শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ৬ )
কথাটা শুনে বুকটা ভরে ওঠে প্রধান সাহেবের মা সাইফুন্নেসা বিবিরও। তাকেও তো সেদিন একই কথা বলেছিলেন অরুণোদয় পার্টির লোকেরা। অহরহই বীভৎস সেই রাতটার কথা মনে পড়ে তার। বেশিদিনের কথা তো নয় , মাস ছয়েক আগেই তার বাড়ির উঠোনেও উপছে পড়েছিল ভীড়। অঞ্জনা আসতে পারেন নি। কিন্তু সুকুলবাবুরা সবাই এসেছিলেন। গণমঞ্চের প্রবল পরাক্রমের দিনেও তার মেজছেলে মিনহাজ ভোটার হওয়ার পর থেকেই বিরোধী দল একত্র পার্টির টিকিটে পঞ্চায়েতে জিতে আসছে। দু-দু'বার প্রধানও হয়েছে। এলাকার লোকের হায়দায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেইজন্য এলাকার মানুষ তাকে ভালোবেসে প্রধান সাহেব বলে। সেই ভালোবাসাটাই যেন জ্বালা ধরিয়ে দেয় গণমঞ্চের লোকেদের গায়ে। এলাকার রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতানোর জন্য বারবার তার উপরে হামলা চালায় তারা। মিনহাজ নিজস্ব দক্ষতায় সেইসব আক্রমণ প্রতিহত করে।কিন্তু সেদিন রাতে আর চক্রান্তটা ধরতে পারে নি। ওদের পাতা ফাঁদেই পা দিয়ে ফেলে। ততদিনে একত্র পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে অরুণোদয় পার্টি গঠন করেছেন অঞ্জনা রায়। অঞ্জনার অন্ধ অনুগামী মিনহাজও দল বদল করে অরুণোদয় পার্টিতে যোগ দেয়। তার সঙ্গে আরও অনেকে অরুনোদয় পার্টিতে নাম লেখায়। সেই আক্রোশে একত্র পার্টির লোকেরাও নাকি মিনহাজকে শায়েস্তা করার জন্য গোপনে গণমঞ্চের নেতাদের মদত যোগায়। তারই বর্হ্বিপ্রকাশ ঘটে সেদিন রাতে।
গ্রাম জুড়ে তখন উৎসবের আমেজ। কয়েকদিন পরেই ঈদ। পরবের ছুটিতে বাড়ি এসেছে মেজছেলে ইনতাজ। ইনতাজ সেনাকর্মী। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর ট্রেনিং শেষে প্রথম বাড়ি এল। তার বিয়ের যোগাযোগ চলছে। ছুটির মধ্যে পাকা দেখা সেরে বিয়ের কথা চূড়ান্ত করে ফেলতে চাই সাইফুন্নেসা। তাই পরিবারে খুশীর অন্ত নেই। সবাই রোজা রেখেছে। খুশীর ঈদের জন্য দিন গোনে তারা। কিন্তু ঈদের চাঁদ আর দেখা হয় না তাদের। নেমে আসে যেন অমানিশার ঘোর অন্ধকার। রাত্রি তখন দেড়টা হবে। যে যার ঘরে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সাইফুন্নেসার। কান খাড়া করে শুনতে অপরিচিত কণ্ঠস্বর , ' প্রধানসাহেব, আমরা থানা থেকে আসছি। বিশেষ দরকার আছে। দরজাটা খুলুন। 'থানার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ওঠে সাইফুন্নেসার। এত রাতে পুলিশ কেন ভেবে পায় না সে। পরক্ষণেই মন হয় , এলাকায় ঝামেলা ঝঞ্ঝাট তো লেগেই রয়েছে , হয়তো সেই ব্যাপারেই কোন কিছু জানার জন্য এত রাতে পুলিশ ছুটে এসেছে। হাজার হোক মিনহাজ তো প্রধান বটে।যাক তবু পুলিশ এসেছে। শত্রুরা এসে কড়া নাড়ে নি , এই ঢের ভালো। সেই ভেবে নিশ্চিন্তে পাশ ফেরে শোয় সে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই শুনতে পায় মিনহাজের আর্তনাদ।
