Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

শহিদের মা -- ১২ /

 


               শহিদের মা 


                                  অর্ঘ্য  ঘোষ 


                                           ( ১২ ) 


ঝাপসা হওয়ারই কথা। এক ছেলের খুনের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই যদি আর ছেলের ছিন্নভিন্ন দেহ বাড়ির সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায় তাহলে কোন মা'ই বা নিজেকে ধরে রাখতে পারে ?  সেজছেলে দিনহাজের ছিন্নভিন্ন দেহ বাড়ির অদুরে পড়ে থাকতে দেখে বুকফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শহীদের মা। বছর দেড়েক আগেই তো গণমঞ্চের লোকেরা তার মেজছেলে ইনতাজকে বাড়ির ভিতরেই নৃশংশ ভাবে খুন করে গিয়েছিল। সেই ঘটনার পর থেকেই গণমঞ্চের লোকেদের ভয়ে বাকি ছেলেরাও গ্রামছাড়া হয়েছিল।দিনহাজ আত্মগোপন করেছিল পাশের গ্রামের বন্ধু হাসানের বাড়িতে। কিছুতেই আর বাড়ি ছেড়ে থাকতে মন টিকছিল না তার। মায়ের জন্য খুব মন কেমন করছিল। তাই বন্ধুকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মাকে দেখতে বাড়ি ফিরছিল। ভেবেছিল পরিবারের লোকের সঙ্গে দেখা করে রাতারাতি গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু সে আশা আর তার পূর্ণ হয় নি। গ্রাম পাহারায় থাকা গণমঞ্চের লোকেদের চোখে পড়ে যায়। বোমা-বন্দুক নিয়ে রে-রে করে দু'জনকে তেড়ে যায় তারা। প্রাণ বাঁচাতে অন্ধকারে প্রাণপণ ছুট লাগায় দুই বন্ধু। কিন্তু প্রাণ বাঁচে না। কিছুটা দুরত্বের ব্যবধানে হোঁচট লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দু'জনে। আর সেইসময় পিছনে থেকে তাদের উপরে এসে পড়ে বোমা। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে ছড়িয়ে পড়ে মরণ আর্তনাদ।


                       সেই আর্তনাদ শুনেই সব কিছু তুচ্ছ করে স্বামীকে নিয়ে ছুটে যান সাইফুন্নেসা। তারপর থেকেই ছেলের মৃতদেহ আঁকড়ে কেঁদেই চলেছেন তিনি। ততক্ষণে এসে পড়েছেন হাসানের মাও। তিনিও ছেলের মৃতদেহ আঁকড়ে সমানে কেঁদে চলেন। দুই মায়ের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে মির্জাপুর গ্রামের বাতাস। মিনহাজের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনতে শুনতে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় দেবদত্তর। সৌমেনকে নিয়ে যখন সে গ্রামে পৌঁছোয় তখন আলো ফুটিফুটি ভোর। বাইরের পৃথিবীতে আড়মোড়া ভাঙ্গছে মানুষ। কেবল মির্জাপুর গ্রামের মানুষের চোখে রাত্রি জাগরণের ছাপ। স্কুলবাড়ির সামনেই পড়ে রয়েছে ছিন্নভিন্ন দুটি দেহ। দাঁতের পাটি, মাথার ঘিলু , হাত পায়ের আঙুল সহ বিভিন্ন দেহাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন বাড়ির দরজায় বোমা বিস্ফোরণের চিহ্ন। সেইসব ছবি তুলতে তুলতে ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গ্রামের ভিতরে ঢোকে তারা। কিন্তু যাকেই জিজ্ঞেস করে সবার এক ' রা।' সবাই এক বাক্যে বলে , ' ওরা গ্রাম দখল করতে এসেছিল। তারপর তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে নিজেদের বোমা ফেটে মারা গিয়েছে। ' সবার এক সুর শুনে বিস্মিত হয়ে যায় দেবদত্ত। সবার একসুর হওয়াটা আশ্চর্য নয়। সেক্ষেত্রে সকলকেই প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়। কিন্তু অত রাতের ঘটনা গ্রাম পাহারায় থাকা পুরুষদের পক্ষে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হলেও মহিলাদের পক্ষে তো জানা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া বাকিরা শোনা কথা বলছেন। কিন্তু সেক্ষত্রে সবার পক্ষে একই রকম নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া কি করে সম্ভব ? 


                  প্রশ্নের উত্তরটা অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই গ্রামের গণমঞ্চের পার্টি অফিসের কাছে গিয়েই পেয়ে যায় সে।কিছুটা দুর থেকেই দেখতে পায় পার্টি অফিসের কাছে দাঁডিয়ে রয়েছে এম,এল,এ সজল রায়ের দুধ সাদা অ্যাম্বাসেডর। সেটা দেখেই সৌমেন বলে ওঠে , ' কি দাদা এবার বুঝতে পারলে কেন সব শিয়ালের এক ' রা।' সজলদাই রাতারাতি এসে সবার মগজ ধোলাই করে রেখেছেন। ' 

' তাই তো দেখছি। চলো উনি নিজে কি বলেন দেখি। '

পার্টি অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সজলবাবুক এগিয়ে এসে বলেন , ' আরে এসো এসো , তোমাদেরই অপেক্ষা করছিলাম। কি ভয়ংকর কান্ড দেখ দেখি। ' 

' হ্যা দাদা কান্ড তো খুব ভংয়কর দেখছি। আপনি তো দেখছি অন্ধকার থাকতেই পৌঁচ্ছে গিয়েছেন। আবার বলছেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। ব্যাপারটা কি বলুন দেখি ? '

' এই দেখ ব্যাপার আবার কি হবে ? তোমরা ভোর ভোর আসতে পারো আর আমি এলাকার বিধায়ক হয়ে আসতে পারি না ? ' 

' সে আপনি নিশ্চয় পারেন । কিন্তু সচরাচর তো আপনাকে দেখি না ? ' 

' বা রে যাদের ভোটে আমি বিধায়ক হয়েছি তাদের এতবড়ো বিপদে ছুটে আসব না ? ' 

' বিপদটা কিন্তু যারা আপনাকে ভোট দেন তাদের হয় নি। আপনাদের বিপক্ষ দলের হয়েছে। ' 

' হয়নি , কিন্তু হতে তো পারত! , 

' বেশ বাদ দিন ওসব কথা , আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কেন বলুন ? ' 

' বিপক্ষদলের লোকেরা বলে বেড়াচ্ছে আমরা নাকি ওদের বোমা মেরেছি। তোমরা যাতে 

ওদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে না পড়ো সেইজন্যই আসল ব্যাপারটা জানাব বলে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। '

' বেশ বলুন শুনি আসল ব্যাপারটা কি ? ' 

' ওইসব বোমা মারার অভিযোগ ভিত্তিহীন। আসলে অরুনোদয় পার্টির লোকেরা বহিরাগত দুস্কৃতি নিয়ে গ্রাম দখল করতে এসেছিল। আমাদের লোকেরা টের পেয়ে তাড়া করে যায়। তাড়া খেয়ে বোমার ঝোলা হাতে পালানোর সময় পড়ে গিয়েই বিস্ফোরণে মারা যায়। '

' আপনি মৃতদেহের পজিশন দেখেছেন ? ' 

' দেখাদেখির কি আছে ?  এমন কিছু সুকর্ম করে ওনারা মৃত্যুবরণ করেন নি যে দেখতে যেতে হবে। তাছাড়া দেখতে গেলেই তো ওরা হয়তো আমার নামেই খুনের অভিযোগ চাপিয়ে দেবে। ওদের যিনি নেত্রী , তিনি তো আবার তিলকে তাল করতে পারেন ভালো। '

' কিন্তু দাদা মৃতদেহের যা পজিশন তাতে মনে হয় না নিজেদের ঝোলার বোমা ফেটে মৃত্যু হয়েছে। তেমনটা হলে তো ওদের সামনের দিকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওদের আঘাত তো পিঠে। স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় না কি পিছন থেকে ওদের পিঠে বোম মারা হয়েছে ? ' 


                   প্রশ্ন শুনে কিছুটা যেন ভড়কে যান সজলবাবু। কিন্তু সামলে নিতেও সময় লাগে না তার। দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া ঘাঘু রাজনীতিবিদ বলে কথা। তার উপরে দীর্ঘদিন বিধায়ক পদে রয়েছেন। তাই সহাস্যে বলেন , ' আরে সেই কথাটা বলার জন্যই তো তোমাদের প্রতীক্ষা করছিলাম। জানতাম তোমাদেরও ভুল ধারণা হবে। 

' ভুল ধারণা ? ' 

' আলবাৎ ভুল ধারণা। খ েলার পরিভাষায় সেমসাইড গোল বলে একটা কথা আছে জানো তো ? ' 

' সেমসাইড গোল মানে ? ' 

' ওই যে বললাম গ্রাম দখলের জন্য ওরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দুস্কৃতি ভাড়া করে এনেছিল। তা সবাই তো সবাইকে চেনেও না। ওদের দু'জনকে আমাদের লোক ভেবেই হয়তো বহিরাগত দুস্কৃতিরাই বোম মেরে দিয়েছে। '

সজলবাবুর যুক্তি শুনে ' থ ' হয়ে যায় দেবদত্ত। মনে মনে ভাবে এরা পারেনও বটে। মুখে অবশ্য কিছু বলে না। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে পার্টি অফিস থেকে। সেখান থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছোতেই দেখে পুলিশ মৃতদেহ ময়না তদন্তে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। দুই মা তখনও ছেলের মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে কেঁদেই চলেছেন। সাইফুন্নেসাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে ছোট ছেলে ফুলসাদ। ফুলসাদ রাজনীতির ধারে পাশে থাকে না। দিল্লিতে কাপড়ে নক্সা তোলার ব্যবসা আছে তার। কিন্তু ইন্তাজের মৃত্যুর সময় বাড়ি এসে তারও আর ফিরে যাওয়া হয় নি। দেবদত্তকে দেখেই দু'হাত জড়িয়ে ধরে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে  সাইফুন্নেসা। অবরুদ্ধ গলায় বলেন , '  বাপ গণমঞ্চের হার্মাদরা আমার দুই ছেলেকে খুন করে দিল। তোমরা এর একটা বিহিত কর। ' 

কথাটা শুনে খুব অস্বস্তিতে পড়ে যায় দেবদত্ত। সেদিন রূপসা গ্রামেও তার হাত ধরে একই কথা বলেছিলেন বৃদ্ধা। সে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিল। বলতে পারে নি , ' বিশ্বাস করুন বিহিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা বড়োজোর নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে আপনাদের কথা তুলে ধরতে পারি। ' 

আজও কিছু বলতে পারে না সে। বৃদ্ধার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দেয়। মিনহাজও তার হাত ধরে বলে , ' কি বলব আর দাদা , সবই তো আপনারা বুঝতে পারছেন। আমরাও তো সব বাইরে ছিলাম। ভাইয়ের মাটি হয়ে গেলে আবার পালাতে হবে।মহিলারা সব থাকবে। আপনারা একটু দেখেন । ' 


                          মিনহাজকেও কিছু বলতে পারে না দেবদত্ত। তার হাতটা নাড়িয়ে দিয়ে ঘটনাস্থল ছেড়ে আসে। মোটর বাইকে আসতে আসতেই সজলবাবুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। একে বারে হতদরিদ্র পরিবারের মানুষ হয়েও বিধায়ক হওয়ার পর  দৃষ্টিকটু ভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন। প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রীর সরকারি চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছেন। সেই নিয়ে পার্টির একাংশের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে এবারে নাকি আর তাকে টিকিট দেবে না দল। এতদিন সুরঞ্জন সেনগুপ্তের দাপটে কোনঠাঁসা হয়েছিলেন। সুরঞ্জন সেনগুপ্ত জেলে যাওয়ার পর থেকেই প্রায় সব জায়গায় মুখ খুলতে দেখা যাচ্ছে তাকে। আর সব জায়গাতেই একই রকম কুটনৈতিক কথা বলছেন। এইতো সেদিন মালঞ্চ গ্রামেও একই রকম কথা শোনা গিয়েছে তার মুখে। মালঞ্চ গ্রামে দুই খুড়তুতো ভাই অঞ্জন  দাসগুপ্ত আর রঞ্জন দাসগুপ্তদের দাপটে গণমঞ্চ কার্যত হালে পানি পায় না। তার উপরে ' শত্রুর শত্রু আমার মিত্র 'র নীতি মেনে গণমঞ্চের বিরোধী অন্যান্য দলগুলিও গোপনে দুই ভাইকে মদত যোগায়। দুই ভাই আবার সজলবাবুদের দলেরই মেজ শরিক 'সমরাঙ্গন' দলের নেতা। শরিকদলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতার চেয়ার দখল করলেও শরিকদলের বাড়বাড়ন্ত সজলবাবুদের নাপচ্ছন্দের। বরং সজলবাবুদের দলের অভ্যন্তরীণ নীতিই হলো মাৎস্যন্যায়ের মতো। কিন্তু ওই এলাকায় সজলবাবুদের লোকেদেরই গিলে খেয়ে নেয় দুই ভাই। তাই মোক্ষম কুটনৈতিক চালটা চেলে দেয় তারা। সবেতেই দাদাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে গণমঞ্চের নেতারা। তাই দাদার কাছেই লোকজন বেশী ঘেষতে শুরু করে। 


               স্বাভাবিক ভাবেই দুই ভাইয়ের মধ্যে শুরু হয়ে যায় দ্বন্দ্ব। সেটাকেই আরও বাড়িয়ে দিতে বড় ভাইকে পঞ্চায়েত সমিতির কর্মকর্তার পদ দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেন সজলবাবুরা৷ তারপরই দুই ভাইয়ের সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে ৷ তারই জেরে দোলযাত্রার দিন ভাইকে নিকেশ করতে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে দেয় দাদা। ভাই ছুটে ঘর ঢুকে যায়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় তিন গ্রামবাসীর। সেদিনও ওই গ্রামে গিয়ে কর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে সজলবাবুকে দাঁডিয়ে থাকতে দেখে সে। তাদের দেখে এগিয়ে এসে তিনি বলেন , ' এসো আসল কথাটা বলব বলেই তোমাদের জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছি। '

' কিসের আসল কথা ? '

' এই যে দেখ না, বিরোধীরা গ্রাম দখল করতে গিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কেমন নিরীহ গ্রামবাসীদের মেরে ফেলল। ' 

' কি বলছেন দাদা , এই এলাকায় বিরোধী কোথায় ? সবই তো আপনাদের দলের দুই শরিক আর দুই খুড়তুতো ভাইয়ের রাজনৈতিক অস্তিত্ব জাহিরের লড়াই। বিরোধীদের অস্তিস্বই তো নেই ? '

' আরে সেটাই তো ব্যাপার। অস্তিত্ব নেই বলেই তো অস্তিত্ব অর্জনের জন্য এই হিংস্র আক্রমণ। ' 

সেদিন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে নি দেবদত্ত। মুখ ফসকে বলে ফেলে , ' দাদা আপনারা পারেনও বটে। '

শ্লেষটা অবশ্যটা গায়ে মাখেন না সজলবাবু। মৃদু হেসে বলেন , ' ঠিক বলছো ভাই। আমাদের অনেক কিছু পারতে হয়। '



                                              ( ক্রমশ ) 

No comments:

Post a Comment