Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কবিতাগুচ্ছ - ১২

                  

                  ছোড়দি তোকে


                           
 অর্ঘ্য ঘোষ


ছোড়দি তোর মনে পড়ে?
ছোটবেলায় মা কথায় কথায় বলতেন ,
লোকে কি বলবে ?
যে লোকেরা আমাদের সব ভালোকেও খারাপ বলেছে ,
তাদের কথা ভেবেই মা আমাদের পায়ে বেড়ি পড়িয়ে রাখতেন ।
লোকের কথা ভেবেই
আমরা অনেককিছু হারিয়েছি
জানিস আমি আজও কলাই বাঁটা মেখে
পান্তাভাতখেতে পারিনা ।
আমাদের কি প্রিয়ই না ছিল পান্তা ভাত।        
ভাতের হাড়ি ঘিরে বসতাম আমরা ছয় ভাইবোন ।
মা বেড়ে দিতেন পান্তাভাত ,
কলাইবাঁটা আর চুনো মাছের টক ।
মাছ কেনার ক্ষমতা ছিল না আমাদের ।
তুই আর আমি বাবুদের ডোবা থেকে গামছা ছেঁকে চিংড়ি মাছ ধরে আনতাম ।
মা বলতেন , সোমত্ত মেয়ে লোকে দেখলে কি বলবে ?
সেই থেকে আমাদের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেল ।
অমলবাবুরা আমাদেরই বাড়ির সামনের পুকুরে জাল ফেলেতেন ,
 ভাইটা একটা মাছের লোভে পুকুর পাড়ে ঘুর ঘুর করত ।
 বাবুরা ঝুড়ি ভর্তি মাছ নিয়ে বাড়ি চলে যেতেন ।      
ভাই রোদে মেলে দেওয়া জালে আটকে থাকা মাছ কুড়িয়ে আনত।
মা বলতেন , ছিঃ বাবা লোকে কি বলবে ?
তবুও সেই মাছেরই টক করে মা দিতেন ।
আমরা হাত চেটে চেটে খেতাম আর বলতাম এর চাইতে ভালো স্বাদ দুনিয়াতে নেই ।    
আসলে দুনিয়ার অন্য স্বাদ নেওয়ার সুযোগ ঘটে নি আমাদের ।
ভাইটা অবশ্য মাঝেমধ্যে বিনা নিমন্ত্রণে ভোজবাড়িতে খেয়ে আসত।
আমাদের কাছে সাতকাহন গল্প করত।  গর্ব করে বলত ,
তিনবার ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার পরও সে কেমন করে লুকিয়ে খেয়ে এসেছে ।
আঁচলের আড়ালে কান্না লুকিয়ে মা বলতেন , ছিঃ বাবা লোকে কি বলবে?                                
সেই থেকে ভাইয়েরও আর হতশ্রদ্ধার ভিন্ন স্বাদ নেওয়া হয়নি ।        
খেতে খেতে মা কত গল্প করতেন ।
আমাদেরও নাকি গোলাভরা ধান , পুকুর ভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরুও ছিল ।          
তালপুকুরে ঘটি ডোবার দিন ফুরোলেও , জমিদারির খেতাবটূকুই ছিল টিকে ।
লোকে কি বলবে বলেই আমাদের বাবা মজুর খাটতে পারেন নি ।    
বেছে নিয়েছিলেন চুরির পথ ।                  
একদিন পূর্ব আক্রোশে চোর
অপবাদে বাবাকে তুলে নিয়ে যায় অমলবাবুরা ।
এক হাট লোকের মাঝে বাবাকে পিটিয়ে খুন করেছিল তারা ।
মরার আগে একটু জল –
একটু জল বলে বাবা আমাদের নাম ধরে ডেকেছিলেন ।
লোকে কি বলবে ভেবে সেদিনও বাবার মুখে একটু জল দিতে পারি নি আমরা।
খুনীরা মা’কে টাকা পয়সা দিয়ে মিটিয়ে নিতে চেয়েছিল।
মা চেয়েছিলেন শাস্তি ।
কিন্তু খুনীদের শাস্তি হয়নি ।
আমাদেরই আত্মীয়েরা টাকা নিয়ে মিথ্যা স্বাক্ষী দিয়েছিল আদালতে।
সুখের দিন আমাদের কোন সময়ই ছিলনা।          
তবু মাথার উপর বাবা ছিলেন চোর হোক বাবা তো ।
বাবার মৃত্যুর পর থেকেই
আমাদের প্রকৃত দুঃখের দিন শুরু হল ।
মা বেছে নিলেন ভিক্ষাবৃত্তি ।লোকলজ্জায় গ্রামে ভিক্ষা করতেন না,
যেতেন দুর গাঁয়ে
ভিক্ষাও বলতেন না।
বলতেন গাঁ বেড়াতে যাচ্ছি।                                
স্কুল ছেড়ে আমরাও ছাগল চড়নো , কাঠ কুড়ানো শুরু করলাম ।
কপট শাসনে মা বলতেন , সোমত্ত মেয়ে ,
লোকে দেখলে কি বলবে?
 তোকে বলি নি,একদিন বাগানে একা পেয়ে সুজনকাকা অসভ্যতা করেছিল ।
আমি বাড়ি এসে সারাদিন বমি করেছিলাম।        
লোকের জন্য আমাদের জঙ্গলে যাওয়াও ঘুচে গিয়েছিল।  
দিদি তোর মনে পড়ে , মায়ের ভিক্ষারী বন্ধুরা বলত অন্নপূর্ণা ,
ভগবতীর মতো  তোমার রূপ
মেয়েরাও তোমার গড়ন পেয়েছে, যাদের ঘরে যাবে আলো করবে।
সেই কথা শুনে মুখ
কালো হয়ে যেত যমজ বোন শ্যামলীর।
ভগবান তাকেও অঢেল রূপ লাবন্য দিয়েছিলেন।
দেন নি চলাফেরার ক্ষমতা
পোলিও কেড়ে নিয়েছিল চলার শক্তি, কথা বলার ক্ষমতা ।
মায়ের ভিক্ষারী বন্ধুদের কথা মেলে নি ।
আমাদের ঘরের ভাঙা জানলা দিয়ে রাতবিরতে ছেলেছোকড়া থেকে উঁকি
দিয়েছেন সমাজের তথাকথিত বরেণ্য লোকেরাও ।
তাদের কুদৃষ্টি আমাদের প্রতিবন্ধীকে বোনটাকে গিলে খেয়েছে ।
কিন্তু হাত ধরে কেউই নিয়ে যায় নি ঘরে।                          
বাড়িতে সোমত্ত মেয়ে রাখা ঠিক নয় বলে মাকে উপদেশ দিয়েছন অনেকে।
লোকে কি বলবে ভেবে মা যাকে পেয়েছেন তারই হাতে তুলে দিয়েছেন আমাদের।        
মনে পড়ে দিদি , যেদিন বাবার বয়সী একটা হাবাগোবা লোককে বিয়ে
করে চলে গেল লক্ষী প্রতিমার মতো বড়দি আমরা কত কেঁদেছিলাম ।                
তারপর বিয়ের নামে তুইও বিকিয়ে গেলি কলকাতার পতিতালয়ে ।
 দাদুর বয়সী একটা লোককে বিয়ে করে আমি শাহরানপুরে ।
ছোটবোনটা কোথাই হারিয়ে গেল কে জানে ।
ভাইটা গেল বখে ।
অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা পড়ল মা    
আজ সব মনে পড়ে যাচ্ছে।
মনে পড়ছে যমজ বোনটার কথাও ।
মনে পড়ে দিদি ,
হঠাৎ করে একদিন আমি আর মা কলাইবাঁটা-পান্তাভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম ।
সেদিন তোরা কেউ বাড়িতে ছিলি না ।
যমজ বোনটা কলাইবাঁটা খুব ভালোবাসত          
মা সেদিন অনেকটা
কলাই দিয়েছিল বাঁটতে ।
আর দিয়েছিল একটা বড়ি ।
বলেছিল , ওটা খেলে শ্যামলী ভালো হয়ে যাবে ।
মা কলাই বাঁটা মেখে নিজে হাতে শ্যামলীকে খাইয়ে দিয়েছিল।
খাওয়ার পর যন্ত্রনায় ছটফট করে মারা গিয়েছিল শ্যামলী ।
আমি মাকে চেপে ধরেছিলাম , একি করলে ?
মা হয়ে বিষ বড়ি দিয়ে মারলে নিজের মেয়েকে ? পাপ হবে না ?  
মা বলেছিলেন , চোপ আমাদের আবার পাপ পুন্য কিসের ?
যেদিন আমি থাকব না সেদিন ওর কি হবে ?
শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে , তখন লোকে কি বলবে ?
তারপর থেকেই আমি আর কলাইবাঁটা পান্তাভাত খেতে পারিনা ।  
শ্যামলীর নীল হয়ে যাওয়া যন্ত্রনা কাতর মুখটা ভেসে ওঠে ।
আজ মনে হয় আমাদেরও যদি মা বিষবড়ি দিতেন ভালো হত ।
আমরা তো শবের মতো বেঁচে আছি ।
কোন ইচ্ছে নেই , অনিচ্ছা নেই , স্বপ্ন নেই।
দিনগত পাপ ক্ষয় করে শুধু মৃত্যুর জন্য দিন গোনা ।
তোকে টাকা নিয়ে ঘরে লোক ঢোকাতে হয় ।                  
আমাকে পালাক্রমে
বৃদ্ধ বরের চাহিদা মিটিয়ে তার তিন ভাইয়ের শোয়ার ঘরে যেতে হয় ।
সেই আমরা যদি পাপ পুন্যের কথা বলি
তাহলে লোকে কি বলবে বল ?
                                -----------------



