Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কীর্তি যস্য -- ১৩ ( বদরুদ্দোজা)




                                                   



 প্রতিবন্ধকতা জয় করেও খেলোয়াড় গড়ে চলেছেন                             বদরুদ্দোজা



                                                                       
                                                                     

                       অর্ঘ্য ঘোষ 



শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সোঁজা হয়ে চলা দুরের কথা দাঁড়ানোরও ক্ষমতা ছিল না। তাই দেখে আত্মীয়রা কেউ বলেছিলেন , ও খাবে কি  করে ? দাও ওকে কোন মসজিদে পাঠিয়ে। মৌলবি হলে দুটো খেতে পড়তে তো পাবে। কেউ বা বলেছিলেন আরব পাঠিয়ে দাও। ভিক্ষা করে খেতে পারবে। কিন্তু প্রতিবন্ধী বালকটি  গর্জে উঠেছিল -- না , মৌলবীগিরি কিম্বা ভিক্ষা করে আমি কারও দয়ায় বেঁচে থাকতে  চাই না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকতে চাই।সেদিন সেই বালকের কথা শুনে মুচকে হেসেছিলেন আত্মীয়রা। কিন্তু অনমনীয় জেদের কাছে প্রতিবন্ধকতা যে কোন ব্যাপারই নয় তা আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছেন সেদিনের সেই বালক। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাগৃহে তাকে প্রতিবন্ধীদের রোল মডেল হিসাবে পুরস্কৃত করেছে। হার না মানা সেই বালকটির নাম  বদরুদ্দোজা সেখ। 




              ১৯৬১ সালের ২৫ জানুয়ারি নলহাটির সোনারকুন্ডু গ্রামে এক প্রান্তিক চাষি পরিবারে জন্ম বদরুদ্দোজার।দুই ভাই এক বোন , সবাই জন্ম প্রতিবন্ধী। তাই করুণা আর অবহেলা ছোট থেকেই সঙ্গী তাদের। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই লড়াকু মনোভাব বদরুদ্দোজার। প্রতিবন্ধকতা থাকলেও খেলার প্রতি সেই ছেলেবেলা থেকেই তার তীব্র অনুরাগ। তাই নিয়মিত মাঠে যেতেন। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে  সাধারণ ছেলেরা তাকে খেলা নিতেন না। তাই নিজেই মূলত আদিবাসী ছেলেদের নিয়ে নলহাটি ইভেন গাঁওতা নামে একটা শক্তিশালী ফুটবল দল গড়ে তোলেন।একসময় সেই দল জেলা তো বটেই, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মাঠ সুনামের সংগে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। টিম নিয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে তিনিও ছুটে গিয়েছেন সর্বত্র।  ওই দলে খেলার সুবাদে বেশ কিছু ছেলে বিভিন্ন জায়গায় সরকারি চাকরিতে বহাল হয়েছেন। চাকরি পেয়ে ভদ্রস্থ জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছেন তারা।   

                                                                            
        
                                 শুধু তাই নয় , ১৯৮১ সালে প্রতিবন্ধী  ছেলেমেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন অবৈতনিক সাঁতার এবং আথলেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রতিবন্ধকতা স্বত্ত্বেও দুই ক্রীড়া শিক্ষক স্বপন লেট,  কার্তিকচন্দ্র মণ্ডল এবং অরূপ দাসের সহয়তায় আজও প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েই প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েরা জাতীয় সহ বিভিন্ন স্তরের প্রতিযোগিতায় ২৯ টি সোনা, ২২ টি রূপো এবং ৮ ব্রোঞ্চ পদক ছিনিয়েএনেছে। ২০১৫ সালে ক্রীড়ানুরাগীদের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন ফাইচার স্পোর্টসঅ্যাকাডেমী। মাত্র ২০ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে পথ চলা শুরু হয়। বর্তমানে সেই সংখ্যা২৫০ জন ছাড়িয়ে গিয়েছে । তার মধ্যে ৫০ জন ছেলেমেয়ে প্রতিবন্ধী। সপ্তাহে ৪ দিন সহ প্রশিক্ষকদের নিয়ে তাদের বিনা পারিশ্রমিকে কয়থা , নলহাটি , হরিদাসপুর এবং রামপুরহাট বালিকা বিদ্যালয়ে সাঁতার , অ্যাথলেটিক্স , খো-খো , ফুটবল , ভলিবল সহ বিভিন্ন খেলার প্রশিক্ষণ দেন। ওই অ্যাকাডেমীর ছেলেমেয়েরাই ২০১৯ সালে ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত সংশ্লিষ্ট রামপুরহাট মহকুমা স্তরের প্রতিযোগিতায় অ্যাথোলেটিক্সে ছেলেমেয়ে উভয়েই চ্যাম্পিয়ান এবং জেলা স্তরের প্রতিযোগিতায় মেয়েরা চ্যাম্পিয়ান হয়েছে।



                 
             তার কাছেই প্রশিক্ষণ নিয়েই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় স্তরের প্যারা অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় ৯ টি সোনা , ৭ টি রূপো এবং ১ ব্রোঞ্চ পদক পেয়েছে নলহাটির সামিমা খাতুন। স্থানীয় কোগ্রামের সুপর্ণা মাল ৬ টি সোনা , ১১ টি রূপো এবং তিনটি ব্রোঞ্চ পদক পেয়েছে । স্থানীয় কুসুমজলির অর্চনা হেবব্রম ৫ টি সোনা , ৩ টি রূপো এবং ২ টি ব্রোঞ্চ পদক পেয়েছেন।অথচ একদিন তারা পদক জয় তো দুরের কথা , প্রতিবন্ধতা কাটিয়ে  কোনদিন খেলার মাঠেৎনামার কথা  স্বপ্নেও ভাবতে নি। বদরুদ্দোজাই  তাদের উৎসাহ দিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। নুন আনতে পান্তা ফুরানো পরিবারের ওইসব  মেয়েদের বাইরের প্রতিযগিতায় অংশ নিতে পাঠানো আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে। প্রশিক্ষণের দেওয়ার পাশাপাশি তিনিই ওইসব মেয়েদের দুরদুরান্তে বিভিন্নপ্রতিযোগিতায় নিয়ে যান। থেকে বড়ো কথা তার অনুপ্রেরণাতেই ওইসব ছেলেমেয়েরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবল ফিরে পেয়েছে। যা তাদের পরিবারের লোকেরাও পারেন নি। তার নিষ্ঠা দেখেই অন্যান্য প্রশিক্ষকরাও স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকে।  
                     

  
                                           শুধু ক্রীড়া ক্ষেত্রেই নয় , প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়েও তিনি সমান সক্রিয়। ন্যাশানাল প্ল্যাটফর্ম ফর দ্য রাইট অফ দ্য ডিজায়েবল সংগঠনের তিনি সর্বভারতীয় কার্যকরী সভাপতি তথা জেলা সম্পাদক। জীবিকার ক্ষেত্রেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একদিকে পড়াশোনা অন্যদিকে সেলাইয়ের কাজ শেখা সমান তালে চালিয়ে গিয়েছেন। সকালে বাড়িতে পান্তা খেয়ে বেরোতেন। মা কৌটোয় চাট্টি মুড়ি-  পিঁয়াজ ভরে দিতেন। আর চপ কিম্বা ঘুগনি কেনার জন্য দিতেন ১০ টা পয়সা। তাই নিয়ে বালক বদরুদ্দোজা প্রতিদিন ৯ কিমি হেঁটে নলহাটি বাজারে সেলাই শিখতে যেতেন। তারপর পিঁয়াজ আর জল ভিজিয়ে মুড়ি খেয়ে ১০ পয়সা বাঁচিয়ে বোনের জন্য খাতা পেনসিল কিনে নিয়ে যেতেন। সেই বোন এখন শিশুশিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষিকা।



                                                    ফিজ দাখিলের টাকার অভাবে নিজের অবশ্য প্রথমবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা হয় নি। পরে টাকা যোগাড় করে পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। বছর দুয়েক সেলাই শেখার পর তদানীন্তন ম্যানেজার ক্রীড়াবিদ লোকনাথ দে'র সহয়তায় ব্যাংকের মাধ্যমে  ১০৫০ টাকার একটা মাত্র সেলাই মেসিন নিয়ে নলহাটি রেললাইন সংলগ্ন এলাকায় স্বাধীনভাবে সেলাইয়ের দোকান শুরু করেন। পাশাপাশি দীর্ঘ দরজি জীবনে বহু প্রতিবন্ধী  ছেলে-মেয়েকে হাতে ধরে সেলাই শিখিয়ে স্বনির্ভরও করেছেন তিনি। সেই ব্যবসা থেকেই স্থানীয় নজরুল পল্লীতে দোতলা পাকা বাড়িও করেছেন। বাড়িতেও তৈরি করেছেন সেলাইয়ের কারখানাও। সেখানে ১০ জন কারিগর কাজ করেন। ২০১২ সালে স্ত্রী সাজেদাকে হারিয়েছেন। দুই ছেলে বৌমা নাতি  নাতনিদের নিয়ে তার ভরা সংসার। মনের জোরে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বদরুদ্দোজা রোল মডেল হয়ে উঠেছেন। তাই বিভিন্ন সময় তাকে  সংবর্ধনা জানিয়েছে রামপুরহাট আই , এন , টি , ইউ, সি  , খোলা হাওয়া সহ বেশ কিছু সংগঠন।তিনি আজ শুধু প্রতিবন্ধীদের নয় , সক্ষম মানুষজনের প্রেরণাস্থল হয়ে উঠেছেন। আজ আর অবশ্য নিজে সেলাইয়ের কাজ করার সময় পান না। ছেলেরাই সেই কাজ করেন। তবে তা নিয়ে অবশ্য পরিবারের লোকেদের কোন অনুযোগ নেই বরং সবাই উৎসাহই যোগান তাকে।তার দুই ছেলে সায়িন এবং সানজারি জানিয়েছেন , বাবা শুধু প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদেরই নয় , আমাদেরও দাঁড় করিয়েছেন। তাই বাবার জন্য আমাদের গর্ব হয়। বদরুদ্দোজা অবশ্য  সবিনয়ে জনিয়েছেন , জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এভাবেই লড়াই করে যেতে চাই।



                                          ----০----




     নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                    


অর্পিতা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সালিশির রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর কথা ও কাহিনী---  







দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে -----







                   ----০---







No comments:

Post a Comment