শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ৯ )
শুধু সাংবাদিকদেরই নয় , দেখে নেওয়ার হুমকি পৌঁচ্ছে যায় শহীদ পরিবারগুলির কাছেও। বিভিন্ন দিক থেকে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার চাপ আসতে থাকে তাদের কাছে। নাহলে অভিযুক্তরা জেল থেকে ফেরার পর দরজায় শিকল তুলে দিয়ে বাড়িতেই ঘুমন্ত পুড়িয়ে মারা হবে বলে হাওয়ায় হুমকি ছুড়ে দেওয়া হয় । শহীদ পরিবারের লোকেরা অবশ্য সেই সব কথা কানেই তোলে না। সেদিন অঞ্জনা রায়ের ভূমিকা দেখে তাদের মধ্যে প্রতিরোধের মানসিকতা গড়ে উঠেছে। তাছাড়া বাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। সে তো হামেশায় ঘটে। সামান্য কারণেই রাজনীতির আগুনে পুড়ে যায় ঘর গৃহস্থালি। তাই ব্যাপারটা কেমন গাসহা হয়ে গিয়েছে সবার। আবার অনেক সময় ভয় দেখাতে বাড়িতে আগুন দেওয়ার ফাঁকা আওয়াজও দেওয়া হয়। তাছাড়া এখন ওদের নেতারা তো সব জেলে। তাই ওদেরই এখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলের মতো অবস্থা। আগে সেই ঘা সারাক , তবে তো বাড়িতে আগুন দেবে। সেই কথা ভেবেই শহীদ পরিবারগুলি হুমকি অগ্রাহ্য করে। কিন্তু অচিরেই তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। গণমঞ্চের নেতাদের জেল থেকে ফেরার আগেই শুরু হয়ে যায় দেখে নেওয়ার পালা। আক্ষরিক অর্থেই ভাতে মারার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাতের অন্ধকারে কোনদিন শহীদ পরিবারের যৎসামান্য জমির ধান , কোনদিন বা ধানের পালুই জ্বলে উঠতে দেখা যায়। জাহেদার অবশ্য ওসবের বালাই নেই। তার তো একছটাকও জমিজিরেত নেই। কিন্তু একদিন তার বাড়িতেও আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়। ভাগ্যসি সেদিন ঘুমিয়ে পড়ে পড়ে নি জাহেদা। পোড়া গন্ধ পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে দাউদাউ করে জ্বলছে বাড়ির চাল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে। সেই চিৎকার শুনে বাকিরাও বেরিয়ে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। ততক্ষণে হাজির হয়েছে গ্রামের মানুষ। তাদের একদল আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর একদল যারা আগুন লাগাতে এসেছিল তাদের খোঁজে ছুটে যায়। কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় আগুন নিভে আসে। সেই সময় খবর আসে যারা আগুন লাগাতে এসেছিল তাদের মধ্যে দু'জন নাকি ধরা পড়েছে।
সেই খবর শুনেই উন্মত্ত হয়ে ওঠে গ্রামের মানুষ। এতদিন তারা তক্কেতক্কে ছিল , কিন্তু কাউকে ধরতে পারে নি। তাই সবাই রে-রে করে ছুটে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে স্কুলের সামনের বটতলায় দু'জনকে ধরে নিয়ে আসা হয়।তাদের দু'জনকে দেখে চমকে ওঠে সবাই। তাদের মধ্যে একজন সুরঞ্জন সেনগুপ্তেরই এক সাগরেদ চেতন মাহারা। আর একজন ওদের দলেরই সর্বক্ষণের কর্মী ইদ্রিস আলি। সেখপাড়ার পার্টি অফিসে থাকে। তাদের দেখে অরুনোদয় পার্টির লোকেরা মারমুখী হয়ে ওঠে। মুস্তাক এগিয়ে এসে তাদের আটকায়। সে বলে , 'খবরদার কেউ ওদের গায়ে হাত দিও না। এটা ওদের একটা চাল হতে পারে। আমাদের মামলাটার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে গণপ্রহারের পাল্টা মামলা সাজানোর জন্য ওরা এইসব দুস্কর্ম করতে পারে। '
মুস্তাকের কথা শুনে মেজাজ হারিয়ে ফেলে রানা। সে বলে , ' বাড়িতে আগুন লাগাতে এসে ধরা পড়েছে। মারব না তো কি ওদের মুন্সীপাড়ার বাজার থেকে মিস্টি এনে খাওয়াব ? শালাদের জন্য আমাদের কম ক্ষতি হয়েছে ? '
রানার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। জমির ধান এবং ধানের পালুই পুড়িয়ে ওরা অনেকের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। তবুও সবাইকে বুঝিয়ে শান্ত করে মুস্তাক। ঠিক হয় , ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সেই প্রস্তাবে সবাই একমত হলেও রানা বলে , ' পুলিশের হাতে তুলে দিয়েই বা কি হবে ? সেই তো বিকালের মধ্যে ফিরে এসে দাপিয়ে বেড়াবে। তার চেয়ে শালা দুটোকে মেরে হাতের সুখ করে নিই। তারপর যা হওয়ার হবে। '
মুস্তাক বলে , ' প্রয়োজনে আমরা জেলা নেতৃত্বকে জানিয়ে উপযুক্তদের শাস্তির দাবিতে থানায় ডেপুটেশান দেব।'
এবারে ঘাড় পাতে রানা। সে বলে , ' তেমন হলে সুকুলবাবুকেও আসার কথা বলতে হবে। '
সেইমতো কয়েকজন যায় থানায়। কয়েকজন ছোটে জেলার সদর পার্টি অফিসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই থানা থেকে এসে পৌঁছোয় পুলিশ। অভিযোগ লিখিয়ে নেওয়ার পর দু'জনকে নিয়ে চলে যায় তারা। বিকালের মধ্যেই জেলা নেতাদের সঙ্গে এসে পৌঁছোন সুকুল ব্যানার্জী। গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথা বলেন। রানা এবং মুস্তাককে জাহেদার পুড়ে যাওয়া বাড়ির চাল ছাওয়ানোর নির্দেশ দেন। তারপর জাহেদা এবং অন্যান্যদের নিয়ে থানায় যান। সেখানে অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানান। পাশাপাশি পথসভা এবং সাংবাদিক সম্মেলন করে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।
পরদিন সেই খবর সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আবার মুখ পোড়ে শাসকদলের। ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে পথে নামতে হয় তাদের। তারাও পরদিন সেখপাড়া বাজারে পথ সভার আয়োজন করে। সেখানে দলের স্থানীয় এবং জেলা নেতারা গণমঞ্চের বিভিন্ন গণমুখী কাজের কথা তুলে ধরেন। বিরোধীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত কারণে পরিকল্পিত ভাবে তাদের উজ্বল ভাবমূর্তিতে কালিমালিপ্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে বলেও দাবি করেন। সংবাদমাধ্যমকেও একহাত নেন। দলের জেলা সম্পাদক প্রদীপ ব্যানার্জি বলেন , 'সাংবাদিকরা এখন পরের হাতে তামাক খেয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের লেখা সংবাদ কেউ পড়বেন না। '
সভা শেষে সংবাদিক সম্মেলনে সেই প্রসঙ্গ তোলে দেবদত্ত। প্রদীপবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলে , ' সব শেষে দাদা সেই আমাদের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দিলেন ? এতো সেই সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধরার মতো ব্যাপার হলো না ? '
' ভুলটা কি বলেছি শুনি ? আর বেঁড়ে ব্যাটাদেরই বা এত বাড়াবাড়ি কিসের ? '
' আমরা আবার কোথায় বাড়াবাড়ি করলাম দাদা ? পুলিশ আপনাদের নেতা- কর্মীদের খুনের অভিযোগে ধরেছে। আমরা তো দাদা সেই খবরই লিখেছি। '
' তা লিখেছ বটে , কিন্তু সব সময় যে নিরীহ খেতমজুরকে খুন করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছো। ওরা যে ডাকাতি করতে গিয়ে গণপ্রহারের শিকার হয়েছে , সেই বিষয়টি কোন গুরুত্বই পাচ্ছে না। '
' কেন দাদা সে কথাও তো লেখা হয়েছে। '
' সেভাবে কই আর লেখা হয়েছে। কথাটা তো আমাদের বক্তব্যে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর আর কি দাম আছে ? '
' কি বলছেন দাদা , আপনাদের বক্তব্যের দাম নেই ? বেশ বাদ দিন , আগুন লাগানোর ঘটনা নিয়ে কি বলবেন ? '
' কি আবার বলব ? পুলিস দু'জনকে ধরেছে শুনলাম। আইন আইনের পথে চলবে। আমরা মাথা ঘামাব না। '
' কিন্তু যারা ধরা পড়েছে তারা তো আপনাদেরই লোক। '
' কে বলল আমাদের লোক ? ওরা আমাদের দলের কেউ নয়। '
' আপনাদের দলের কেউ নয় ? ওদের তো সবসময় আপনাদের সেখপাড়ার পার্টি অফিস আর সুরঞ্জনবাবুর সঙ্গেই দেখা যেত। '
কথাটা শুনে প্রদীপবাবুকে কিছুটা বিব্রত দেখায়। কিন্তু দীর্ঘদিন রাজনীতি করা ঘাঘু লোক তাই বুঝতে দেন না। হালকা চালে বলেন , ' বাড়ি থাকলে সেখানে খাবারের লোভে কুকুর বিড়াল আসে। তাবলে কুকুর-বিড়াল কি মনুষ্য পদবাচ্য সদস্য হয়ে যায় নাকি ? আমরা শাসক দলে আছি। কত জন কত রকম ফিকিরে আমাদের পিছনে ঘোরে তার ঠিক আছে ? '
প্রদীপবাবুর ব্যাখ্যা শুনে হাঁ হয়ে যায় দেবদত্ত। মনে মনে ভাবে এরা পারেনও বটে। প্রয়োজনে বিড়ালকে দিয়ে ইঁদুর ধরায়। কুকুরকে দিয়ে বিড়াল তাড়ায়। কুকুরের চিৎকারে চোর-ডাকাত ধরা পড়লে নিজেরা বাহবাও নেয়। আবার প্রয়োজন ফুরোলেই চ্যালাকাঠের বাড়ি মেরে তাড়াতেও পিছপা হয় না। গণহত্যার মতোই আগুন লাগানোর অভিযোগও ধামাচাপা দিতে পারে না পুলিশ। চাপে পড়ে দুজনকে গ্রেফতার করে জামিন অযোগ্য ধারাতেই আদালতে পাঠাতে বাধ্য হয়। দুটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা ধরা পড়ায় শহিদ পরিবারের লোকেদের মনটা কিছুটা শান্ত হয়। অভিযুক্তদের শাস্তির প্রতীক্ষায় দিন গোনে তারা।
সেই প্রতীক্ষাতেই বছর ঘুরে যায়। শোকের ক্ষতে প্রলেপ দেয় সময়। অরুণোদয় পার্টির লোকেরা নিয়মিত শহিদ পরিবারগুলির খোঁজখবর নিয়ে যায়। অভাব - অনটনে সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দেয়। তাদের কাছে থেকেই জাহেদারা জানতে পারে সেদিনের ঘটনায় নিহত এবং আহতদের জন্য রেলে পনেরোটি চাকরি বরাদ্দ করেছেন অঞ্জনা। শীঘ্রই চাকরি প্রাপকদের নামের তালিকা পাঠাতে হবে। আশায় বুক বাঁধে জাহেদারা। শোকের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মুন্সীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে তৈরি হয় শহীদবেদী। সেখানে অন্যান্যদের সঙ্গে সুরবানের নামও লেখা হয়। কোথাও যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে বাস ধরতে গেলেই সেই নামের উপর হাত বোলায় জাহেদা। হাত বোলাতে বোলাতেই যেন সুরবানের স্পর্শ পায় সে। মনে হয় যেন বেদীর নীচেই ঘুমিয়ে আছে তার ছেলে। মনে মনে অঞ্জনাকে ধন্যবাদ জানায়। শহীদবেদী তৈরি না হলে এই অনুভূতির পরশ তো তার পাওয়া হত না। ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে জলে ভরে যায় জাহেদার কুঁচকে যাওয়া চোখের কোল। বাড়িতেও সুরবানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখেও চোখের জল বাঁধ মানে না তার। কিন্তু কাঁদতে পারে না। সুরবানের বাবা এমনিতেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে রয়েছে। ছেলের শোক উঠলে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়বে বলে কান্না গিলে ফেলতে হয় তাকে। কয়েকদিন ধরেই অবশ্য একটা চাপা উত্তেজনা জাহেদার মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। সপ্তাহ খানেক ধরেই এলাকায় শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে সাজো সাজো রব গিয়েছে। জাহেদারা তো এই দিনটির জন্যই প্রতীক্ষায় ছিল। অবশেষে এসে পড়ে দিনটি। রাত পোহালেই শহিদ দিবস।
মুন্সীপাড়া বাজারে তারই জোর প্রস্তুতি চলছে। বাঁধা হয়েছে তোরণ। সেখানে সব শহিদের নাম লেখা। মঞ্চেও টাঙানো হয়েছে তাদের ছবি। ফুল মালায় সাজানো হয়েছে শহিদবেদীও। অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আসছেন অঞ্জনাও। সারা জেলা তো বটেই , সংলগ্ন বর্ধমান এবং মুর্শিবাদবাদ জেলা থেকেও কাতারে কাতারে লোক আসবে। সন্ধ্যার দিকে প্রতিটি শহিদ পরিবারে পৌঁচ্ছে যায় এক সেট করে নতুন পোশাক। রানা এসে বলে যায় , ' চাচী দিদি আপনাদের জন্য কাপড় কিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন । নতুন কাপড় পড়ে কাল আপনারা সবাই শহিদ সমাবেশে যাবেন।'
' যাব বইকি ধন , যাবার জন্যই তো দিন গুণছিলাম।
' দিদি সবার সামনে যখন জিজ্ঞেস করেবেন , আপনারা কেমন আছেন , কোন অসুবিধা নেই তো ? তখন কি বলবেন ? '
' যা সত্যি তাই বলব। তোমরা থাকতে আমরা খারাপ থাকব কেন , আর সমস্যাই বা থাকবে কেন বাপ ?' জাহেদার জবাব শুনে হাসি ফুটে ওঠে রানার মুখে। মনে মনে সে ভাবে , জাহেদাদের ওই কথা শুনে দিদি নিশ্চয় খুশী হবেন, আর জন্য উপহার হিসাবে দলে কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দেবেন। পরদিন সকাল থেকেই মুন্সীপাড়া বাজারে শুরু হয়ে যায় মানুষের আনাগোনা। বেলা যত গড়ায় , ততই মানুষের ঢল নামে। চাপা উত্তেজনা জাহেদাদের মনেও। একবছর পর আবার অঞ্জনার সঙ্গে দেখা হবে। সে কি আগের মতোই তাদের আপন করে কাছে টেনে নেবে ? নেবে নিশ্চয় , নাহলে সভায় পড়ে যাওয়ার জন্য কাপড় কিনে পাঠায় ? বাড়ি থেকেই জাহেদা শুনতে পায় মাইকের স্লোগান। সমবেত কন্ঠ যেন গর্জে উঠছে , ' উঁচপুরের মহান শহিদ আমরা তোমায় ভুলছি না ভুলব না। ' কখনও বা ভেসে আসছে গানের সুর, ' ও শহিদের মা তুমি আর কেঁদো না। তোমার এক ছেলে গিয়েছে , ছেলে রয়েছি হাজার জনা '।
শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে , চোখ জলে ভরে আসে জাহেদার। এতদিন তাদের এতটুকু সম্মান দেওয়া দুরের কথা , কেউ মানুষই মনে করত না। চোখের জল সামলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সে। স্নান খাওয়া করে নতুন কাপড় পড়ে তৈরি হয়। কাছেই সভাস্থল , হেঁটেই একসঙ্গে চলে যাবে বলে সদর দরজার চৌকাঠে পা রাখতেই উর্ধশ্বাসে মোটরবাইক হাকিয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় রানা।মোটরবাইক থেকে নেমে বলে, ' দাঁড়ান চাচী দিদি ফোন করেছিলেন। উনি আপনাদের জন্য গাড়ী পাঠাচ্ছেন। সেই গাড়িতেই আপনারা সভায় যাবেন। '
রানার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে যায় জাহেদা। এত ব্যস্ততার মধ্যেও অঞ্জনা তাদের কথা মনে রেখেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধুলো উড়িয়ে গ্রামে ঢোকে পেল্লায় একটা গাড়ি। সেই গাড়িতেই জাহেদারা সভাস্থলে পৌঁছোয়। অঞ্জনারা আগেই মঞ্চে পৌঁচ্ছে গিয়েছেন। মঞ্চের সামনে তখন শুধু কালো কালো মাথা। মাইকে একে একে শহিদের হিসাবে ঘোষণা করা হচ্ছে। জাহেদারা গাড়ি থেকে নেমে মঞ্চের কাছে পৌঁছোতেই এগিয়ে আসেন স্বয়ং অঞ্জনা । একে একে হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে যান তাদের। ছোট্ট মঞ্চ, সবার স্থান সংকুলানের সমস্যা। তবু একেবারে সামনের সারিতে বসানো হয় এগারোটি শহিদ পরিবারের এগারো জন সদস্যকে। অঞ্জনা সামনে এসে কাউকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম , কাউকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কারও বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করেন , ' কি আপনারা সবাই ভালো আছেন তো ? কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো ? '
অঞ্জনার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে যায় জাহেদারা। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে সবাই। কোন রকমে বলতে পারে , ' মাথার উপর আপনি আছেন। আমাদের আর অসুবিধা কিসের ? '
জাহেদাদের কথা শেষ হয়না। মাঝপথেই অঞ্জনা বলে ওঠেন, ' ছি ছি এমন ভাবে বলবেন না। আমি আপনার মাথায় থাকতে পারি ? বলুন আপনাদের আর্শিবাদের হাত আমার মাথায় আছে বলেই পাশে থাকতে পারছি। '
অঞ্জনাকে যত দেখছে তত অবাক হয়ে যাচ্ছে জাহেদারা। ক্ষণেকে আপন করে নেওয়ার মতো কি অমায়িক ব্যবহার! কোথাও এতটুকু অহংবোধ নেই। সভার শুরুতেই একে একে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেন অঞ্জনা। তারপর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে জনতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেন , ' কি বন্ধুরা যারা আমাদের দল করতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন তাদের আমরা কোনদিন ভুলে যাব না তো ?'
উদ্বেলিত জনতা সমস্বরে বলে ওঠে , ' না, জীবন থাকতে নয়। '
অঞ্জনা ফের প্রশ্ন তোলেন , 'যারা আমাদের এগারো জন কর্মীকে নৃশংসভাবে খুন করল তাদের কি এরপরও আপনারা ক্ষমতায় বসিয়ে রাখবেন ? ' জনতা গর্জে ওঠে , ' না, কিছুতেই না। সামনের নির্বাচনে ওদের আমরা গদি ছাড়া করে ছাড়ব। '
' ঠিক তো ? শহিদের মায়ের নামে কসম খেয়ে বলুন সবাই। '
অঞ্জনার প্রশ্নে আবার গর্জায় জনতা, ' হ্যা , কসম খেয়ে বলছি ওদের গদিচ্যুত করতে আমরা জান লড়িয়ে দেব। '
সভার শেষ মুহুর্তে অঞ্জনা ঘোষণা করেন , ' শুনুন সবাই, উঁচপুর হত্যাকান্ডে নিহত এবং আহতদের জন্য রেলে পনেরোটি চাকরি মঞ্জুর হয়েছে। শীঘ্রই নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।'
ঘোষণা শুনে হাততালিতে ফেটে পড়ে জনতা। অঞ্জনার নামে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি দিয়ে ওঠে তারা। অঞ্জনা হাত তুলে তাদের থামিয়ে মঞ্চে ডেকে নেন রানাকে। জাহেদাদের দেখিয়ে বলেন , ' দেখো ওদের যেন কোন সমস্যা না হয়।' কথা শেষ করে আরও একবার শহিদ পরিবারের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে নাড়তে কনভয়ের দিকে এগিয়ে যান তিনি। আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোথাই যেন হারিয়ে যায় জাহেদারা।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment