অর্ঘ্য ঘোষ
( এই কলমে এমনই কিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষের কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরা হবে যারা নিতান্তই প্রান্তজীবি। বৃহত্তর সমাজে তাদের স্থান নেই বলেলেই চলে। তাদের জন্ম মৃত্যু এমনকি আসল নামও আজ সংগ্রহ করা কঠিন।তাদের পরিবারের লোকেরাও সে তথ্য ঠিকঠাক দিতে পারেন নি।প্রচলিত নামেই তারা আজও এলাকার কারও কারও মনে ধুসর স্মৃতি হয়ে রয়েছেন। স্মৃতির চাদর সরালেই অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। আমার ছোটবেলায় দেখা মনের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেওয়া ওইসব চরিত্রের সঙ্গে আপনিও মিল খুঁজে পেতে পারেন আপনার দেখা কোন মানুষের মধ্যে )
বিষ্ণুদার কথা
( ৬৮ )
বিষ্ণু'দা শুধু নিজেই প্রান্তজীবি ছিলেন না বরং প্রান্তজীবিদের প্রতিনিধি স্বরূপ ছিলেন। ময়ূরেশ্বরের মহুলা গ্রামে ছিল তার বাড়ি।তার আসল নাম ছিল বিষ্ণু লেট।শিশুশ্রমিক থেকে হয়ে উঠেছিলেন এলাকার বিধায়ক। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের ফেলে আসা দিনগুলোকে কখনোই ভুলতে পারেন নি।বিষ্ণুদার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৯৮ সালে , রামপুরহাট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক অধিকার পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন। তখন তিনি সবে বিধায়ক হয়েছেন। সেই বিষয়ে ওই সময় অধিকার পত্রিকার জন্য একটা সংবাদ করার তাগিদে আমার দুই সাংবাদিক বন্ধু আশিস মণ্ডল আর অশোক রায়ের সঙ্গে তার বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন সি,পি,এম নেতারা সাংবাদিকদের খুব একটা 'পাত্তা-টাত্তা ' দিতেন না। বিশেষ করে ' লোকাল ' কাগজের সাংবাদিকদের তো নয়ই। কিন্তু কট্টর বামপন্থী তথা সি,পি , এমের মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়েও বিষ্ণুদা ছিলেন অন্যধারার মানুষ। প্রথমদিনের আলাপেই সেই পরিচয় আমরা পেয়েছিলাম।
সেদিন তার বাড়ি পৌঁচ্ছে নিজেদের পরিচয় দিতেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়েন বিষ্ণুদা। বড়ো ছেলে নিখিলকে সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি আনতে পাঠিয়ে দেন মল্লারপুর বাজারে। মহিলাদের তেলেভাজা তৈরির নির্দেশ দেন। সংবাদ সংগ্রহ করতে নয় , আমরা যেন তার ছেলেমেয়ের নতুন সমন্ধ করতে গিয়েছি। অস্বস্তি এড়াতে আমরা না- না করতেই উনি বলেন , বেশ তাহলে আর আপনাদের সঙ্গে সংবাদ সংক্রান্ত কোন কথাই বলব না। বলা বাহুল্য এরপর আমরা আর না খেয়ে পারি নি। রীতিমতো চপ-বেগুনি পাঁপড় ভাজা আর মিষ্টি দিয়ে পেট পুরে মুড়ি খেতে হয়েছিল আমাদের। না , ওনার কথা না বলার শর্ত আরোপের জন্য নয় , আসলে তার ওই আন্তরিকতা আমাদের অবিভূত করেছিল। কতজন ওইরকম করে বলতে পারেন ?
( স্ত্রী আশালতাদেবীর সঙ্গে যুবক বিষ্ণুদা )
সেদিনই মানুষটাকে আমার কেমন যেন ভালো লেগে যায়। তারপর বহুবার তার বাড়ি গিয়েছি। সবসময় একই আতিথেয়তা পেয়েছি। শুধু আতিথেয়তাই নয় , নিজের ছেলে কিম্বা অনুগামীদের সঙ্গে দিয়ে সংবাদ সংগ্রহে সাহার্য্য করেছেন। গ্রামেও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। সেইসময় তিনি জমি মালিকদের কাছে চুক্তিতে জমি নিয়ে ভুমিহীন ক্ষেতমজুরদের গোষ্ঠী গঠন করে যৌথপ্রথায় চাষের প্রচলন করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। গ্রামে আদিবাসী-তফসীলি ছেলেমেয়েদের ছাত্রাবাস নির্মাণ , প্রতিটি পরিবারে ১ মুঠো করে চাল জমিয়ে ১২ টি দুঃস্থ তফসীলি সম্প্রদায়ের মেয়েকে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা সহ শিক্ষাবিস্তারে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল তার উদ্যোগ।নিজে নাম স্বাক্ষর হলেও দুই ছেলে নিখিল আর গান্ডীবকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করিয়েছেন। গান্ডীব আই,টি,আই পাশও করেছে। কিন্তু বাবা বিধায়ক এবং তফসীলি সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়া স্বত্ত্বেও তারা আজও বেকার। আজকের শাসকদলের ক'জন নেতানেত্রীদের ছেলে মেয়ে বেকার আছেন জানি না। সেইজন্যই বোধহয় বিষ্ণুদা ব্যতিক্রম।
স্বাক্ষরতা -শৌচাগার - স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়েও তার নেতৃত্বে ওই গ্রাম অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। স্ত্রী - ছেলে পুত্রবধুদের নিয়ে ওইসব সরকারি প্রকল্পে গান বেঁধে বাড়ি বাড়ি প্রচারও চালান তিনি। গ্রামবাসীদের পাশাপাশি স্ত্রী ছেলে-পুত্রবধুদের নিয়ে নাটক , যাত্রা সহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করেছেন। তার ওই যাত্রাপ্রেম নিয়ে তার মুখে শোনা একটা কথা আজও ভুলি নি। বিষ্ণুদা তখনও বিধায়ক হন নি।সেবারে যাত্রার দিন নাকি হঠাৎ গ্রামে বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির হন খোদ এস,ডি,পি'ও। এসেই ধরেন একটি রাজনৈতিক মামলায় অভিযুক্ত ওই যাত্রার অন্যতম অভিনেতাকে। খবর যায় বিষ্ণুদার কাছে।লুঙ্গি আর হাফ হাতা গেঞ্জি পড়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন তিনি। পুলিশ কর্তাকে অনুরোধ করে বলেন , আজ গ্রামে যাত্রা আছে। গ্রামের মানুষ তো আছেই , বাইরে থেকে আত্মীয় স্বজনরা সব আশা করে এসেছেন। ওকে ধরে নিয়ে গেলে সবার আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে। ওকে আজকের মতো ছেড়ে দিন , আমি কথা দিচ্ছি কালই ওকে আপনার হাতে তুলে দিয়ে আসব।বিশ্বাস না হয় আপনিও থাকুন , যাত্রা দেখুন।তারপর না হয় ওকে ধরে নিয়ে যাবেন।বিষ্ণুদার কথা শুনে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে যায় এস,ডি,পি'র। ভাবখানা যেন , কোথাকার কে হরিদাস পাল , যা বলবে তাই শুনতে হবে নাকি ?
( ২০০৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বিষ্ণুদার গানের দল নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ )
তাই বিষ্ণুদার কথায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে তিনি পুলিশ কর্মীদের অভিযুক্তকে গাড়িতে তোলার নির্দেশ দেন। পুলিশ কর্মীরাও তাকে গাড়িতে তোলার উপক্রম করেন। আর যায় কোথাই ? পুলিশের গাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন গ্রামের মানুষ।অবস্থা বেগতিক দেখে এস,ডি,পি'ও তখন উর্ধত্বন কর্তৃপক্ষ আর তদানীন্তন জেলা স্তরের শাসকদলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শাসকদলের নেতারা জানান , ওই গ্রামে বিষ্ণু লেট নামে আমাদের একজন 'কমরেড' আছেন। তাকে বলুন সব সমাধান হয়ে যাবে। বিষ্ণুদা তখন এস,ডি,পি'র সামনে দাঁড়িয়ে।আর এস,ডি,পি,ও তাকেই বলেন , এই গ্রামে বিষ্ণুবাবুকে একটু ডেকে দিতে পারবেন। বিষ্ণুদা তখন বলেন , আমিই বিষ্ণু লেট। বলাবাহুল্য তারপর মধুরেনঃ সমাপয়েৎ।পরদিন ওই অভিযুক্তকে আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়ে জামিনে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন তিনি ।
( বিধায়ক যখন দিনমজুর )
বিষ্ণুদা ছিলেন ওই রকমই। পরের বাড়িতে বাগালি , শিশুশ্রমিক থেকে দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। পঞ্চায়েত , জেলা পরিষদের সদস্য থেকে ময়ূরেশ্বর কেন্দ্রের বিধায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রান্তজনই থেকে গিয়েছিলেন। বিধায়ক হওয়ার পরই যখনই তার গ্রামে গিয়েছি, দেখেছি হয় হাল বইছেন , নয়তো অন্যের জমি সংক্রান্ত বিবাদের মীমাংসায় নিজে হাতে আমিনের নির্দেশ মতো চেন টেনে টেনে মাপ করে বেড়াছেন।পরনে সেই একই ডেস কোড লুঙ্গি আর হাফ হাতা গেঞ্জি। বড়ো জোর সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবী।
( বিধায়ক যখন চাষি )
বিভিন্ন সময় বিষ্ণুদা আমার কাছে মুসকিল আসান হয়ে উঠেছিলেন। সে সময় উনি পাশে না থাকলে আমাকে সত্যি খুব সমস্যায় পড়তে হত।সে সব কথা আজও ভুলি নি।আমি তখন অধিকার পত্রিকা আর সাপ্তাহিক নিউজ চ্যানেল খাসবার্তার জন্য সপ্তাহে ৩/৪ দিন রামপুরহাটে অশোকদা কিম্বা আশিসের বাড়িতে থাকতাম। সেই সুবাদে রামপুরহাটের এস,ডি,পি,ও - সি, আই প্রমুখ পুলিশকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। তখন আমাদের এলাকার 'মূলদহ',ক্যানেলের পাড় সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায়ই চুরি ছিনতাই হচ্ছিল।সেইসব চুরি-ছিনতাই আটকাতে জনসচতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবাদ ক্লাব চত্বরে মিটিং ডাকেন ওইসব পুলিশ কর্তারা।সেই মিটিং-এ আমিও ছিলাম। আমাকে দেখে ওইসব পুলিশকর্তারা পাশে ডেকে কারা ওইসব দুঃস্কর্মের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে জানতে চান। আমি সবিনয়ে তাদের বলি , দেখুন আমি বেশিরভাগ সময় এখন রামপুরহাটে থাকি। তাই কারা এসব করছে তার আভাস দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের সেদিনের সেই কথা বলা অনেকেরই চোখে লাগে। লাগে বুকেও। এত লোক থাকতে আমার মতো এলেবেলে একটা পত্রিকার একজন সম্পাদকের সঙ্গে পদস্থ পুলিশ অফিসারদের একান্ত কথোপকথন অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের ভাবখানা ছিল, অর্ঘ্য এত গুরুত্ব পাবে কেন ? বিশেষ করে তদানীন্তন শাসকদলের স্থানীয় কিছু নেতা এবং আমার পাড়ারই একটি ছেলে কিছুতেই বিষয়টি মেনে নিতে পারেন নি। তাদের জন্যই ওই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আমি খুব চাপে পড়ে যায়। কারণ তারপরই আচমকা শাসকদলের কিছু সক্রিয় কর্মীকে ধরপাকড় শুরু করে দেয় পুলিশ। আর তারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। আর আমি মাঝখান থেকে চাপে পড়ে যায়। হঠাৎ করে একদিন শাসকদলের ওইসব কর্মীরা একদিন আমার বাড়ি চড়াও হয়। তারা জানায় , তাদের দল খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে , আমিই নাকি সেদিন পুলিশ কর্তাদের কাছে ওদের নাম বলে দিয়েছি। আর সেই ছেলেটিও ওদের স্বত:প্রনোদিত ভাবে ওদের বলেছে , তার এক আত্মীয় পুলিশ বিভাগে কাজ করে, সে'ও তাকে নাকি বলেছে আমিই পুলিশ কর্তাদের কাছে ওদের নাম বলেছি। আমি তাদের যত বোঝায়, আমি পুশিশের কাছে কারও কোন নামই বলি নি। তত তারা খাপ্পা হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতিদিন বাড়িতে এসে শাসিয়ে যায়, তাদের যদি জেলে যেতে হয় তাহলে কিন্তু আমাকে তারা ছেড়ে কথা কইবে না। ফিরে এসে দেখে নেবে।
( বিধায়ক যখন কর্ম পরিচালক )
একে তারা শাসকদলের প্রভাবশালী কর্মী তার উপরে ডাকাবুকো হিসাবে পরিচিতি রয়েছে । তাই তাদের শাসানিতে আমার বাড়ির লোকেরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা বলেন, খুব হয়েছে, আর গাঁটের কড়ি খরচ করে পত্রিকা ছাপানোর মতো বনের মোষ তাড়াতে হবে না। বলাবাহুল্য ঘরে বাইরের ওই চাপে তখন আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। অগত্যা ফোনে ওইসব পুলিশ কর্তাদের বিষয়টি জানায়। তারা বলেন, থানায় একটা অভিযোগ করুন। তারপর কি করা যায় দেখছি। ততদিনে আমার পুলিশকে চেনা হয়ে গিয়েছি। জানা হয়ে গিয়েছে , তাদের ' কতদুর কি করা যায় দেখছি' আশ্বাসের সারবত্তাও। একেই তো এই অবস্থা, তার উপরে ওদের নামে অভিযোগ করলে কতদুর কি হবে সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না আমার। তাই দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম উবে যায়। শেষে সমস্যার কথা বিষ্ণুদা জানায়। বলাবাহুল্য, তারপর থেকেই আমার উপর চাপ কমে যায়। থেমে পুলিশের ধরপাকড়ও।
একে তারা শাসকদলের প্রভাবশালী কর্মী তার উপরে ডাকাবুকো হিসাবে পরিচিতি রয়েছে । তাই তাদের শাসানিতে আমার বাড়ির লোকেরা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তারা বলেন, খুব হয়েছে, আর গাঁটের কড়ি খরচ করে পত্রিকা ছাপানোর মতো বনের মোষ তাড়াতে হবে না। বলাবাহুল্য ঘরে বাইরের ওই চাপে তখন আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। অগত্যা ফোনে ওইসব পুলিশ কর্তাদের বিষয়টি জানায়। তারা বলেন, থানায় একটা অভিযোগ করুন। তারপর কি করা যায় দেখছি। ততদিনে আমার পুলিশকে চেনা হয়ে গিয়েছি। জানা হয়ে গিয়েছে , তাদের ' কতদুর কি করা যায় দেখছি' আশ্বাসের সারবত্তাও। একেই তো এই অবস্থা, তার উপরে ওদের নামে অভিযোগ করলে কতদুর কি হবে সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না আমার। তাই দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম উবে যায়। শেষে সমস্যার কথা বিষ্ণুদা জানায়। বলাবাহুল্য, তারপর থেকেই আমার উপর চাপ কমে যায়। থেমে পুলিশের ধরপাকড়ও।
( অন্য মুডে )
ওই ধরণের আরও একটা চাপ থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন বিষ্ণুদা। এবার অবশ্য চাপটা ছিল অনুরোধের। তখন আমি সদ্য আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়েছে। বিষ্ণুদার বিধায়ক কোটার এলাকা উন্নয়ন তহবিলের টাকায় রামনগরের একটি প্রাইমারী স্কুলে প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলছিল। সেই কাজে নিম্নমানের মালমশলা ব্যবহারের অভিযোগে প্রাচীরের একাংশ ভেঙে দেন স্থানীয় কিছু যুবক। আমি সেই খবরটা করি। ছবি সহ সেই খবর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়। আর যায় কোথাই ? বি,ডি,ও ওইসব যুবকদের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করে বসেন। শুরু হয়ে যায় ধরপাকড়। তখন ওইসব যুবকেরা বার বার ফোন করে বলে , দাদা এবারের মতো বাঁচিয়ে দিন। যা হয় একটা কিছু করুন। অগত্যা আবার ফোন বিষ্ণুদাকে। বলাবাহুল্য এবারেও বিষ্ণুদার সৌজন্যেই অনুরোধের ওই চাপ থেকে মুক্ত হই।
শুধু ওই দুটি ক্ষেত্রেই নয়, আরও অনেকক্ষেত্রে বিষ্ণুদার সাহার্য্য পেয়েছি। সে সময় স্থানীয় সি,পি,এম নেতৃত্বকে এড়িয়ে কিছুই করা যেত না। সে এম,এল - এর শংসাপত্রই হোক, কিম্বা সরকারি সাহার্য্যই হোক, তার নাগাল খুব সহজে মিলত না। কারণ তখনকার অধিকাংশ সি,পি,এম নেতারা ধরেই নিতেন, তাদের মিটিং--মিছিলে হাটে না , ' ইনকিলাব জিন্দাবাদ ' বলে না মানেই শত্রু পক্ষের লোক। বিষ্ণুদা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। বহু ক্ষেত্রে ফোন করে দিয়েছি , কোন রাজনৈতিক রঙ না দেখেই তার কাজটা করে দিয়েছেন। পরে শুনেছি এনিয়ে দলে তাকে চাপেও পড়তে হয়েছে। তিনি অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন। আর যথারীতি আমার অনুরোধ রক্ষা করেছেন।
আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর থেকে তার সংগে আমার ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে যায়। সেই সময় তিনি আমার কাছে সই করে দেওয়া 'ব্ল্যাংক চেকে'র মতো হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের কাজ বিশেষ করে আনন্দবাজার পত্রিকায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হিসাবে সংবাদে অভিযুক্ত পক্ষেরও বক্তব্য দিতে হয়। শাসক দলে থাকার সুবাদে তখন হামেশায় সি,পি,এমের বিরুদ্ধে খবর হত। আর সেইসব খবর করতে গিয়ে নাজেহাল হতে হত আমাদের। কারণ আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যের জন্য যখনই শাসকদলের কোন লোকাল নেতাকে ফোনে ধরা হত তিনি দেখিয়ে দিতেন জোনালের নেতাকে। আর জোনাল নেতারা দেখাতেন জেলা সম্পাদককে। জেলা সম্পাদকের নানান ব্যস্ততা পেরিয়ে যদিও তাকে পেতাম তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচয় জানার সেই যে একবার ফোন কেটে দিতেন আর ধরতেন না। আর তার বক্তব্যের জন্য ঘন ঘন তাড়া আসত অফিস থেকে। শেষ পর্যন্ত আমাদের ' এ বিষয়ে উনি কোন মন্তব্য করতে চান নি ' লিখে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হত।
সমস্যার কথাটা বিষ্ণুদা বলতেই তিনি আমাকে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দিয়েছিলেন। সেসময় তো মোবাইল ফোনের চল ছিল না, তার উপরে বিধানসভায় অধিবেশন থাকলে বিষ্ণুদাকে ধরা যেত না। তাই আমাকে বিষ্ণুদাই আমাকে বলে দিয়েছিলেন, আপনি আপনার সুবিধা মতো আমার মুখে একটা বক্তব্য বসিয়ে নিয়েন। একটু লক্ষ্য রাখবেন, ওই বক্তব্যে দল আর সরকারের কাছে আমি যেন খুব চাপে না পড়ে যায়। তারপর থেকেই আমি শুধু ময়ূরেশ্বর এলাকাতেই নয়, জেলা কমিটির সদস্য হিসাবে জেলার প্রায় সর্বত্র অধিকাংশ খবরেই তার বক্তব্য বসিয়ে দিতাম। বহু ক্ষেত্রে বিষ্ণুদা হয়তো জানতেও পারতেন না। সেইসব এলাকার কর্মী সমর্থকরা যখন ওই বক্তব্য নিয়ে তার দৃষ্টি আর্কষণ করতেন, তখন তিনি অস্বীকারও করতেন না। বরং বলতেন, হ্যা সেদিন ওই রকম কি একটা বিষয় নিয়ে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছিলেন বটে। আমার নামে উল্টো- পাল্টা কিছু ছেপেছে নাকি? পরে তার মুখে এইসব কথা শুনে খুব হাসাহাসি করেছি। আজ আর সি,পি,এম নেতাদের বক্তব্য পেতে কোন সমস্যা হয় না। খুব একটা প্রয়োজনও হয় না। বরং অনেক সি,পি,এম নেতাই বক্তব্য দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। ওইসব নেতারাই সেদিন মুখ ঘুরিয়ে নিতেন।আর তখনই আমার বিষ্ণুদার কথা খুব মনে পড়ে যায়। ভাবি কতটা বিশ্বাস থাকলে ওইভাবে অন্যের হাতে সই করা , 'ব্ল্যাংক চেক ' তুলে দেওয়া যায়। তার সেই বিশ্বাসের কথা আজও ভুলতে পারি নি। ২০১৩ সালে বিষ্ণুদা চলে গিয়েছেন , কিন্তু রয়ে গিয়েছেন আমার মনের মনিকোঠায়।
সমস্যার কথাটা বিষ্ণুদা বলতেই তিনি আমাকে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দিয়েছিলেন। সেসময় তো মোবাইল ফোনের চল ছিল না, তার উপরে বিধানসভায় অধিবেশন থাকলে বিষ্ণুদাকে ধরা যেত না। তাই আমাকে বিষ্ণুদাই আমাকে বলে দিয়েছিলেন, আপনি আপনার সুবিধা মতো আমার মুখে একটা বক্তব্য বসিয়ে নিয়েন। একটু লক্ষ্য রাখবেন, ওই বক্তব্যে দল আর সরকারের কাছে আমি যেন খুব চাপে না পড়ে যায়। তারপর থেকেই আমি শুধু ময়ূরেশ্বর এলাকাতেই নয়, জেলা কমিটির সদস্য হিসাবে জেলার প্রায় সর্বত্র অধিকাংশ খবরেই তার বক্তব্য বসিয়ে দিতাম। বহু ক্ষেত্রে বিষ্ণুদা হয়তো জানতেও পারতেন না। সেইসব এলাকার কর্মী সমর্থকরা যখন ওই বক্তব্য নিয়ে তার দৃষ্টি আর্কষণ করতেন, তখন তিনি অস্বীকারও করতেন না। বরং বলতেন, হ্যা সেদিন ওই রকম কি একটা বিষয় নিয়ে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছিলেন বটে। আমার নামে উল্টো- পাল্টা কিছু ছেপেছে নাকি? পরে তার মুখে এইসব কথা শুনে খুব হাসাহাসি করেছি। আজ আর সি,পি,এম নেতাদের বক্তব্য পেতে কোন সমস্যা হয় না। খুব একটা প্রয়োজনও হয় না। বরং অনেক সি,পি,এম নেতাই বক্তব্য দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। ওইসব নেতারাই সেদিন মুখ ঘুরিয়ে নিতেন।আর তখনই আমার বিষ্ণুদার কথা খুব মনে পড়ে যায়। ভাবি কতটা বিশ্বাস থাকলে ওইভাবে অন্যের হাতে সই করা , 'ব্ল্যাংক চেক ' তুলে দেওয়া যায়। তার সেই বিশ্বাসের কথা আজও ভুলতে পারি নি। ২০১৩ সালে বিষ্ণুদা চলে গিয়েছেন , কিন্তু রয়ে গিয়েছেন আমার মনের মনিকোঠায়।
( চলবে )
পড়ুন / পড়ান
নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন
১৯ নভেম্বর থেকে প্রতিদিন সকাল ১০ টার মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে
ধারাবাহিক উপন্যাস
সালিশির রায়
সালিশি সভার রায়ে সর্বস্ব হারানো এক আদিবাসী তরুণীর ঘুরে দাঁড়ানোর , অন্যকে দাঁড় করানোর মর্মস্পর্শী কাহিনী অবলম্বনে ধারাবাহিক উপন্যাস --
খুব কাছে থেকে দেখা আদিবাসী সমাজের এক তরুণীর মর্মান্তিক পরিণতির ঘটনা । একসময় ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল অনেক ঘটনা।সেই ঘটনাই তুলে ধরা হয়েছে এই কাহিনীতে। আদিবাসী সমাজের ভাষা আলাদা , কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ভাবের প্রকাশও আলাদা। কিন্তু দুঃখ , জ্বালা , যন্ত্রণার অভিব্যক্তি মনে হয় মানুষ মাত্রেরই এক।সেই সব জ্বালা যন্ত্রনার অভিব্যক্তি বৃহত্তর সমাজের উপযোগী ভাষা এবং ভাবের প্রকাশ ভঙ্গিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। ত্রুটি -বিচ্যুতি থাকাটাই স্বাভাবিক।তাই সবিনয়ে আগাম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। একটাই প্রার্থনা , ভালো লাগলে বলুন , বলুন খারাপ লাগলেও।ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment