শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ৫ )
জাহেদা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন স্বয়ং অঞ্জনা রায়। ততদিনে মুন্সীদের টিভির দৌলতে অঞ্জনা রায় জাহেদার কাছে পরিচিত মুখ। তাকে কাছে পেয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না সে। তার হাত দুটি জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে , ' মা তুমিও অতদুর থেকে ছুটে এসেছো আমাদের কাছে ? '
অঞ্জনা রায় বলেন , ' আসব না ? হার্মাদরা আমার এগারো জন জোয়ান ভাইকে খুন করল , আর আমি কি তোমাদের কাছে না এসে থাকতে পারি মা ? '
' আমাদের কি হবে মা ? একমাত্র ছেলে চলে গেল , কে দেখবে আমাদের ? '
' তুমি কিছু চিন্তা কোর না মা , আমরা তো আছি। তোমার এক ছেলে চলে গিয়েছে , তাকে তো আর ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু চেয়ে দেখো , তোমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কত সন্তান। আজ থেকে তুমি আমাদের মা। আমরা যতদিন থাকব , আমাদের দল যতদিন থাকবে ততদিন তুমি আমাদের কাছে শহীদের মা হয়ে থাকবে। কোনদিন কোন অমর্যাদা হতে দেব না মা তোমার।'
শুনতে শুনতে চোখের জল বাঁধ মানে না জাহেদার। আবেগে গলা বুজে আসে তার। কোন কথা বলতে পারে না সে। বিস্মিত দৃষ্টিতে অঞ্জনার দিকে চেয়ে থাকে থাকে । এমন করে কথা কেউ তো কোনদিন বলে নি তাকে। অঞ্জনার রায়ের কথাগুলিই তাকে ছেলে হারানোর শোক কিছুটা সামলে ওঠার ক্ষমতা দেয়। আর তাকে একটু সামলে উঠতে দেখেই ঘিরে ধরে সাংবাদিকের দল। সেইসময় সৌমেনকে নিয়ে সেখানে পৌঁছোয় দেবদত্ত। সে মুখ খোলার আগেই অন্যান্য সাংবাদিকরা জাহেদার উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয় ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্নবাণ। কেউ জানতে চান , ' ছেলে কতদিন ধরে পার্টি করত ? '
কেউ বা প্রশ্ন করে , ' সাতসকালে তিন কিমি দুরের মাঠে সে কি করতে গিয়েছিল ? তাকে খুন করা হল কেন ? '
অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও মুখে কিছুই বলতে পারে না জাহেদা। কারণ রানা হাসপাতালেই এক ফাঁকে তাকে কারও কাছে মুখ খুলতে বারণ করে দিয়েছিল। পই পই করে বলে দিয়েছিল কি বলতে হবে তা দলনেত্রী এসে শিখিয়ে পড়িয়ে দেবেন। কিন্তু কই অঞ্জনা তো এখনও তাকে কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন না। তাহলে কি বলবে সে সাংবাদিকদের ? সে যা জানে তাই বলে দেবে নাকি ? খুব দোটানায় পড়ে যায় জাহেদা। রানাই এসে তাকে উদ্ধার করে। তাকে সাংবাদিকদের ঘিরে ধরতে দেখে ছুটে আসে রানা।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে সে বলে , ' আপনার কি কসাই নাকি ? দেখছেন একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মায়ের ওই অবস্থা , তারমধ্যেও আপনারা এই রকম জেরা করছেন ? দলনেত্রী রয়েছেন , যা বলার তিনিই বলবেন। চলুন--চলুন দিদির কাছে চলুন।'
তার কথাতেই কাজ হয়। সাংবাদিকরা রেহাই দেয় জাহেদাকে। এইরকম কথা বহুবার দেবদত্তকেও শুনতে হয়েছে। সত্যি বলতে কি ওইরকম পরিস্থিতিতে তার নিজেরও কেমন যেন কসাইয়ের মতোই লাগে। তাদের কাজের ধারাটাই এমন। অনেক সময় গ্রামের লোক কিম্বা পাড়া-পড়শিদের কাছে সব কিছু জানার পরও সদ্য সন্তান হারা বাবা-মা কিম্বা স্বামী হারা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে হয় , 'কি হয়েছিল বলুন তো ? বলতে হয়, ' মৃতের একটা ছবি পাওয়া যাবে ? এমনিতেই তো প্রিয়জন হারানোর শোকে কথা বলার মতো অবস্থা থাকে না তাদের। তার উপরে একের পর এক ওই ধরণের প্রশ্ন শুনতে শুনতে আরও শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন পরিবারের লোকেরা। তাও তাদের কাজটা করতে হয়। খবরের ক্ষেত্রে মৃতের ছবি , বাবা মায়ের বক্তব্য নাকি আলাদা মাত্রা এনে দেয়। সেই মাত্রা যোগ করতেই বছরের পর বছর ধরে অমানবিক কাজগুলো করে চলে তারা। খবর প্রকাশের ব্যাপারে মৃতের পরিবারের কোন আগ্রহ থাক বা না'ই থাক , বাড়তি মাত্রা যোগ করার চেষ্টা করতেই হয়। সব থেকে সমস্যা হয় সাপে কাটা , জলে ডুবে মৃত্যুর মতো ঘটনায়। ওইসব মৃত্যুর ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা কিম্বা আর্থিক সংকটের জন্য বহু হতদরিদ্র পরিবার ময়না তদন্তের ঝামেলায় যেতে চান না। গ্রামের শ্মশানেই দাহ করে দেওয়ার প্রবণতা থাকে অনেকের। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকদের নিয়েই যত দুশ্চিন্তা থাকে পরিবারের লোকেদের। আর তা নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সাংবাদিকদের। সে নিজেই কতবার ওইরকম পরিস্থিতিতে পড়েছে তার ঠিক নেই। বছর কয়েক আগে তাদের গ্রামেই সাপে কেটে একটি বাচ্চা ছেলের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে সে দেখতে গিয়েছিল। পাড়ার লোকেরা তখন ছেলেটিকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করছিল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তখন ঘন- ঘন মুর্ছা যাচ্ছিল ছেলেটির বাবা-মা। তাকে দেখে চাপা উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে। ওই অবস্থার মধ্যেই ছেলের মৃতদেহ ফেলে বাবা উঠে এসে তার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিল , ' দোহাই ভাই , তুমি আর এটা নিয়ে লেখালিখি কোর না। বুঝতেই তো পারছ সব। যে চলে গিয়েছে তাকে তো আর ফিরে পাব না। তুমি লিখে দিলে দেহ ময়না তদন্তে পাঠাতে হবে। ওইটুকু ছেলেকে কাঁটাছেড়া করবে , সেটা সইতে পারব না। তাছাড়া আমার অবস্থার কথা তো জানো। ময়নাতদন্তের পর দেহ ফিরিয়ে আনার মতো আর্থিক সঙ্গতিও আমার নেই। '
সেদিন ওই কথা শুনেও নিজেকে কসাই মনে হয়েছিল। পাড়ার ছেলের মৃত্যুতে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে যাওয়ারও উপায় তার নেই। সেদিন ছেলেটির বাবাকে সান্ত্বনাও দিতে পারে নি। তার হাত দুটো একটু নেড়ে দিয়ে দ্রুত মাথা নিচু করে চলে এসেছিল। অন্য কোন মিডিয়া খররটা করে দিলে সে'ই বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন হয়ে যাবে। তাই সৎকার না হওয়া পর্যন্ত আশঙ্কায় সিটিয়ে ছিল ।আর একবার তো আরও অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। সেবারে পাশের গ্রামের পরিচিত এক ব্যক্তির বাচ্চা মেয়ে স্নান করতে গিয়ে জল ডুবে গিয়েছিল। অন্যান্যদের মতো সেও শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ছুটে গিয়েছিল। সেখানেও তখন মেয়েটির সৎকার করার তোড়জোড় চলছিল। দূর থেকে তাকে দেখে শ্মশানযাত্রীরা বলে ওঠে , ' অ্যাই রে শালা খোচড়টা চলে এসেছে। দেখ আবার খবর - টবর করে দেবে কিনা। তাহলে হয়রানির শেষ থাকবে না।'
গলা নামিয়ে বললেও কথাগুলো তার কান এড়ায় নি। তাই আর এগোয় নি সে। মাথা নিচু করে ফিরে আসে। সেদিনই তার মনে হয়েছিল , পেশা তাদের কোন জায়গায় পৌঁচ্ছে দিয়েছে। সে নিজেও যেক্ষেত্রে মৃত্যুর পিছনে কোন রহস্য নেই সেক্ষেত্রে ময়না তদন্তের চেয়ে বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখারই পক্ষপাতী। কিন্তু তার উপরে তো আর কিছু নির্ভর করে না।রানার কথায় এক লহমায় সেইসব ঘটনাগুলো মনে পড়ে যায় দেবদত্তর। সাংবাদিকদের স্কুলে যেতে বলে জাহেদা নিয়ে চলে যায় রানা। স্কুলে তখন দলের নেতা নেত্রীরা ক্যাম্প করে রয়েছেন। সাংবাদিকদের বাইরে বসিয়ে রেখে জাহেদাকে স্কুলেরই একটি ঘরে ভিতরে নিয়ে যায় রানা। সেই ঘরেই বসেছিলেন রয়েছেন দলের নেতা নেত্রীরা। অঞ্জনা রায় জাহেদাকে পাশে বসিয়ে গলা নামিয়ে বলেন , 'শোন সংবাদ মাধ্যম তোমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে পারে। আমরা বলেছি, সুরবান আমাদের পার্টি মেম্বার ছিল। সেইজন্য বিরোধী পার্টির লোকেদের ওর উপর রাগ ছিল। সেই আক্রোশে কাল যখন ও মুনিস খাটতে গিয়েছিল তখন ওরা তাকে পিটিয়ে মারে। তুমিও কিন্তু গুছিয়ে ঠিক এই কথাই বলবে। দেখো উল্টোপাল্টা হয়ে যায় না যেন। তাহলেই সব ম্যাসাগার হয়ে যাবে।
অঞ্জনার কথাগুলো শুনে কেমন যেন ' থ ' হয়ে যায় জাহেদা। পুরোটা না জানলেও ঘটনাটা যে পুরোপুরি তা নয় সেকথা এখন আর জানতে বাকি নেই তার। ততক্ষণে কানাঘুষোয় আসল ব্যাপারটা তো তার জানা হয়ে গিয়েছে। পার্টির কিছু লোকের মুখেই তো সে শুনেছে , উঁচপুরের এক জোতদারের জমি নিয়েই বিরোধটা বাঁধে। জোতদারকে ভাগ না দিয়ে নাকি তার জমির সমস্ত ফসল লুটেপুটে খাচ্ছিল বর্গাদার আর গণমঞ্চ পার্টির নেতারা। জোতদার বর্গাদার হঠিয়ে জমি দখল মুক্ত করার জন্য ধরেছিলেন মুকিম , রানাদের। মোটা টাকার বিনিময়ে তাদের সঙ্গে জমি দখলমুক্ত করে দেওয়ার চুক্তি করে জোতদার।সেইজন্যই ওরা কাল সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে বলে গিয়েছিল , উঁচপুরে ঘণ্টা তিনেক করে ধান কেটে দিলে নগদ পাঁচশো টাকা করে মজুরি দেওয়া হবে। সেই লোভনীয় প্রস্তাব হাতছাড়া করেনি সুরবান। সারা দিনমান কাজ করেও যেখানে একশো টাকা রোজগার হয় না , সেখানে বোকা ছাড়া ওই প্রস্তাব কেই'বা ফেরাবে ? কিন্তু মাঠে গিয়েই মালুম হয় কি ভুল তারা করেছে। জমির দখল ধরে রাখতে গণমঞ্চেরও তখন মরীয়া। সুরবানরা জমির আলে পা দিতেই রে-রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। শুরু হয়ে গোলাগুলির লড়াই। অবস্থা বেগতিক দেখে রানারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। পালাতে পারে না কেবল নিরস্ত্র সুরবানরা। প্রাণ ভয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় তারা। আর তাদের ডাকাত বলে নৃশংসভাবে পিটিয়ে , পাথর দিয়ে থেঁতলে খুন করে গনমঞ্চের লোকেরা।
কথাগুলো শোনার পর থেকে রানাদের সহ্য করতে পারছে না জাহেদা। রানাদের লোভেরই শিকার হতে হলো এগারো জন নিরপরাধ মানুষকে। অঞ্জনার কথা শুনেও বিস্মিত হয়ে যায় সে। সুরবানকে পার্টি মেম্বার হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে অঞ্জনা। কিন্তু তা তো নয়। ওর তো সবে গোঁফ গজালো। নেতাদের জমি দখলের অভিসন্ধির কথাও বিন্দুবিসর্গ জানত না। অভাবের সংসারে দুটো বাড়তি টাকা আসবে বলেই ও ধান কাটতে যেতে রাজী হয়েছিল। তখন তো আর জানা যায়নি তাদের জীবন বাজি রেখে কত মোটা টাকার দাঁও মেরেছিলেন নেতারা। জানলে কি আর জাহেদাই ওকে যেতে দিত ? ওইসব কথা ভেবেই অঞ্জনার মুখের দিকে তাকায় জাহেদা। মনে মনে ভাবে এখনও ছেলের মাটি হয় নি। মিথ্যা বলাটা কি ঠিক হবে ?
সম্বিৎ ফেরে রানার কথায়। সে বলে , ' দিদি যা বলছেন সাংবাদিকদের কাছে তুমি তাইই বলবে। তাতে তোমাদের ভালোই হবে। 'অগ্যতা শেখানো বুলিই আউরাতে হয় জাহেকে। কারণ সে বুঝে গিয়েছে এখন থেকে যে ওদের দয়াতেই বেঁচেবর্তে থাকতে হবে তাদের। সে যে ওদের দলের শহিদের মা। ছেলের জন্য আরও একবার গর্বে বুকটা ভরে ওঠে তার।
No comments:
Post a Comment