বিয়ের একাল সেকাল- ২
অর্ঘ্য ঘোষ
( চার চাকার দাপটে পালকি -গরুগাড়ির দিন শেষ )
বদলে গিয়েছে বিয়ের বাহনও। একসময় বিয়ের বাহন বলতে ছিল পালকি আর গোরুর গাড়ি। সেসব আজ ইতিহাস।প্রবীণদের ধূসর স্মৃতিতে আজও ভাসে সেইসব দিনের ছবি।হেডলাইটের মতো সামনে ঝুলছে টিমটিমে হ্যারিকেন। ক্যাঁচোর কোঁচর শব্দ তুলে গ্রামের মেঠো পথ ধরে মন্তর গতিতে চলছে খান দশেক গোরুর গাড়ি।আর কখনও তার সামনে আবার কখনও অদুরের আল পগাড় ভেঙ্গে চলেছ, ছয় বেহারা 'হুহুম না’র দল।ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া গ্রামের রায়বাড়ি থেকে গোরুর গাড়ির ওই কনভয় যাবে প্রায় ১৫কিমি দুরে মুর্শিদাবাদের যুগসড়া গ্রামের নায়েক বাড়ি। নায়েকবাড়ির বড়মেয়ে রিঙ্কুর সঙ্গে রায়বাড়ির একমাত্র ছেলে তপনের যে বিয়ে। সে ১৯৭৮ সালের কথা।বছর ছয়েক আগেই তপনবাবুর একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়েছে কিলোমিটার আটেক দুরে মুর্শিদাবাদেরই বেলগ্রামে। চারচাকার গাড়ি এবং বাস নিয়ে ছেলের বিয়ে দিতে গিয়েছিলেন তপনবাবু। ছেলে এবং নিজের বিয়ের স্মৃতি আজও নষ্টালজিক করে তোলে তাকে। স্মৃতির সেই চাদর সরিয়ে তিনি জানান , গোরুর গাড়ি আর পালকির বিয়ের মজাটাই ছিল আলাদা।
( হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের মানুষের রান্নার দৃশ্য )
বিয়ের একমাস আগে থেকই প্রয়োজন মাফিক গ্রামের বনেদী গৃহস্থদের গরুর গাড়ির জন্য বলে রাখা হত। বায়না দেওয়া হত পালকি বেহারাদেরও। বিয়ের দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেত তোড়জোড়। পালকি নিয়ে হাজির হত বেহারার দল। টপ্পরে ( ছই ) ত্রিপল চাপিয়ে প্রস্তুত করা হত গাড়ি। স্নান করিয়ে শিং’এ সরষের তেল মাখিয়ে গরুগুলিকে ‘দেখনসই’ করে তোলার জন্য নিজ নিজ ‘ বাগাল’ বা ‘মাহিন্দার’কে নির্দেশ দিতেন গৃহস্থরা।তারপর অনেকটা সময় হাতে নিয়ে বেরোত বর আর বরযাত্রীর দল। অনেকক্ষেত্রে ঘটনা এমনও ঘটেছেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিম্বা বেহাল রাস্তার কারণে শেষ লগ্ন পার হওয়ার উপক্রম দেখে কন্যাপক্ষের বাড়ি লোকেরা গিয়ে মাঝপথ থেকে বরকে পাঁজাকোলা করে ছুটে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন ছাতনাতলায় ।এখন গ্রামে গ্রামে তৈরি হয়েছে রাস্তা বাস,চার চাকার গাড়ি,টোটো সহ বিভিন্ন গাড়ির চল বেড়েছে। বাসমালিকের কাছে গেলেই হদিশ মিলছে বরের গাড়ির, ছোটগাড়ির মালিকেরা যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন বাস মালিকের সঙ্গে। এমনিতেই পাওয়ার টিলার , ট্রাক্টরের দাপটে গৃহস্থের গোয়াল থেকে হারিয়ে গিয়েছে গরু। নকশা করা টপ্পরের গরুর গাড়িরও দেখা মেলে না আর। কাজ হারিয়েছেন পালকি বাহকেরা একসময় নানুরের উচকরণে পালকিপড়া নামে একটি পাড়াই ছিল। ওই পাড়ার অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা পুরুষানুক্রমে পালকি বাহকের কাজ করতেন। ৭২ বছরের ক্ষুদিরাম বাউড়ি , ৬৫ বছরের কানন বাউরিরা জানান , বাস আর গাড়ির দাপটে আমরা কোনঠাঁসা হয়ে পড়েছি। দীর্ঘদিন ধরে কোন ডাকই আসে না।মাঝখান থেকে অব্যবহারে পড়ে থেকে ঘুণ আর উঁই পোঁকায় কাটছে বাপ ঠাকুরদার আমলের পালকি।
( টেবিল-চেয়ারের দৌলতে ছবি গিয়েছে একাসনে বসে খাওয়ার সেই দৃশ্য )
শুধু বাহনই নয় , বদল ঘটেছে ছাতনা তলা , মেনু থেকে সানাই’এর আবহও। একসম গোবর নিকানো উঠানে চারটে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে তৈরি হত ছাতনাতলা ।এখন প্রায় প্রতিটি বিয়ে বাড়িতেই শোলা থার্মোকল , বুলেনের তৈরি ছাতনা তলায় টিপটিপ করে জ্বলতে দেখা যায় রংবেরঙের টুনি লাইট।অথচ একসময় বৈদ্যুতিক আলো গ্রামাঞ্চলে দেখাই যেত না। বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের ঢেকা পঞ্চায়েত এলাকায় বছর চল্লিশেক আগে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রথম বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে লোকপাড়ার ঘোষবাড়ির ছোট মেয়ে অনুভার বিয়েতে। ওই বাড়ির বর্তমান কর্তা শিবপ্রসাদ ঘোষ জানান , সেই আলো দেখতে ১০/১২ টি গ্রামের মানুষ সেদিন ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তাদের মধ্য অনিমন্ত্রিতরাও ছিলেন। অনুরোধ করে তাদের অনেককেই এক পঙক্তিতে বসানোও হয়।
( আজও রয়ে গিয়েছে )
কুড়ি পঁচিশ বছর আগেও অবস্থাপন্নদের বাড়িতে তোরণদ্বারের মাথায় তৈরি হত নহবত খানা। বাঁশের মই বেয়ে সেই নহবত খানায় ওঠে সানাই’এর সুর তুলতেন শিল্পীরা । তখন সানাই’এর সুর শুনেই মনে পড়ে যেত পাড়ার বিয়েরবাড়িটির কথা। মন মোহিত হয়ে যেত। এখন সেই ধারা বদলে গিয়েছে। সংস্কৃতি সচেতনরা তবু সানাই’য়ের ক্যাসেট ,সিডি বাজান। বাকিরা ডি’জে বক্সে তারস্বরে চালিয়ে দেন চটুল কোন গান। বোঝাই যায় না সরস্বতী পুজো না পিকনিক পাটি চলছ।সবসময় মনে হয় পালাই পালাই। মেনুতেও পরিবর্তন ঘটেছে। একসময় বেশিরভাগ বিয়েতে পেট পুরে লুচি , কুমড়োর ছক্কা , মিষ্টি খাওয়ানোর চল ছিল। পরে মাছ, ভাত , তরকারি , টকে, দই, মিষ্টিতে আপ্যায়িত হতেন নিমন্ত্রিতরা। এখন চাইনিজ, মোগলাই ,পোলাও মাংসের ছড়াছড়ি। কোন কোন বিয়ে বাড়িতে মেলার মতো জুতো পালিশ, সেলুন থেকে শুরু করে চা-ফুচকার স্টলও বসিয়ে দেওয়া হয়। পেট ভরলেও হাল আমলের ওইসব খাবারে যেন মন ভরে না লোকপাড়ার অবনীতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় ,জীবন বন্দ্যোপধ্যায়দের। ভরপেট খাওয়ার পরেও একটি ভোজে ৮০ টি বড় সাইজের রাজভোগ খেয়েছিলেন অবনীবাবু। তিনি জানান , এখনকার প্রজন্মের খাওয়ার সেই ক্ষমতা কোথাই ? অধিকাংশই সুগার কিম্বা অম্বলে ভোগেন। ভোজবাড়িতে অ্যাণ্টাসিড সঙ্গে নিয়ে যান। জীবনবাবু জানান , লোকপাড়ার ঘোষবাড়ির বড়ো ছেলে প্রভাত ঘোষের বিয়ে হয়েছিল ছামনার মজুমদার বাড়িতে। সেই বিয়েতে দেড় শতাধিক বরযাত্রীর প্রত্যেকের পাতায় দেওয়া হয়েছিল একটা করে নুন্যতম ৫ কেজি সাইজের মাছের আস্ত মাথা। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না ওই ভোজে কত বিপুল পরিমাণ মাছের ব্যবহার হয়েছিল। ছেলে মেয়ের বিয়ের সময় সেই সময় পুকুরে বড় বড় মাছ পুষে রাখা হত।
গুরুত্ব হারাচ্ছে ঢেলাইচণ্ডী , দ্বারবন্ধন , বাটা চুরি , বন্ধু পরিচয়ের মতো অনুষ্ঠানগুলিও। একসময় বর নিয়ে বরযাত্রীর দল বিয়ের আসরে ঢুকলেই আড়াল থেকে শুরু হয়ে যেত ছোট ছোট ঢিল বৃষ্টি। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের ঢেলাইচণ্ডী ঠাকুর বা কোন উন্নয়নের জন্য চাহিদা মতো টাকা আদায় করা।পাত্রপক্ষ চাহিদা মাফিক টাকা দিতে রাজী না হওয়া পর্যন্ত চলত ঢিল বৃষ্টি। অনেক সময় তাই নিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড বেঁধে যেত। তখন প্রবীণদের আসরে নেমে দু’পক্ষকে বুঝিয়ে পরিস্থিতির সামাল দিতে হত। একই ঘটনা ঘটত দ্বারবন্ধনের ক্ষেত্রেও। বিয়ের অন্যান্য কাজ সারা হওয়ার পর সিঁদুরদানের আগে পাত্রীকে নিয়ে তার বোন বা অন্যান্য মেয়েরা ঘরে খিল দিতেন।সিঁদুর দানের জন্য বন্ধুদের নিয়ে পাত্রীকে আসরে আনার দায় বর্তাত পাত্রের উপর। কিন্তু সেখানেও চাহিদা মতো টাকা না পেলে দরজা খোলা হত না। শেষে অনেক দরদস্তুর করার পর নগদ টাকা নিয়ে তবেই দরজা খুলতেন পাত্রীপক্ষের মেয়েরা। এজন্য কোথাও কোথাও দ্বারবন্ধনকে কপাট খোলার অনুষ্ঠানও বলে।কপাট খুলেই অবশ্য রেহাই মিলত না বরের। কারণ কপাট খোলার আগে আরও কয়েকজনের সঙ্গে চাদর কিম্বা কম্বল ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়তেন কনে। তাদের মধ্যে থেকে আন্দাজে কনেকে বেছে নিতে হত বরকে।অনেক সময় দেখা যেত কনের বদলে তার বোনের হাত ধরে বোকা বনে গিয়েছেন বর। আর তখন সবাই হাততালি দিয়ে বরকে আরও লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। ওই অনুষ্ঠান থেকেই শালী-জামাইবাবুর হাসি-ঠাট্টার মধুর সম্পর্কের সুত্রপাত ঘটে বলে অনেকে মনে করেন।
বাটা চুরির অনুষ্ঠানও এক সময় বিয়ের আসরে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল । অনুষ্ঠানটা সাধারণত অষ্টমঙ্গলায় কিম্বা বৌ নিয়ে বর নিয়ে বাড়ি ঢোকার পর ছাদনাতলায় অনুষ্ঠিত হয়। ছাদনাতলায় চার কোনে চারটি ঘট আতপ চাল , কড়ি , গোটা হলুদ এবং তামার পয়সা বাটা দিয়ে ঢাকা থাকে। বর-বৌ পর্যায়ক্রমে ৭ বার করে ছাদনাতলা প্রদক্ষিণের পাশাপাশি একজনকে একটি করে বাটা খুলে মাটিতে নামিয়ে রাখতে হয় , অন্যজনকে তা তুলে ঢাকা দিতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় দুজনকেই তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়। কারণ তাদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ছাতনাতলা ঘিরে থাকা মহিলারা বাটা লুকিয়ে ফেলেন। তখন সেই বাটা খুঁজে বের করতে হয় মূলত বৌকে। কারণ ওই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বৌকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে পারে না বর।তবে যেখানে অষ্টমঙ্গলায় ওই অনুষ্ঠান হয় সেখানে অবশ্য ঘরে ঢোকার বিধি নিষেধ থাকে না। এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়েই নবদম্পতিকে তাদের ভাবী জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটা বার্তা দেওয়া হয় বলে অনেকের অভিমত। তাদের মতে, এভাবেই সজাগ দৃষ্টিতে সংসার রক্ষার পাশাপাশি একজন বেহিসাবী হয়ে সংসার বেসামাল করে ফেললে অন্যজনকে তা এভাবেই সামাল দেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে ওই অনুষ্ঠানে।
গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে বন্ধু পরিচয়ের অনুষ্ঠানও। এই অনুষ্ঠান একান্ত ভাবেই বরের বন্ধুদের অনুষ্ঠান। অন্যদের প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। বৌভাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে যাওয়ার পর বন্ধু আর বৌকে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে ওই অনুষ্ঠান হয়। বর স্ত্রীর সঙ্গে তার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেন। আর সেখানেই বন্ধুরা নববধূর হাতে তুলে দেন উপহার। এজন্যই বোধ হয় ওই অনুষ্ঠানের নাম বন্ধু পরিচয়। তবে শুধু পরিচয় পর্বেই সীমাবদ্ধ থাকে না ওই অনুষ্ঠান। নববধুকে নাস্তানাবুদ করার জন্য কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করেন বন্ধুরা। এজন্য অনেক নববধুকে দু:চিন্তায় পড়তে দেখা গিয়েছে। সদ্যবিবাহিতা বান্ধীদের কাছে থেকে প্রশ্ন সম্পর্কে টিপস নিয়ে রাখার কথাও শোনা গিয়েছে। তবে ওইসব প্রশ্ন অনেক সময় শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তাই অনেক পরিবারে আলাদা করে আর বন্ধু পরিচয়ের অনুষ্ঠান হয় না। অন্যান্যদের মতোই নববধুর সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেন বর।
বদলে গিয়েছে আপ্যায়নের রীতিও। আগে বাড়ির সামনে জোড়হাতে হাসি মুখে গৃহকর্তার দাঁড়িয়ে থাকাটা ছিল আব্যশিক কর্তব্য। এখন সেই ছবি দেখা যায় কালেভদ্রে। তারই মধ্যে অন্য রকম অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন ঢেকার প্রভাকর মণ্ডল। বীরভূমের ময়ূরেশ্বর থানা এলাকার ঢেকা গ্রামের বাসিন্দা প্রভাকরবাবু বছর খানেক আগে ভোজ খেতে গিয়েছিলেন স্থানীয় ঝলকা গ্রামের একটি বিয়েবাড়িতে। তিনি জানান , গিয়ে দেখি যেখানেই কিছু লোক একসঙ্গে গল্পগুজব শুরু করছেন সেখানেই হাজির হচ্ছেন কিছু বয়স্ক মানুষ। তারপর হাত জোড় করে তারা বলছেন , দয়া করে কোন রাজনৈতিক আলোচনা করবেন না। এখানে সব দলের লোকেরাই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছেন। দেখবেন আপনার আলোচনা যেন অন্যের অস্বস্তির কারণ না হয়। অসহিষ্ণুতার আবহে এই’ই বা কম কি? বলা যায় না, হয়তো একদিন এই কাজের জন্যই গড়ে ওঠবে পেশাদারি দল। বদলে অনেক কিছুই কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আজও আমরা বাঁধা পড়ে রয়েছি সনাতনী প্রথায়। হাজার বদল ঘটলেও হিন্দুরীতির আনুষ্ঠানিক বিয়েতে বদল ঘটেনি বৈদিক মন্ত্র আর মালাবদল , সিঁদুর দান প্রভৃতি অনুষ্ঠানের।পুরুষানুক্রমে আজও আমরা সেই সনাতনী মন্ত্রোচারণের মাধ্যমে মালা বদল করেই দাম্পত্য সম্পর্কে বাঁধা পড়ি।
No comments:
Post a Comment