দরজা খুলেই ' আব্বা গো ' বলে চেঁচিয়ে ওঠে সে। ছেলের সেই আর্তনাদ শুনে ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছে রমজান আলিও। তড়িঘড়ি স্বামী-স্ত্রী নীচে নেমে আসে। দরজা খুলেই হাড়হিম হয়ে যায় তাদের। চোখের সামনেই পুলিশের পোশাক পড়া একদল লোককে মিনহাজের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে তারা। মিনহাজ কি এমন অপরাধ করেছে যে পুলিশ রাতের পর বাড়িতে এভাবে চড়াও হল ? ভেবে কিছু কুলকিনারা পায় না সাইফুন্নেসা। কিছুক্ষণ পরেই তার ভুল ভাঙে। লোকগুলো তখন মিনহাজের বুকের দিকে বন্দুক তাক করে বলে , ' শালা নেতা হওয়ার খুব শখ হয়েছে না ? আজ তোর নেতাগিরির শখ জনমের মতো মিটিয়ে দিচ্ছি দাঁড়া। '
ওই কথা শুনে তখন ভয়ে সাইফুন্নেসা যেন পাথর হয়ে যায়। তার আর বুঝতে অসুবিধা হয় না পুলিশের পোশাক পড়া লোকগুলো আসলে গণমঞ্চের লোক।তাদের সঙ্গে তখন মিনহাজ একাই সমানে লড়ে যাচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য বন্দুকের নল অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে সে। ঘটনার আকস্মিকতায় কাউকে ডাকতেও ভুলে যায় সাইফুন্নেসা। সে ছুটে গিয়ে লোকগুলোর পায়ে জড়িয়ে ধরে বলে , ' লক্ষ্মী বাপ আমার , মিনহাজ কোন দোষের দোষী নয়। দোহাই তোমাদের , ওকে তোমরা মেরো না। এবার থেকে তোমরা যা বলবে তাই শুনবে। আর ও পার্টি করবে না। '
লোকগুলো সেই কথা কানে তোলে না। পা ঝাঁকড়ে সান বাঁধানো মেঝেয় তাকে ফেলে দিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে , ' চোপ হারামজাদী , তোর ব্যাটাকে অনেকবার সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু কথা কানেই তোলে নি। আজ নিকেশ করে তবেই ছাড়ব। '
যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সাইফুন্নেসা দেখতে পায় মিনহাজকে বাঁচাতে স্বামীও লোকগুলোর মাঝে গিয়ে পড়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে লোকগুলো শাবল দিয়ে সজোরে বাপ-ছেলের মাথায় বাড়ি মারে। আর্ত চিৎকার করে দু'জনে পড়ে যায়। গলগল করে রক্তে ভেসে যায় সান বাঁধানো মেঝে। ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ইনতাজ সহ বাড়ির অন্যান্য লোকেরা। ইনতাজ এসেই লোকগুলোর হাত থেকে শাবল কেড়ে নিয়ে ওদের ছত্রভঙ্গ করে ফেলে। তারপর দু'জনকে বগলদাবা করে আটকানোর চেষ্টা করে। তাদের ছাড়াতে লোকগুলি প্রথমে ইনতাজের হাতে ছুড়ি চালায়। তাতেও কাজ না হওয়ায় মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। ইনতাজের মাথার ঘিলু ছিটকে গিয়ে লাগে দেওয়ালে। তারপর বোমা ফাটাতে ফাটাতে পালিয়ে যায় ওরা। দেওয়ালের সেই দাগটা আজ আর নেই। কিন্তু বুকের ভিতর সেটা জনম দাগ হয়ে আছে। দেওয়ালটা দেখলেই তার চোখের সামনে ছবির মতো সব ভেসে ওঠে। গোলাগুলির শব্দে কিছুক্ষণ পরেই ছুটে আসেন গ্রামের লোকজন। তারাই তিন বাপ ব্যাটাকে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মিনহাজ আর তার বাবাকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। বিকালের দিকে ইনতাজের মৃতদেহ নিয়ে ফেরেন সুকুলবাবুরা।
সেদিন ছেলের মৃতদেহ সৎকারের পর সুকুলবাবু তার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন , ' মা গো , তোমার ছেলে এ জেলার প্রথম শহীদ। তুমি তো শহীদের মা। দলের জন্য তোমাদের এই আত্মত্যাগ আমরা কোনদিন ভুলব না। '
আজ অঞ্জনার কথা শুনে সেইসব কথাই ঘুরেফিরে মনে পড়ে সাইফুন্নেসার। অঞ্জনারা আসছেন শুনে মিনহাজের সঙ্গে সেও এসেছিল দেখা করতে। শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে সান্ত্বনা দিতে। মাস ছয়েক আগেই তো তাকেও এই দিনটা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। তাদের দেখে কাছে ডেকে নেন অঞ্জনা। তার হাত ধরে কুশল বিনিময় করেন। অঞ্জনার কথা শুনে মনটা শান্ত হয় তার।ওদের দেখে এগিয়ে যায় দেবদত্তকেও। ইনতাজ খুনের দিন তো বটেই , তারপরেও বেশ কয়েক বার ওই গ্রামে ছুটে গিয়েছে দেবদত্ত। কখনও গণমঞ্চ পার্টির লোকেরা ওদের পরিবারের মেরেধরে গ্রাম ছাড়া করে দিয়েছে। কখনও আবার অরুণোদয় পার্টির রাজ্য নেতারা এসে ঘরে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৌমেনকে নিয়ে ছুটে গিয়েছে দেবদত্ত। সেই সুবাদে ওই পরিবারের সবার সঙ্গে চেনাশোনা হয়ে গিয়েছে তার। তাই সে এগিয়ে গিয়ে সাইফুন্নেসাকে জিজ্ঞেস করে , ' কি চাচী , ভালো আছেন তো ? '
জবাবে বিষন্ন গলায় সাইফুন্নেসা বলেন , ' আমরা কেমন আছি তা তো তোমার অজানা নেই বাপ। বাড়িতে পুরুষমানুষ না থাকলে মেয়েরা কি শান্তিতে থাকতে পারে ? '
কথাটা দেবদত্তরও অজানা নয়। গণমঞ্চের লোকেদের দাপটে অরুনোদয় পার্টির লোকেদের প্রায়ই গ্রাম ছাড়া হয়ে থাকতে হয়। সে নিজের চোখেই দেখে এসেছে জনমানব শুন্য হয়ে পড়ে রয়েছে বহু বাড়ি। দরজা - জানলা ভাঙা ওইসব বাড়ির সর্বত্র লুঠপাটের চিহ্ন। বহু বাড়িতে মাসের পর মাস ঝাড়ানো হয় নি পালুইয়ের ধান। জল পেয়ে ওইসব পালুয়ের মাথায় ধানের গাছ গজিয়ে গিয়েছে। সব জেনেও 'কুশল' প্রশ্নটা করে অস্বস্তিতে পড়ে যায় দেবদত্ত।সাইফুন্নেসাই তাকে ওই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে। তিনি বলেন , ' তবু বাপ তোমরা ছিলে বলে বাড়ির চাল ছপ্পড়টুকু এখনও আছে। তোমরা যেন আমাদের একটু দেখো বাপ। 'সাইফুন্নেসার কথা শুনে মন থেকে অস্বস্তিকর ভাবটা দুর হয়ে যায় দেবদত্তর। মনে এক প্রশান্তি বিরাজ করে। মনে মনে ভাবে , এই লাইনে গালাগালিও যেমন শুনতে হয় , তেমনই ভালোবাসাও পাওয়া যায়। তারা আর কতটুকুই বা পাশে থাকতে পারে ? তাদের হাত তো এমন কিছু লম্বা নয়। খবর করা বই তো কিছু করতে পারে না। কিন্তু তার জন্য দুর্গত মানুষের মুখে ভরসাস্থল হওয়ার কথা শুনলে একটা অন্যধরণের অনুভূতি হয় বৈকি ! সেই অনুভূতি তি থেকেই সে বলে , 'কোন দুঃশ্চিন্তা করবেন না চাচী। আমরা আপনাদের পাশে আছি। '
তখনই ঘরের ভিতরে সাংবাদিকদের ডেকে পাঠান অঞ্জনা রায়। সাইফুন্নেসাদের কাছে বিদায় নিয়ে অন্যান্য সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছোয় সে। ততক্ষণে অঞ্জনা রায় সাংবাদিকদের কি বলবেন তা নিয়ে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে। তার মধ্যেই সৌমেন মজা করে বলে , ' দিদি যাই বলুন না কেন , সেই কথাটা কিন্তু এখানেও বলবে দেখো। তোমরা এখন থেকে লিখেও নিতে পারো। '
কৌতুহলী হয়ে সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করে , ' কোন কথাটা বস ? '
' সেই যে গো সব জায়গায় যে কথাটা বলেন , ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির কথা।
সৌমেনের কথা শুনে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে সবার মুখে। ঘরে ঢুকেই সাংবাদিকরা জাহেদাকে প্রশ্ন করার উপক্রম করতেই অঞ্জনাদেবী জোর হাত করে বলেন , 'দোহাই আপনাদের বুঝতেই তো পারছেন একমাত্র ছেলের এখনও মাটি হয় নি , এই পরিস্থিতিতে মায়ের মনের অবস্থা কেমন হয় ! প্লিজ ওনাকে বেশি প্রশ্ন করবেন না। যতটুকু না হলে নয় , ততটুকুই করবেন। তারপরও যদি কিছু জানার থাকে আমাকে বলবেন আমি আপনাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেব। '
সেই কথা শুনে সাংবাদিকরাও আর জাহেদাকে বিশেষ প্রশ্ন করে না। তারা অঞ্জনাকেই বলে , ' ঠিক আছে দিদি যা বলার আপনিই বলুন। '
দুই বিশ্বস্ত অনুচর সুকুল আর রণজয়কে দু'পাশে ডেকে নিয়ে অঞ্জনাদেবী বলতে শুরু করেন , ' সুরবান সহ এগারোজনই আমাদের দলের সক্রিয় কর্মী ছিল। সবাই খেতমজুর। একদিন না খাটলে কারও পেটের ভাত জুটত না। পেটের দায়েই ধান কাটতে গিয়েছিল। গণমঞ্চ পার্টির নেতা সুরঞ্জন সেনগুপ্তের নেতৃত্বের ওদের নৃশংসভাবে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। '
' কিন্তু দিদি, সুরঞ্জনবাবুরা যে বলছেন ওরা সব ডাকাত। ডাকাতি করতে ঢুকেছিল গ্রামে। তারপর নাকি ধরা পড়ে গণপ্রহারে মৃত্যু হয়েছে। '
' মিথ্যা কথা , দুরাত্মার তো ছলের অভাব হয় না। কিন্তু আমরাও সত্যিটা কি , তা প্রমাণ করে ছাড়ব। '
অঞ্জনাদেবী থামতেই সাংবাদিকরা সবাই সৌমেনের দিকে তাকায়। ইঙ্গিতটা আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না সৌমেনের। তার করা ভবিষ্যৎ বানী মিথ্যা হতে যাচ্ছে দেখে মরীয়া হয়ে সে প্রশ্ন করে , ' দিদি আর কিছু বলবেন না ? '
' নিশ্চয়। এই সরকার আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ। তাই আমরা কেন্দ্রের কাছে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে এই সরকারকে পদচুত্য করে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি জানাব। '
অঞ্জনাদেবীর কথা শেষ হতেই মৃদু হাসি ফুটে ওঠে সাংবাদিকদের মুখে। অঞ্জনাদেবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসে সবাই। বাইরে এসে সৌমেন বলে , 'কি মিলল তো আমার কথা ? ' সাংবাদিকরা বলে , ' একদম , হান্ড্রেড পার্শেন্ট বস। কথাটা শুনে শুনে কান পচে গেল। উনি নিজেও জানেন ব্যাপারটা অত সহজসাধ্য নয়। তবু বার বার কেন যে একই দাবি করেন কে জানে ? ' দেবদত্ত বলে , ' উনি অসাধ্য সাধন করতে জানেন বলেই হয়তো বলেন। '
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment