শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ১০ )
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে শোকের তীব্রতা। কমতে থাকে সহমর্মিতা , সহানুভুতিও। অন্যান্য পরিবারগুলির অবস্থা ততটা করুণ নয়। কারণ তাদের পরিবারে আরও উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রয়েছে। কিন্তু জাহেদার তো তা নেই। বরং তার চাপটা আরও বেশি। সাতটা পেট , তার মধ্যে সুরবানের বাবা বিনা চিকিৎসায় বিছানায় পড়ে রয়েছে। প্রতিবন্ধী ছোট মেয়েটার অবস্থাও শোচনীয়। পার্টি থেকে যা সাহায্য করে তাতে সবদিক সামাল দেওয়া যায় না। সহানুভুতিসম্পন্ন মানুষেরাও হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। কাউকে কিছু বলতেও পারে না। কেমন যেন ইতস্তত লাগে। জাহেদা জানে , সবার সব চাহিদা দীর্ঘদিন কেউ পূরণ করতে পারে না। নিজেকেই উদ্যোগী হতে হয়। সেই উদ্যোগই নেয় সে। শুরু হয় তার বেঁচেবর্তে থাকার লড়াই। বেঁচেবর্তে থাকার অন্য কোন পথ তো তার জানা নেই। এক্ষেত্রে অন্যরা সচরাচর বেঁচে থাকার জন্য যে পথটি বেছে নেয় , জাহেদাকেও বেছে নিতে হয় সেই ভিক্ষাবৃত্তিরই পথ।তবে দলের মুখ পুড়বে বলে সে কাছেপিঠে ভিক্ষা করে না। আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছি বলে চলে যায় দুর - দুরান্তের গ্রামে। দলের অনেকেই সব জেনেও না জানার ভান করে থাকে। জাহেদা কারও কাছে কাঁদুনি গাইতে যায় না। আর গায়বেই বা কার কাছে ? রানা-মুকিমরা আর খুব একটা তার বাড়িমুখো হয় না। মুস্তাকই নিয়মিত খোঁজখবর নিয়ে যায়। কিন্তু মুস্তাকের তো কিছু করার নেই। পার্টিঅন্ত প্রাণ হলেও পার্টিতে তার খুব একটা গুরুত্ব নেই। তাই মনের দুঃখ মনে চেপেই দিন কাটে জাহেদার। শুধু ভিক্ষাবৃত্তিতেই সাতটা পেট চলে না। পাশাপাশি বিড়ি বাঁধা আর কাথাস্টিচের কাজও শুরু করে সে। মেয়েরাও হাত লাগায় সেই কাজে।ওইভাবে কোন রকমে পেটের ভাতের দুঃশ্চিন্তা দুর হয়। কিন্তু মাথায় চেপে বসে মেয়ের বিয়ের দুশ্চিন্তা। তার মধ্যে বড়ো দুটিকে এবারে পার না করলেই নয়। কিন্তু কে করবে তার মেয়েদের বিয়ে ? মেয়ের বিয়ে দেওয়ার মতো টাকা কোথায় তাদের ? তবু চেনাশোনা যাকেই পায় মেয়ের বিয়ের কথা বলে। সবাই আশ্বাস দেয় , কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য জাহেদা রেলের চাকরিটার প্রতীক্ষায় দিন গোনে। চাকরিটা পেলে তাদের সুদিন ফিরবে বলে মনে করে সে। কিন্তু চাকরির খবর আর আসে না। কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে বিভিন্ন উপদেশ। আসে চাপও। বাড়িতে বিয়ের যোগ্য মেয়ে থাকলে যে সামাজিক চাপ থাকে তা থেকে রেহাই মেলে না জাহেদারও। যাদের বাড়িতে যুবক ছেলে রয়েছে তারা প্রায়ই বাড়ি বয়ে এসে নানা উপদেশ দিয়ে যায়।কেউ কেউ অকথা - কুকথা বলে , কুইংগিত দেয়। কেউ ভেবেও দেখে না একমাত্র রোজগেরে ছেলেকে হারিয়ে যাদের দিনই চলে না তারা মেয়ের বিয়ে দেবে কি করে ? চোখ ফেটে জল আসে জাহেদার। কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারে না। মুখ বুজে সব সহ্য করে। তার মনে প্রশ্ন জাগে এক বছর সময়টা কি খুব দীর্ঘ ? কি করে মাত্র একবছরের মধ্যেই সবাই ভুলে গেল একদিন তারাই তাকে শহীদের মায়ের আসনে বসিয়েছিল ? মনে মনে উত্তর খোঁজে জাহেদা।উত্তর মেলে না। মেলে শুধু উপদেশ আর পরামর্শ। এইতো সেদিন বাড়ি বয়ে এসে একগাদা উপদেশ দিয়ে গেল আজমিরা আর রওশনা। আজমিরাদের মেয়েরা তার বড় দুই মেয়েরই বয়সী। কিছুদিন আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে ওরা।সে প্রসঙ্গ টেনে আজমিরা বলে , ' কি বলব আপা , মেয়েটা যেন গলার কাঁটা হয়েছিল। রাতে ঘুমোতে পারছিলাম না। ওদের বাপকে বলে বলে বিয়েটা দেওয়া গেল। তুমিও আর দেরি কোর না। এখনকার ছেলেমেয়েদের মতিগতি বোঝা দায়। কখন কি করে বসে তার তো ঠিক নেই। ছেলেটাকে দেখেই তো বুঝি। সব সময় কেমন ছোঁকছোঁক ভাব। '
ইংগিতটা বোঝে জাহেদা। ওদের বাড়িতে ছেলে রয়েছে। সেই ছেলে যাতে কোনও ভাবে তার মেয়েদের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ঘরে না তোলে তাই তাকেই বিয়ে দিয়ে মেয়েদের বিদায় করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না। তাই বলে , ' ভাই রাতে কি আমিও ঘুমোতে পারছি, কিন্তু বোঝই তো সব। বিয়ে দেব বললেই তো আর হয় না। সুরবানের বাপের তো ওই অবস্থা। মাথার উপর তো আর কেউ নেই। সেই রকম কোন ছেলে থাকে তো দেখেশুনে দাও না ভাই। মেয়েদুটোকে পার করে আমিও একটু নিশ্চিন্ত হই। '
রওশনা বলে , ' ওই দেখ ছেলে থাকবে না কেন ? মেলা ছেলে আছে। কিন্তু কেউ তো আর বিনা পণে বিয়ে করবে না।'
' পণ দেওয়ার ক্ষমতা যে আমার নেই তা তোমাদের অজানা নেই ভাই। গরীবের মেয়ে বলে কেউ যদি দয়া করে উদ্ধার করে দেখ না। '
' দয়া করে কে বিয়ে করবে ? একটা উপায় অবশ্য আছে। '
উপায়ের কথা শুনে আগ্রহের আতিশয্য ঝরে পড়ে জাহেদার গলায় , ' কি - কি উপায় বলো ভাই ? যেখানে যেতে বলবে সেখানে যাব। যার হাতে পায়ে ধরতে বলবে ধরবো। মেয়ে দুটোকে পার করতে পারলে বাঁচি। গলায় বিয়ের যুগ্যি মেয়ে লেগে থাকলে মায়ের যে কি হয় তা তো আর তোমাদের অজানা নয় ভাই। '
' তুমি বরং সাতগাঁয়ের কুরবানের কাছে একবার যেতে পার। '
' ওর বিয়ের যুগ্যি ছেলে আছে বুঝি ? '
' ওর নিজের কোন ছেলে নেই বটে , তবে ওর কাছে ছেলের খোঁজখবর থাকে। কত গরীবের মেয়েকে যে উদ্ধার করে দিয়েছে তার ঠিক নেই। একপয়সা তো লাগবেই না , উল্টে পাত্রপক্ষ টাকা দিয়ে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। একটু দূরে পড়বে আর যাওয়া আসা করতে পারবে না এই যা। '
' কত দূরে ? '
' বিহারে। '
শুনেই চুপসে যায় জাহেদা। কোন কথা বলতে পারে না।রওশনা র কথার সূত্র ধরে আজমিরা বলে , ' দুরে হলেই বা ? নিখর্চায় শুধু নয় , আজকের দিনে টাকা দিয়ে ক'জন বিয়ে করে নিয়ে যাবে শুনি ? আর আসা যাওয়ার কথা ভাবছ ? বিয়ে হলে শ্বশুরঘরই তো মেয়েদের আসল জায়গা। বাবা-মা যতদিন বেঁচে থাকে আসা যাওয়া সেই ততদিনই। তারপর তো আর কারও কোন খোঁজখবরই থাকে না। তুমি বাপু আর দ্বিমত কোর না। কুরবানকে খবর পাঠাও। '
আরও কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নেয় আজমিরারা। আর নিজের মেয়েবেলার কথা মনে পড়ে যায় জাহেদার। তারাও ছিল মাথায় মাথায় তিনবোন। বাবা ছিল বটে , কিন্তু বাবার মতো ছিল না। তার আরও তিন জায়গায় তিনটে সংসার ছিল। তার মতো মা'ও বিড়ি বেঁধে , হাঁস - মুরগি পালন করে তাদের মানুষ করেছিল। মানুষ মানে ওই গায়ে গতরে বেড়ে ওঠা আর কি ! বাবা নামের মানুষটি মাঝেমধ্যে আসত আর মায়ের উপরে চোটপাট করত। নিজে কোন সাহায্য করা দুরের কথা , মায়ের টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে জুয়ো খেলত আর গাঁজা খেত। মা কিছু বললেই মারধোর করত আর তিন তালাকের ভয় দেখাত। সেই শুনেই মা চুপসে যেত। জাহেদা ভেবে পায় না , যার কাছে কিছুই পায় নি , তার তিন তালাকের অত ভয় পেত কেন মা ? ওই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই মায়ের আপত্তি অগ্রাহ্য করে দুই দিদিকে মোটা টাকার বিনিময়ে বিয়ের নামে বিহারে বিক্রি করে দিয়েছিল বাবা। মা কেবল নীরবে চোখের জল ফেলেছিল। তাকেও একইভাবে পাচারের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। হয়তো বিয়ের নামে সেও বিকিয়ে যেত। কিন্তু সেইসময় আল্লার দুত হয়ে এসেছিল একটি ছেলে। তাদের গ্রামে সেইসময় স্কুলবাড়ি তৈরি হচ্ছিল। ছেলেটি সেই বাড়ি তৈরিতে রাজমিস্ত্রির যোগাড়ের কাজ করত। মাঝে মধ্যে রান্নাও করতে দেখা যেত তাকে। জাহেদা দুবেলাই স্কুলের টিউবওয়েল থেকে ঘড়া নিয়ে জল আনত যেত। যাওয়া আসার পথে সুঠাম চেহেরার ছেলেটাকে চোখে পড়ত তার। মাঝেমধ্যে চোখাচোখিও হয়ে যেত। ওই পর্যন্তই , কোনদিন কোন কথা হয় নি।হঠাৎ একদিন কথা বলার সুযোগ এসে যায়। সেদিন যে যখন জল নিতে যায় তখন রান্নার জন্য জল নিতে আসে ছেলেটাও। এমনিতেই টিউবওয়েলটা ছিল খুব টান। তার উপরে ছেলেটাকে দেখে সেদিন তাকে কি আড়ষ্টতায় পেয়েছিল কে জানে ! কিছুতেই আর কল টিপতে পারছিল না। সেটা লক্ষ্য করেই ছেলেটা বলেছিল , ' ছাড়ো আমাকে দাও দেখছি।'
সে মৃদু আপত্তি জানিয়ে বলেছিল , ' না-না আমি পারব। '
' সে তো দেখতেই পাচ্ছি কেমন পারবে। কিন্তু আমার তো ততক্ষণ দেখতে গেলে হবে না। ভাত বসিয়ে এসেছি , সময়মতো জল না দিলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। তখন এতগুলো লোক কি খাবে শুনি ? '
তারপর আপত্তি অগ্রাহ্য করে কল টিপে তার ঘড়া ভর্তি করে দেয়। সেই শুরু , তারপর থেকেই চলে টুকটাক কথাবার্তা , আড়ালে আবডালে চোখাচোখি। এক অমোঘ আর্কষণ জাহেদাকে স্কুলবাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে।দিনে দু'বারের জায়গায় তিন-চার বার জল আনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ভাত বসানো না থাকলে ছেলেটারও জল নিতে এসে ব্যস্ততা দেখিয়ে কল টিপে জাহেদার ঘড়া ভর্তি করে দিতে হয়। বাড়িতে ভালো কিছু হলে ছেলেটার জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসে জাহেদা। ছেলেটাও তুলে রাখে তার রান্না করা মাছের পেটি কিম্বা ডিমের বড়া। বিষয়টি গ্রামের লোক আর মিস্ত্রীদের নজর এড়ায় না। শুরু হয় কানাঘুষো। কথাটা বাবার কানেও যায়। উদ্বেগ বেড়ে যায় তার। অপরিচিত ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নয় , তার মাথাব্যাথার কারণ অন্য। মেয়েটা ছেলেটার সঙ্গে পালিয়ে গেলে যে পাচার করে টাকা হাতানোর সুযোগ হারাতে হবে তাকে। সেই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না সে। তাই তাকে বিহারে পাচারের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর ছেলেটাকে রাজমিস্ত্রিরা কড়কে দেয়। খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যায় জাহেদা। স্কুলের কাজও শেষ হয়ে আসে। কিছুদিন পরেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাবে ছেলেটি। সেই কথা ভেবেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসে তার। কিন্তু লজ্জায় ছেলেটাকে সে কথা মুখ ফুটে বলতেও পারে না। কি করবে কিছুই ভেবে উঠতে পারে না সে। বাবার তৎপড়তা বেড়েই চলে। তাই নিয়ে মায়ের সঙ্গে তাই নিয়ে নিত্য ঝগড়াঝাঁটি হয়। মা বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছিল। তাই কোনরকম রাখ ঢাক না করেই একদিন বলেছিল , ' বাঁচতে চাস তো পালা। '
সেদিনই ছেলেটিকে সব কথা খুলে বলেছিল সে। শোনার পর ছেলেটিও বলেছিল, 'চলো পালাই '। সেই রাতেই ছেলেটির হাত ধরে পালিয়েছিল। তখন ছেলেটির নামটাও জানা হয় নি তার। জেনেছিল মৌলবীর বাড়িতে বিয়ে পড়ানোর সময়। বিয়ের পরও ঝামেলা কম হয় নি। খোঁজে খোঁজে বাবা ঠিক হাজির হয়েছিল। শিকার ফসকানোর ক্ষোভে তখন বাবা ফুঁসছিল। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু গ্রামের লোকের দাবড়ানি খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়। কবেকার কথা। আজও জ্বলজ্বল করছে মনের মণিকোঠায়। সেই ছেলেটির সঙ্গেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর। যতদিন সক্ষম ছিল ততদিন জাহেদার বড়ো বল ভরসা ছিল সোলেমান। সে সুস্থ থাকলে মেয়ের বিয়ে নিয়ে তাকে কোন দুঃশ্চিন্তাই করতে হত না। এখন যা করার তাকে একাই করতে হবে। কিন্তু করবেই বা কি ? ভেবে কোন কুলকিনারা পায় না। একমাত্র বিহার কিম্বা কলকাতা পাঠানো ছাড়া তো অন্য কোন পথ খুঁজে পায় না সে।গ্রামাঞ্চলে গরীবদের তো কন্যাদায় থেকে উদ্ধার হওয়ার তো ওই দুটি পথই খোলা আছে।পয়সা খরচ করে বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য যাদের থাকে না তারা মেয়েকে কলকাতা কিম্বা বিহার পাঠায়।উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন এলাকাকেই গ্রামের মানুষ বিহার হিসাবে চেনেন। ওই ব্যবস্থায় সংসারের কিছুটা সুসারও হয়।কলকাতার পতিতাপল্লী থেকে মেয়েরা টাকা পাঠায়। আর তথাকথিত বিহার থেকে বাপের বয়সী লোকেরা সব আড়কাঠি ধরে কিছু করে টাকা বাবা-মায়ের হাতে দিয়ে বিয়ে করে নিয়ে যায়।আসলে বিয়ের নামে বলি দেওয়া হয় ওইসব মেয়েদের।কারণ পরবর্তীকালে ওইসব মেয়েদের আর কোন খোঁজ মেলে না। কিছুদিন নিজের কাছে রেখে পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। গ্রামেই এমন ঘটনা অনেক আছে। সব জানে জাহেদা। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশীদের কথার জ্বালায় বড়ো দুই মেয়েকে বিহারে পাঠানোরই সিদ্ধান্ত নেয় সে। অসহায় জাহেদার সামনে যে আর ভিন্ন পথ নেই।
No comments:
Post a Comment