শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ১১ )
সেইজন্য পরদিনই কুরবান সেখকে খবর পাঠায় সে। কুরবানও তার দুই মেয়েকে বিহারে পাঠিয়েছে। সেই সূত্রে এখন আড়কাঠির কাজ করে। নিজের মেয়েদের মাধ্যমে সে যোগাযোগ করে অসহায় দুঃস্থ পরিবারের মেয়েদের বিয়ের নামে বাইরে পাচারের ব্যবস্থা করে। তাতে মেয়ের পরিবারকে কিছু টাকা দেওয়ার পরও মোটা কমিশন মেলে তার। তাই খবর পেয়ে আর দেরি করে না কুরবান। বিকালের দিকেই চলে আসে সে। এসেই বলে , ' কই তোমার মেয়েদের ডাকো দেখি একবার। '
সেই কথা শুনে খুব বিড়ম্বনায় পড়ে জাহেদা। তখনও সোনালী আর রুকসানাকে কিছু জানানো হয় নি। ভেবেছিল কুরবানের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর ওদের বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু বিহারে পাঠানোর কথা নিজে মুখ কি বলতে পারত ? বুকটা ফেটে যেত তার। সেই হিসাবে কুরবান ওদের দেখতে চাওয়ায় সেই যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব হবে। তাতে যদি ওরা
ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে তাহলে হৃদয় বিদারক কথাটা আর তাকে নিজে মুখে বলতে হয় না। সেই ভেবেই দুই মেয়েকে ডাকে জাহেদা। মেয়েরাও বোধহয় কুরবানকে দেখে কিছু একটা অনুমান করে ফেলেছে। কারণ ইতিমধ্যেই আড়কাঠি হিসাবে কুরবান এলাকায় পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। তাই ধীর পায়ে ওরা দু'জন মাথা নিচু করে এসে দাঁড়ায় তার পাশে। সে বলে , ' আয় মা, ও তোদের দু'জনের বিয়ের সমন্ধ নিয়ে এসেছে। জায়গাটা একটু দুরে বটে কিন্তু ওদের অবস্থা নাকি খুব ভালো। কি তাই তো নাকি কুরবান ? '
নিজের পেটের মেয়েদের সঙ্গে একরকম ছলচাতুরী করতে গিয়ে তার বুকের ভিতরটা যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।কুরবানের অবশ্য সেসব নিয়ে কোন হেলদোলই নেই। সোনালীদের ভালো করে দেখে নিয়ে বলে , ' ভালো অবস্থা কি বলছো ? এমন পাত্র নিয়ে আসব যাদের জমি-জিরেত , গরু-বাছুর এমন কি ট্রাক্টর পর্যন্ত আছে। মেয়ে তোমার সুখেই থাকবে। '
তারপর হাতের ইশারায় সোনালীদের চলে যেতে বলে কুরবান। ওরা চলে যেতেই গলা নামিয়ে বলে , ' সবই তো ঠিক আছে। মেয়ে তোমার দেখতে দুটোই উনিশ - বিশ। কিন্তু মেজটাই গায়ে গতরে একটু বেশি আছে৷ বিহারীদের আবার একটু গায়ে গতরে মেয়েই বেশি পচ্ছন্দ। তাই আগেই বলে রাখছি , দু'জনের জন্য কিন্তু সমান টাকা পাবে না। তখন এনিয়ে যেন কোন ভুল বোঝাবুঝি না দেখো। '
কথাটা শুনেই মরমে মরে যায় জাহেদা। এ কি বলছে কুরবান ! মেয়েরা কি মানুষ নয় , গরু - ছাগল ? কার গায়ে একটু মাংস কম , কার গায়ে একটু বেশি তাই নিয়ে দরাদরি করবে সে ? '
কথাটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না সে।
তাই মেয়েদের কান বাচিয়ে নিচু গলায় বলে , ' মেয়েদের নিয়ে আমি কোন রকম দামদস্তুর করতে চাই না। নেহাৎ আমার কপাল পোড়া বলেই ওদের বলি দিতে হচ্ছে। '
' সে তুমি তোমার কথা বলেছো ঠিকই আছে। কিন্তু আমিও খাড়াখাড়ি লোক, তাই সব জায়গায় খাড়াখাড়ি কথাই বলি , তোমাকেও বললাম। নাও ধরো। '
বায়না বাবদ জাহেদার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয় কুরবান৷ তারপর শীঘ্রই দুজন পাত্রকে নিয়ে আসবে বলে বিদায় নেয় । সবই চোখে পড়ে মেয়েদের। তাদের আর কিছু জানতে বাকি থাকে না। তাদের চোখ মুখের ভাব কেমন যেন ভাবলেশহীন হয়ে যায়। কেমন যেন অচেনা মনে হয় তাদের। বড়ো দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারে না জাহেদা। খুব অপরাধী মনে হয় নিজেকে। গরু--ছাগলের মতো মেয়েদের বিক্রির জন্য বায়না নিল ? চোখের জল লুকোতে চুপিচুপি রান্না চালায় ঢুকে যায় সে। কিন্তু চোখের জল ধরে রাখতে কি পারে ? হোক না অভাবের সংসার , দশ মাস দশ দিন সে তো ওদের গর্ভে ধারণ করেছে। নিজে না খেয়ে ওদের খাইয়ে বড়ো করেছে। চিরদিনের জন্য কোথাই হারিয়ে যাবে জেনেও ওদের বিহারেই পাঠাতে হচ্ছে তাকে। মায়ের মনের এই দোলাচল অবস্থা চোখ এড়ায় না মেয়েদের। তারাও কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মাকে। বড়ো দুই মেয়ে বলে , ' তুমি এত ভাবছ কেন , আমাদের ভাগ্যে যা আছে তা হবে। যাই হোক না কেন , দুবেলা দুমুঠো খেতে তো পাবো। সবাই না খেয়ে মরার থেকে তো ভালো। ওরা যা টাকা দেবে তা দিয়ে বাবার আর ছোটোর চিকিৎসাটা হবে। চাকরিটা না পাওয়া পর্যন্ত সংসারটাও কিছুদিন চলবে। '
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না জাহেদা। মেয়েদের জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে। মা -- মেয়ের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। কেউ কোন কথা বলতে পারে না। জাহেদা কেবল মনে মনে বলে , ' কেন তোরা আমাদের অভাবের সংসারে এসেছিলি মা। মা - বাবার কোন দায়িত্বই তো আমরা পালন করতে পারি নি। এখন বিয়ের নামে তোদের বিক্রি করে দিতে হচ্ছে মা। বিশ্বাস কর বুক ফেটে যাচ্ছে , কিন্তু উপায় তো কিছু নেই বল ! '
মেয়েরা কোন প্রত্যুত্তর করে না। মাকে জড়িয়ে ধরে তারা সমানে কেঁদেই চলে। জাহেদা মনে মনে ভাবে , পেটে গামছা বেঁধেও তো দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারতাম আমরা ।কাউকে তো ওরা খাবার চায়নি। কারোর ছেলের মাথাও চিবিয়েও খায় নি। তাহলে আমার ঘরে আইবুড়ো মেয়ে থাকলে ওদের এত গায়ের জ্বালা কেন ? কখন চোখের জল শুকিয়ে আসে কেউ টের পায় না। সেদিন আর মুখে কেউ কিছু তুলতে পারে না।
প্রতিবন্ধী মেয়েটাও যেন আন্দাজে সব বুঝে যায়। খালি পেটেই একসময় মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমোতে পারে না কেবল জাহেদা আর সোনালীরা দু'বোন। নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে রাত কখন ভোর হয়ে যায় টের পায় না জাহেদা। রুকসানা আর সোনালীও তাদের পরিনতির কথা ভেবে দু'চোখের পাতা এক করতে পারে না।
ওই ভাবে দুশ্চিন্তা আর অজানা আশঙ্কায় দিন কাটে মা-মেয়ের৷ কয়েকদিন পরই মধ্যবয়স্ক দুজন লোককে নিয়ে হাজির হয় কুরবান। তারাই পাত্র। দুই মেয়েকে দেখে তারা কুরবানকে পাশে ডেকে নিয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কে কাকে বিয়ে করবে তা ঠিক করে নেয়। সেই মতো দামদরও হয়। জাহেদার মনে হয় মানুষ নয় , হাটে যেন গরু ছাগল কেনা হচ্ছে।কিছুক্ষণ পর ওরা কুরবানের হাতে বেশ কিছু টাকা তুলে দেয়। কুরবান তা থেকে নিজের কমিশন আর বায়নার টাকা কেটে বাকিটা তুলে ধরে জাহেদার দিকে। জাহেদার হাত যেন তখন পক্ষঘাত। কিছুতেই টাকা হাতে করতে পারে না।মনে মনে ভাবে , বিয়ে নিয়ে কত জায়গায় তো কত অঘটনের কথা শুনেছে। কলকাতায় পতিতাপল্লী যাওয়া কথা শুনে কত মেয়েকে গ্রামের সহৃদয় ছেলে এগিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে। বিহারে বিয়ের ক্ষেত্রেও আসরে গিয়ে বিহারী বরকে হঠিয়ে দিয়ে গ্রামের ছেলেদের বিয়ের কথাও শুনেছে।সোলেমানও তো তাকে উদ্ধার করেছিল। জাহেদা ভাবে তার মেয়েদের ক্ষেত্রেও কি তেমন কোন অঘটন ঘটতে পারে না ? ঘটবে কি করে , তার যে পোড়া কপাল। নাহলে শহিদের মা হয়ে মেয়েকে বিয়ের নামে বলি দিতে হয় ? না , তার মেয়েদের ক্ষেত্রে সে রকম কেউ এগিয়ে আসে না। বরং কুরবানের টাকা ভর্তি বাড়ানো হাত দেখে প্রতিবেশীরা কৌতুহলে
উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে। গুজ-গুজ , ফিসফাস ছাপিয়ে স্পষ্ট হয় তাদের কণ্ঠস্বর। তারই মধ্যেই পাশের বাড়ির আমিনার কথাটাই যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো যন্ত্রনাদায়ক হয়ে ওঠে। আমিনা যেন তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলে, ' আজকালকার দিনে বাড়িতে একপাল মেয়ে থাকাও ভালো।কেমন মোটা টাকা পাওয়া যায় গো। এবার খাও কেন
পায়ের উপর পা তুলে। '
আর আমিনাদের আলোচনার খোরাক হতে পারে না জাহেদা।
কুরবানের হাত থেকে টাকা ক'টা
নিয়ে সটান ঢুকে যায় ঘরে। সেখানে তখন রুকসানা আর সোনালী বিয়ের পোশাক পড়ে তৈরি। তাদের দিকে বেশীক্ষণ চেয়ে থাকতে পারে না। কোনরকমে নমো নমো করে বিয়ে হয়ে যায়। এবার তাদের বিদায় দিতে হবে। মা মেয়ে কেউই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মেয়েরা শেষবারের মতো ঘুরে ফিরে দেখে নেয় বাড়ির চারপাশ। বাবাকে সালাম করে তার কাছেথেকে বিদায় নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। ছোটবোনগুলোকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।দুরে দাঁড়িয়ে এসব দেখতে দেখতে বিরক্তি প্রকাশ করে মধ্যবয়স্ক লোক দু'জন। তাদের চোখমুখে কেমন যেন লালসার আগুন। তা দেখে অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠে দুইবোন। জানে না তাদের নিয়ে গিয়ে কোথাই তুলবে ওরা! হিন্দি ভাষাও তো জানে না। নিজেদের পরিণতির কথা আর ভাবতে পারে না। সেই সময় জাহেদা এসে কুরবানের থেকে পাওয়া টাকা কিছু করে দুই মেয়ের হাতে তুলে দিতে যায়। দুজনেই হাত সরিয়ে নেয়। দুই মেয়ের গলা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মা। কান্নার দমকে কারও কথাই স্পষ্ট হয়না। তারই মধ্যে নিজেকে সামলে জাহেদা বলে, 'টাকা ক'টা রাখো ধন। ভিন জায়গায় কখন কি দরকারে লাগে বলা যায় না। আল্লায় করে তোমরা যেন সুখী হয়ো মা। আর পরজন্মে যেন তোমরা আমার পেটে এসো না মা। বড়োলোক মায়ের পেটে এসো।'
দুই মেয়ে তাকে সালাম করে। সে তাদের আঁচলে টাকাগুলো বেঁধে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে ছুটে ঘরে ঢুকে কান্নায় লুটিয়ে পড়ে। মেয়েরা একে একে গিয়ে উঠে বসে ভটভটিতে। ভটভটি স্টার্ট করার শব্দ শুনে ছুটে দরজায় এসে দাঁড়ায় জাহেদা। গ্রামের রাস্তায় ভটভটি যত এগিয়ে যায় মেয়েদের সঙ্গে ততই দুরত্ব বাড়তে থাকে। মেয়েরা মিলেয়ে যাওয়ার আগেই ঝাপসা হয়ে শহিদের মায়ের চোখ।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment