শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ৭ )
অঞ্জনা রায় যে অনেক সময় অসাধ্য সাধন করতে পারেন সে প্রমাণ কিছুক্ষণে পরেই পান রূপসা গ্রামের মানুষজন। ততক্ষণে স্কুলবাড়িতে অন্যান্য শহীদ পরিবারের লোকেরাও হাজির হয়েছেন। সংবাদিকরা চলে যেতেই পুলিশ তাদের জেরা শুরু করে। সর্বাগ্রে জাহেদাকে নিয়ে পড়ে তারা। জাহেদা যতই অঞ্জনার শেখানো কথাগুলো বলে জেরার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা করে পুলিশেরাও তত তাকে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে নাজেহাল করে তোলে। আর তাই দেখে থাকতে না পেরে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন অঞ্জনা। পুলিশকে ধমকে ওঠেন তিনি। রীতিমতো ধমকের সুরে বলেন , ' আচ্ছা লোক তো মশাই আপনারা। আপনাদের বাড়িতেও কি মা--বাবা নেই ? দেখছেন সদ্য ছেলেকে হারিয়ে কথা বলার অবস্থায় নেই মানুষটা। আর আপনারা সমানে ওকে খুঁচিয়ে যাচ্ছেন ? '
সেই কথা শুনে একজন অফিসার হাত কচলে কোন রকমে আমতা আমতা করে বলতে শুরু করেছিলেন , 'বোঝেনই তো ম্যাডাম এটা আমাদের রুটিন ডিউটি ---।'
কথা শেষ হয়না ওই পুলিশকর্তার। ফের গর্জে ওঠেন অঞ্জনা , ' আমাকে কিছু বোঝাতে আসবেন না। সব বুঝি আমি। ওনার যা বলার তা তো বলেই দিয়েছেন। কিন্তু ওই বয়ান কেন আপনাদের মনোঃপুত হচ্ছে না তা আমি বুঝি না ভাবেন? আসলে ওই বয়ানে কেস সাজালে আপনাদের রাজনৈতিক দাদারা বেজায় চটে যাবেন তাই না ? তাই তাদের মনোমত কেস সাজাতে নিহতের পরিবারের লোকেদের দিয়ে আপনারা যা খুশী বলিয়ে নেবেন ? '
ফের ওই পুলিশ অফিসার মুখ খোলার উপক্রম করেতেই অঞ্জনা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন , 'একটা কথা স্পষ্ট করে শুনে রাখুন , 'আমার নামও অঞ্জনা রায়। একটু বেচাল দেখলে কিন্তু ছেড়ে কথা কইব না। '
অঞ্জনার কথার তোড়ে খেই হারিয়ে ফেলেন পুলিশকর্তারা। অঞ্জনা অবশ্য থামেন না। দাপুটে গলায় সুকুলবাবুকে উদ্দশ্যে বলে ওঠেন, ' সুকুলদা এদিকে আসুন তো। এইসব পুলিশ অফিসারদের নামগুলো ওদের উর্দির নেমপ্লেট দেখে নোট করে রাখুন। কলকাতায় গিয়ে আমায় দেবেন। কিছু লাভ হবে না জানি। তবুও একবার বিধানসভার স্পিকারকে জানাব। কোন সাড়া পেলে ভালো , নাহলে দিল্লিতে সংসদে তুলোধোনা করে ছেড়ে দেব। '
তার ওই রণংদেহী মুর্তি দেখে এবার পুলিশকর্তারা বিগলিত গলায় বলেন , ' ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনি কি বলতে চাইছেন বলুন ? '
' আমি কিছু বলতে চাইছি না। যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন তারাই বলছেন , আমাদের দল করত বলে গণমঞ্চের নেতা সুরঞ্জন সেনগুপ্তের নেতৃত্বে হার্মারা ওদের নৃশংস ভাবে খুন করেছে। '
' কিন্তু ম্যাডাম, সুরঞ্জনবাবু আগেই অভিযোগ করেছেন যে ওরা গ্রামে ডাকাতি করতে ঢুকেছিল। তারপর ধরা পড়ে গণপ্রহারের শিকার হয়। ডাকাতি করে পালিয়ে এসেছিল এমন আরও কয়েকজনের নামে অভিযোগ করেছেন উনি। এরপর তো আর আমরা খুনের অভিযোগ নিতে পারবো না। '
' বাহঃ এর মধ্যেই গল্প সব জানানো হয়ে গিয়েছে ? জানতাম হবেই। বেশ , শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি খুনের অভিযোগ নেবেন কি না ? '
' ম্যাডাম বললাম তো আপনাকে , খুনের অভিযোগ আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। বোঝেনই তো সব আমাদের উপরতলার নির্দেশ মেনে চলতে হয়। '
' সেটা আমি ভালোই জানি। আপনাদের উপরতলাকে কি করে নাকানিচোবানি খাওয়াতে হয় তাও আমার অজানা নেই। আমি ডাকলে সারা রাজ্য থেকে কাতারে কাতারে লোক চলে আসবে। তখন আপনার উপরতলার কর্তারা সামাল দিতে পারবেন তো ? '
' সে উপরতলার কর্তারা বুঝবেন। আমাদের যেতে দিন। '
' মামার বাড়ির আবদার আর কি ? যেতে দিন বললেই হলো ? ওদের নামে খুনের অভিযোগ না লিখলে এই গ্রাম থেকে আপনাদের বেরোতেই দেব না। কই যান তো দেখি কি করে যেতে পারেন। সুকুলদা সবাই আসুন তো দেখি। '
বলেই গট গট করে স্কুলের বাইরে গিয়ে পুলিশ ভ্যানের পথ আগলে দাঁড়ান অঞ্জনা। তার দেখাদেখি সবাই হাজির হন সেখানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি সহ পুলিশ কর্মীরা ঘেরাও বন্দী হয়ে পড়েন।সেই অফিসার অঞ্জনার কাছে এগিয়ে এসে বলেন , ' গ্রামবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কাজটা কিন্তু আপনি ভালো করছেন না। এর ফল আপনাকে ভুগতে হবে। '
' অফিসার আমাকে একদম ভয় দেখাবেন না। আপনার মতো অফিসার আমার অনেক দেখা আছে। কি করবেন আপনারা ? কি করবেন , অ্যারেস্ট ? পারবেন তো ? '
' প্রয়োজনে তাই করতে হবে।' কথার টানে বলে ফেলেন অফিসার।
' আমাকে অ্যারেষ্ট করলে আপনার লক আপে জায়গা হবে তো ? সারা রাজ্য থেকে আমাদের লোকেরা এসে আপনাদের লক আপ ভরে দেবে। নিন , কই করুন তো দেখি অ্যারেস্ট! '
নিজের হাত দুটো অফিসারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন অঞ্জনা। অফিসার সেই হাতে হাতকড়া পড়ানোর উপক্রম করতেই ঝাঁপিয়ে সামনে চলে আসে অঞ্জনার সঙ্গে আসা কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর কর্মীরা। গর্জে ওঠে গোটা রূপসা গ্রাম। অঞ্জনা হাত তুলে সবাইকে নিরস্ত করে অফিসারের দিকে ফিরে বলেন , ' অফিসার আপনার জানা আছে কিনা জানি না , কিন্তু আমি যতদুর জানি একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে আপনি গ্রেফতার করতে পারেন না। আমার অবশ্য আপনি কি পারেন না পারেন তা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই , তবে আমি কি পারি তা নিশ্চয় এতদিনে আপনার অজানা নেই। '
ওই কথা শুনেই মুখটা যেন ঝুলে যায় অফিসারের। হাতের ওয়াকিটকি থেকে ঘন ঘন কারও সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। কথা শেষ করে বলেন , ' বেশ দিন আপনার অভিযোগ।'
অফিসারের কথা শুনে শোক ভুলে উচ্ছাসে ফেটে পড়েন গোটা গ্রামের মানুষ। সুকুলবাবু অভিযোগপত্র লিখে নিহতদের পরিবারের লোকেদের সই করিয়ে নিয়ে অফিসারের হাতে তুলে দেন। অফিসার সাক্ষী সাবুদ নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। গাড়ি ছাড়ার আগে অঞ্জনা অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন , 'দেখবেন খুনীদের আবার আগাম খরব দিয়ে পালানোর সুযোগ করে দেবেন না। আমি কিন্তু আবার আসব। কথাটা মনে থাকে যেন। '
অফিসার কি জবাব দেন তা গাড়ির শব্দে আর শোনা যায় না। পুলিশ কর্তাদের অঞ্জনার ধমক খেয়ে ওইভাবে রণে ভঙ্গ দেওয়া দেখে গ্রামের লোকেরা মনোবল ফিরে পায়। অঞ্জনা রায় যে অসাধ্য সাধন করতে পারেন তা নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করেন তারা। এতদিন তো হাজার অপরাধ করলেও গণমঞ্চের লোকেদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগই লেখাতে পারে নি। বরং গণমঞ্চের নেতাদের কথায় মিথ্যা অভিযোগে বহু মানুষকে ফাঁসিয়েছে পুলিশ। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে জাহেদারও। সে'ও উপলব্ধি করে সত্যিই পুলিশ শক্তের ভক্ত নরমের যম। ওই ঘটনার পর অঞ্জনার প্রতি আস্থা আরও বেড়ে যায় জাহেদার। একটি মেয়ের দাবড়ানি খেয়ে কেমন লেজ গুটিয়ে পালানোর পথ পায় না ষন্ডা মার্কা পুলিশগুলোও। আর হবে নাই বা কেন ? অঞ্জনার সঙ্গেও তো এসেছে দু'গাড়ি ভর্তি নিরাপত্তা রক্ষী। জাহেদা শুনেছে , অঞ্জনা নাকি মন্ত্রী। দেশে যেখানে যত ট্রেন চলে সবের মালিক নাকি অঞ্জনা। সে ইশারা করলেই চালু ট্রেন থেকে যাবে , আবার থেমে থাকা ট্রেন চলতে শুরু করবে। সেই অঞ্জনাই তাকে মা বলে ডেকেছে। শহিদের মা বলেছে। কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় জাহেদার। পুলিশের লোকেরা চলে যেতেই শুরু হয়ে যায় মাটি দেওয়ার প্রস্তুতি। সুগন্ধী দেওয়া জলে স্নান করানো হয় সুরবানকে। পড়ানো হয় নুতন পোশাক। কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় সুরবানকে। কাঁদতে কাঁদতে যায় জাহেদাও। সেখানে তখন একে একে আনা হচ্ছে অন্যান্য মৃতদেহ। কবরস্থানের পাশেই বাঁশবাগানে শুরু হয়েছে জানাজা নমাজের প্রস্তুতি। শেষবারের মতো ছেলের কপালে চুম্বন একে দেয় জাহেদা। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে । প্রতিবেশীরা তাকে বাড়ির দিকে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকেই জাহেদার কানে ভেসে আসে, ' আলাহু আকবর, আলাহু আকবার। আশহাদু আললা ইলাহা ইল্লাল্লাহু।'
জানাজার নমাজ শেষ হয়। এবার মাটির ভিতরে চলে যাবে সুরবান। শেষবারের মতো আর একটিবার ছেলেকে দেখে আসতে ইচ্ছা করে তার। ওই মুখ তো আর কোনদিন তো দেখা হবে না!কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটি হয়ে যায়। গ্রামবাসী, আত্মীয় স্বজনদের পাশাপাশি কবরে মাটি দেন সুকুলবাবুরাও। মাটি দিতে আসা লোকদের খাওয়ার জন্য একত্রে স্কুলেই রান্নার ব্যবস্থা করে পার্টির লোকেরা। সমবেত শোক যেন পরিবারগুলিকে একদিনেই এক ছাতার নীচে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় । খাওয়া দাওয়ার পর স্কুল চত্বরেই নিহতদের পরিবারের লোকেদের নিয়ে বসেন অঞ্জনা। সবার কথা শোনার পর তিনি বলেন , 'আপনাদের কোন চিন্তা নেই। পার্টির জন্য আপনাদের পরিবারের লোকেদের প্রাণ গিয়েছে , তাই আপনাদের পরিবারের দায়িত্ব আমাদের পার্টি নেবে। প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্যকে যোগ্যতা অনুযায়ী রেলে চাকরী দেওয়া হবে। অভিযুক্তরা যাতে উপযুক্ত সাজা পায় তার জন্যও যতদুর যেতে হয় পার্টি যাবে। নিহতেরা শহীদের মর্যাদা পাবেন। তাদের স্মৃতিতে তৈরি করা হবে শহীদবেদী। আর তাদের মৃত্যুর দিনটি প্রতিবছর শহীদ দিবস হিসাবে পালন করা হবে। '
অঞ্জনার কথা শেষ হতেই কেউ কেউ শোকের আবহ ভুলে হাততালি দিয়ে ওঠেন। অঞ্জনা কটমট করে তাদের দিকে তাকাতেই তা আর সংক্রামিত হতে পারে না। তারপরই পার্টির তরফে মৃত পরিবারগুলির হাতে কিছু করে টাকা তুলে দেন সুকুলবাবু। আর যাওয়ার আগে অঞ্জনা জাহেদাকে আলাদা করে ড়েকে আরও কিছু টাকা দিয়ে বলেন , 'কিছু চিন্তা কোর না। তোমার কথা আমার মনে থাকবে। যতদিন রেলের চাকরিটা না হয় ততদিন যাতে তোমার কোন অসুবিধা না হয় তা দেখার জন্য রানাকে বলে গেলাম। আমিও খবরাখবর রাখব।'আবার চোখে জল চলে আসে জাহেদার।অঞ্জনার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে সে কোন রকমে বলতে পারে , ' আল্লা তোমাকে আরও বড়ো করুক। তোমার আয় পয় বারুক ধন। আল্লা তোমাকে একদিন রানী করবে দেখো।'
অঞ্জনাও জাহেদার হাত দুটো ধরে বলেন , ' সেই আর্শিবাদই করো মা । '
তারপর একসময় হুটার বাজিয়ে একে একে গ্রাম ছাড়ে অঞ্জনাদের গাড়ির কনভয়। আর তারপরই এক নিঝুম শুন্যতা গ্রাস করে নেয় গ্রামটাকে। বাড়ি ফেরার পথে নিহতের পরিবারের লোকেরা অঞ্জনাকে নিয়েই আলোচনায় মেতে ওঠে। কেউ বলে , 'মেয়ে একখানা বটে বাপু। কেমন দেখলি কথার ঝাঁঝে পুলিশগুলোকেও চুপ করিয়ে দিল। 'কেউ বা বলে, ' ওর শরীর মায়া-- মমতায় ভরা। নাহলে কেউ অতদুর থেকে ছুটে আসে। এই বাজারে এক কথায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় ? '
জাহেদাই কেবল চুপ করে থাকে। সে মনে মনে ভাবে , কি বিচিত্র মানুষের মন। চাকরি পাওয়ার স্বপ্নে মশগুল এই মানুষগুলোকে দেখে কেউ বলবে চব্বিশ ঘন্টা আগেই তারা সন্তান , স্বামী কিম্বা কোন প্রিয়জনকে হারিয়েছে। আসলে মানুষের শোকের আয়ু খুব কম। প্রথম যখন প্রিয়জনকে হারায় তখন মনে হয় বুঝি খাওয়া , দাওয়া, ঘুম সব ত্যাগ করে ফেলবে। কিন্তু শোকের তীব্রতা কমে আসে। স্বাভাবিক ছন্দে ফেরে পরিবার। একটা প্রজন্ম বড়োজোর ছবিতে মালা দেয়। পরের প্রজন্মে মাকড়সার জালে ঢাকা পড়ে যায় সেই ছবি। কখন যেন হারিয়ে যায় নামটাও। তাদের মতো পরিবারে শোকের অবকাশ তো আরও কম। দুবেলা দুটি মোটা ভাত কাপড়ের জন্য যাদের বলদের মতো ঘানি টানতে হয় তাদের শোক করার মতো সময় কোথাই ? পেট যে তাদের কাছে বড়ো বালাই। সারসত্যটা অনুভব করে সে।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment