অর্ঘ্য ঘোষ
( এই কলমে এমনই কিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরা হবে যারা নিতান্তই প্রান্তজীবি। বৃহত্তর সমাজে তাদের স্থান নেই বলেলেই চলে। তাদের জন্ম মৃত্যু এমনকি আসল নামও আজ সংগ্রহ করা কঠিন।তাদের পরিবারের লোকেরাও সে তথ্য ঠিকঠাক দিতে পারেন নি।প্রচলিত নামেই তারা আজও এলাকার কারও কারও মনে ধুসর স্মৃতি হয়ে রয়েছেন। স্মৃতির চাদর সরালেই অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। আমার ছোটবেলায় দেখা মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেওয়া ওইসব চরিত্রের সঙ্গে আপনিও মিল খুঁজে পেতে পারেন আপনার দেখা কোন মানুষের মধ্যে )
সেনাপতি কাকুর কথা
( ৬৭ )
জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে এসেছি আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যেবেলায় ১০ / ১২ জন লোক নিয়মিত আসতেন । বাবার সঙ্গে গল্পগুজব করতেন , যাত্রার রিহের্সাল দিতেন , চা-টা খেতেন , বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া করে যেতেন। তাদের বাড়িতেও ভালো কিছু হলে হাতে করে নিয়েও আসতেন। ওইসব লোকেদের আমরা কাউকে কাকু , কাউকে জ্যেঠু আবার কাউকে বা দাদুও বলতাম।কেন জানি না ওইসব কাকু -জ্যেঠুরা বাবাকে রাজা বলে ডাকতেন। স্বঘোষিত সেই রাজ্যসভায় আর কার কি পদ ছিল না মনে নেই , তবে তাদের একজন হলেন মন্ত্রী ঢেকা গ্রামের হারু বাগদি অন্যজন ছিলেন ওই গ্রামেরই সেনাপতি শান্তিকুমার মণ্ডল। সেই সুবাদে ছোটবেলায় আমরা তাকে সেনাপতিকাকু বলেই ডাকতাম।
আসলে শান্তিকাকু ছিলেন খুব ডাকাবুকো ধরণের মানুষ । ভয় ভুতো বিশেষ একটা ছিল না বলেই চলে। বিশেষ করে ছোটবেলায় তার কিছু কার্যকলাপ দেখে তাকে ইতিহাস আশ্রিত সেনাপতিদের মতোই মনে হত আমাদের।সেইসব কথা আজও যেন স্মৃতিপটে ছবি হয়ে আছে।সেসময় অন্য অনেক জিনিসের মতো কেউ কেউ মাঝে মধ্যে হাতে করে কচ্ছপও নিয়ে আসতেন আমাদের বাড়ি। তখন কচ্ছপ সম্পর্কে আমাদের চরম ভীতি ছিল। কারণ সে সময় একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল , একবার কচ্ছপে কামড়ে ধরলে নাকি মেঘ না ডাকলে ছাড়ে না। সেই বয়সে তো সত্যাসত্য বিচারের ক্ষমতা থাকে না।তাই কথাটাকে ধ্রুব সত্য ধরে নিয়ে কচ্ছপ থেকে সাত নয় , কার্যত শত হাত দুরে থাকতাম।
কিন্তু সেনাপতিকাকুকে দেখতাম অকুতোভয়। দিব্যি হাঁড়িতে জল গরম করে কচ্ছপটাকে উল্টো করে ডুবিয়ে দিতেন। তারপর পরিস্কার পরিচ্ছন্নের পর রান্নাও করতেন।আর একটা কথা খুব মনে পড়ে। বাবা তখন নন্দীহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সেখান থেকে একদিন সাপের মতো দেখতে বিরাট এক কাদামাছ নিয়ে ফেরেন তিনি। সেই মাছ দেখে আমরা তো ভয়ে একসা। মা'ও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ওই মাছ কাটাকুটি করা দুরের কথা হেঁসেলে ঢুকতে পর্যন্ত দেবেন না।মাছটিকে নিয়ে বাবা পড়েন চরম দুঃশ্চিন্তায়। তখনও মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসেন শান্তিকাকু। দিব্যি সেই মাছ কাটাকুটি করে মাটির হাঁড়িতে তেঁতুল দিয়ে টক তৈরি করেন। শান্তিকাকু সাধারণত কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। কিন্তু বাবার খুব অনুগত ছিলেন।বাবা কিছু নির্দেশ দিলেই ঘাড় একাশি করে তা পালন করতেন। তাই নিয়ে সেসময় আমাদের একটা চাপা গর্বও ছিল।
যখন সাবালক হই তখন তার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। শান্তিকাকুর ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে অবশ্য সে সময় অনেক প্রশ্নচিহ্ন ছিল।কিন্তু একটা বিষয়ে তার ভূমিকা ছিল প্রসংশনীয়।বহিরাগত কারও দ্বারা এলাকার কেউ কোনভাবে আক্রান্ত হলে তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। সেইজন্য থানা , কোর্ট কিম্বা হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন।আমিও তার কাছে সেই অর্থে ঋণী। আমাকে দু'বার সাপে কামড়ায়। দু'বারই শান্তিকাকু কান্দী হাসপাতালে আমার সঙ্গে ছিলেন।সাপে কামাড়ানো রোগীদের নাকি ঘুমানো বারণ। তাই শান্তিকাকু সারারাত আমার বেডে বসে গল্প করে আমাকে জাগিয়ে রেখেছিলেন। সেইসব কথা আজও ভুলি নি।
( চলবে )
পড়ুন / পড়ান
নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন
১৯ নভেম্বর থেকে প্রতিদিন সকাল ১০ টার মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে
ধারাবাহিক উপন্যাস
সালিশির রায়
সালিশি সভার রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর ঘুরে দাঁড়ানোর , অন্যকে দাঁড় করানোর মর্মস্পর্শী কাহিনী অবলম্বনে ধারাবাহিক উপন্যাস --
খুব কাছে থেকে দেখা আদিবাসী সমাজের এক তরুণীর মর্মান্তিক পরিণতির ঘটনা । একসময় ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল অনেক ঘটনা।সেই ঘটনাই তুলে ধরা হয়েছে এই কাহিনীতে। আদিবাসী সমাজের ভাষা আলাদা , কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ভাবের প্রকাশও আলাদা। কিন্তু দুঃখ , জ্বালা , যন্ত্রণার অভিব্যক্তি মনে হয় মানুষ মাত্রেরই এক।সেই সব জ্বালা যন্ত্রনার অভিব্যক্তি বৃহত্তর সমাজের উপযোগী ভাষা এবং ভাবের প্রকাশ ভঙ্গিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। ত্রুটি -বিচ্যুতি থাকাটাই স্বাভাবিক।তাই সবিনয়ে আগাম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। একটাই প্রার্থনা , ভালো লাগলে বলুন , বলুন খারাপ লাগলেও।ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment