডাকাত। গ্রামে ডাকাতি করতে ঢুকেছিল। '
' দিনের বেলায় ডাকাতি ? কি বলছেন দাদা ? '
' আরে তবে আর বলছি কি ? দিনের বেলায় ঢুকেছিল বলেই না ধরা পড়ে গেল। তারপর যা হয় আর কি ? গণপ্রহারের শিকার হয়ে বেঘোরে চলে গেল প্রাণ ক'টা। '
' কিন্তু দাদা , অরুণোদয় পার্টির লোকেরা যে বলছে ওরা সবাই খেতমজুর , তাদের দলের কর্মী সমর্থক। ঠিকায় ধান কাটতে এসেছিল। রাজনৈতিক আক্রোশে আপনাদের দলের লোকেরা ওদের পিটিয়ে মেরেছে। '
' এই তো যা ভেবেছিলাম তাই ! এর মধ্যেই ঠিক সাজানো গল্প তোমাদের খাইয়ে দিয়েছে ওরা। বেশ চলো , তোমরা নিজের চোখেই দেখবে চলো। ডাকাতি করতে এসে ঘরে ঘরে কি তান্ডব চালিয়েছে দেখবে চলো। শুধু শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছবি তুলে নিয়ে চলে গেলে হবে না '
ততক্ষণে এক দুই-এক-দুই করতে করতে গণমঞ্চের লোকেরা দেবদত্ত আর সৌমেনকে কার্যত ঘেরাও করে ফেলে। ঘেরাও বন্দী হয়েই তাদের একের পর এক বাড়ি যেতে হয়। প্রতিটি বাড়িতেই দরজা , টিভি, বিভিন্ন আসবাবপত্র ভেঙেচুরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কোথাও বা মাটির হাঁড়ি - কলসি ভেঙে চালডালও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রতিটি বাড়ির ছবি তুলতে হয়। লিখে নিতে হয় ওইসব বাড়ির লোকেদের অভিযোগ। সবার মুখেই এক 'রা ' শোনা যায়। সবার দাবি , ডাকাতরা ওইসব ভাঙচুর করে টাকাকড়ি , গয়নাগাটি সব নিয়ে পালিয়েছে। তাদের মধ্যে এগারো জন হোঁচট লেগে পড়ে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। শুনে মনে হয় যেন সবাই শেখানো কথা বলছে। ভাঙচুরের চিহ্ন দেখেও একই কথা মনে আসে দেবদত্তর। এসব ঘটনা তো কম দেখা হলো না তার। বিভিন্ন সময়বিভিন্ন জায়গায় শাসক-বিরোধী দুপক্ষই লুটপাট - ভাঙচুরের একই তত্ত্ব খাড়া করে। একই ছবি প্রদর্শন করে। মনে হয় যেন একই ভাঙাচোরা জিনিসপত্র শিয়ালের কুমিরকে বাচ্চা দেখানো হচ্ছে। প্রয়োজনে নিজে হাতে নিজের ক্ষতি করতেও কেউ পিছপা হয় না। গতবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন সোনাপোঁতা গ্রামে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে নিজের চোখেই তো দেখেছে। সুরঞ্জনবাবুকে দেখে সেদিনের কথাটা মনে পড়ে যায় দেবদত্তর। সেদিনও সুরঞ্জনবাবুর কুটনৈতিক চাল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। তখন পঞ্চায়েতের ক্ষমতা গণমঞ্চের হাতে থাকলেও রাজনৈতিক ক্ষমতার নিরিখে সোনাপোঁতা গ্রামে শাসকদলের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল বিরোধীদের। তাই পঞ্চায়েতের ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে সেবারে নির্বাচনে এককাট্টা হয়ে উঠেছিল বিরোধীরা। সকাল থেকে রণসাজে সুসজ্জিত হয়ে ভোটকেন্দ্রের অদুরে দাঁড়িয়েছিল তারা। তাদের দাপটে শাসকদলের ভোটররা বাড়ি থেকে বের হতেই পারছিল না। গ্রামে ব্যাপক পুলিশ বাহিনী , র্যাফ কমব্যাট ফোর্স থাকা স্বত্ত্বেও টানটান উত্তেজনায় গ্রামবাসীদের মতোই তাদেরও প্রতিটি মুহুর্ত উদ্বেগ আর অজানা আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছিল। আচমকা গুড়ুম - গুড়ুম শব্দে কেঁপে ওঠে গ্রাম। সচকিত হয়ে সে দেখতে পায় গণমঞ্চের লোকেরা বোমাবাজি আর বন্দুক , কামান দাগতে দাগতে গ্রামের দখল নিতে নেমে পড়েছে। তাদের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে অরুণোদয় পার্টির কর্মী সমর্থকরা। গ্রামে তখন গণমঞ্চের লোক ছাড়া কাউকে দেখা যায় না। সেইসময় একের পর এক জ্বলতে শুরু করে অরুনোদয় পার্টির লোকেদের বাড়িঘর , ধানের পালুই। শাসকদলের লোকেরা কামান দেগে ওইসব বাড়ি-ধানের পালুইয়ে আগুন লাগিয়ে উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়ে।
তারপরই গণমঞ্চের লোকেরা নিজেদেরও কয়েকজন কর্মী সমর্থকের বাড়ি-খড়ের পালুই আর দলের গ্রাম কমিটির অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। ব্যাপারটা কি হলো ভেবে পায় না দেবদত্ত। নিজেরাই কেন এভাবে নিজেদের বাড়িঘর পোড়াচ্ছে ? কেন করছে তা কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য পরিস্কার হয়ে যায়। সেদিনও সংবাদ মাধ্যমকে দেখে এগিয়ে আসেন সুরঞ্জন সেনগুপ্ত। এইরকম ভাবে সংবাদ মাধ্যমকে ঘেরাও বন্দী করে নিজেদের দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পোড়াবাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান তিনি । দেখান একই রকম ভাঙচুর আর লুঠপাটের চিহ্নও। তারপর জ্বলন্ত পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন , ' দেখুন দেখি কান্ড! আমরা চাইছি সুস্থ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন। আর ওরা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য পেশির জোরে গণতন্ত্রের গলা টিপে খুন করে ক্ষমতা দখল করতে চাইছে। নিজের চোখেই তো সব দেখলেন। কতগুলো বাড়ি - ধানের পালুই ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে। কতগুলো বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে। সেইমতো জম্পেশ করে খবর করুন দেখি। '
' কিন্তু বিরোধী দলের সবাই তো গ্রামছাড়া। তারা কিভাবে আগুন লাগাবে ? কি ভাবেই বা লুঠপাট চালাবে ? তাছাড়া ওদেরই তো বেশিরভাগ বাড়ি-পালুই পুড়েছে। প্রশ্ন তুলেছিল সে।
জবাবে সুরঞ্জনবাবু বলেছিলেন, ' ওই দেখ যা ভেবেছি তাই ! সব উল্টো বুঝেছে। আরে ভাই , এসব হচ্ছে রাজনীতির খেলা। আমাদের বাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ হালকা করার জন্য ওরাই নিজেদেরগুলোও পুড়িয়েছে। '
' কিন্তু যারা ওসব করছিল তারা তো আপনাদের দলেরই শ্লোগান দিচ্ছিল। ওদের কারও কারও হাতে আপনাদের দলের পতাকাও ছিল। '
' ওটাই তো হচ্ছে ওদের কায়দা। আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্যই ওরা আমাদের পতাকা - শ্লোগান ব্যবহার করেছে।'
সেদিন সুরঞ্জনবাবুর ব্যাখ্যা শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিল তারা। দেবদত্ত মনে মনে ভেবেছিল, একেই বলে কুটনৈতিক ব্রেন। কোথাকার জল কোথায় মেরে দিলেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েও কেমন ঠান্ডা মাথায় কথাগুলো সাজিয়ে পরিবেশন করলেন। মনে হচ্ছিল যেন কথাগুলো ব্রেনের চিপসে লোড করাই ছিল। সুরঞ্জনবাবুদের পরিকল্পনা অবশ্য ষোল আনাই সার্থক হয়েছিল সেদিন। ঘটনাস্থলেই অরুনোদয় পার্টির লোকেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন সুরঞ্জনবাবুরা। অরুণোদয় পার্টির লোকেরা পাল্টা অভিযোগ করবেন কি , পুলিশী ধরপাকড়ের ভয়ে আর গ্রামে ঢুকতেই পারে নি। আর সেই সুযোগে একচেটিয়া ছাপ্পা ভোট করে নেয় শাসকদলের লোকেরা। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। নিজের ভালোর জন্য মানুষ অন্যের ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু অন্যের ক্ষতির জন্য যে নিজের ক্ষতিও করতে পারে তা বোধহয় ওই ঘটনা চোখের সামনে না দেখলে অজানাই থেকে যেত।
সৌমেনের কথায় সম্বিত ফেরে দেবদত্তের। সে বলে , ' কি দাদা রূপাসা যাবে না ? আর দেরি করলে তো কবর হয়ে যাবে। ছবি পাব না। '
' হ্যা- হ্যা , চলো বেরিয়ে পড়ি এবার। '
মোটরবাইকে ওঠার আগে সুরঞ্জনবাবু এগিয়ে এসে ঘাড়ে হাতে রেখে বলে , ' আমাদের কথাটা মনে থাকে যেন। খবরটা যেন ঠিকঠাক হয়। '
No comments:
Post a Comment