                                              পড়শি                                                                                         



পড়শি মানেই
উন্নতিতে ইর্ষা কাতর মন।
পড়শি মানেই
যেন আদরের ছোট বোন।।
পড়শি মানেই
পিছনে কলকাঠি।
পড়শি মানেই
বিপদে সব ভুলে ছুটি।।
পড়শি মানেই
সুযোগে খোলে কাছা।
পড়শি মানেই
ভাসানে গলা ধরে নাচা।।
পড়শি মানেই
কল তলায় চুলোচুলি।
পড়শি মানেই
লাউয়ের বদলে কুমড়ো ফালি।।
পড়শি মানেই
বাড়া ভাতে ছাই দেওয়া।
পড়শি মানেই 
এক পাতে ভাত খাওয়া।।
পড়শি মানেই
ঝোপ বুঝে কোপ মারা।
পড়শি মানেই
স্বজন বিয়োগে কেঁদে হয় সাড়া।।
পড়শি মানেই
আচ্ছা হয়েছে, হয়েছে ভালো।
পড়শি মানেই
সহমর্মিতায় মোমবাতির আলো।।
পড়শি মানেই
বিবাদে মাথা ফাটে।
পড়শি মানেই
অন্যের মা'কে রক্ত দিতে ছোটে।।
পড়শি মানেই
গাছে তুলে কেড়ে নেয় মই।
পড়শি মানেই 
বকুল পাতানো সই।।
পড়শি মানেই
তিলকে তাল করার জয়ঢাক।
পড়শি মানেই
এ বাড়ির হুলো ওবাড়িতে ভাত পাক।।
পড়শি মানেই
মুখোমুখি জানলায় ভোরের পড়া।
পড়শি মানেই
দু বাড়ির কিশোর কিশোরীর প্রেমে পড়া।। 
পড়শি মানেই
গায়ে হলুদ, খোলায় খই।
পড়শি মানেই
এ বাড়ির দুধে ও বাড়ির দই।।
পড়শি মানেই
কিছু দ্বিধা , কিছু দ্বন্দ্ব।
পড়শি মানেই
কিছু ভালো, কিছু মন্দ।।
পড়শি মানেই
নেই কোন রাখ ঢাক।
পড়শি মানেই
সবাই বেঁচেবর্তে থাক।।
---০---

No comments:

Post a Comment