Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অদ্ভুত আঁধার -২


                    অবক্ষয় 

           
                  


সেদিন সকালে  হঠাৎ করেই নিজের ছাত্রাবস্থার কথা খুব করে মনে পড়ে গেল। সকাল বেলায় নিয়মিত এক বন্ধুর দোকানে বসে চা খাই। ওই দোকানের সামনেই ইংরাজীর টিউশানি  পড়তে আসে স্থানীয় তিনটি স্কুলের নাইন-টেনের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েরা পৌঁছে গিয়েছে, শিক্ষকমশাই তখনও পৌছোন নি। গল্প করে সময় কাটানোর জন্য ওইসব ছেলেমেয়েদের কয়েকজনকে ডেকে নিলাম। নানা গল্পের মাঝে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলো তো দেখি ছাগলের ইংরাজী কি ? 


                              বেশ কিছু ছেলেমেয়ে নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ঘেমে উঠল। অন্য একদলকে জিজ্ঞাসা করলাম , বলো তো তাজমহল কি? এবারের অবস্থা আরও করুণ। সেই মুহুর্তেই নিজের ছাত্রবস্থার কথা মনে পড়ে গেল। ভালো ছেলে বলতে যা বোঝায় তার ধারেকাছেও কোনদিন পৌঁছোতে পারিনি। বরং পড়া বলতে না পেরে বেঞ্চের  উপরেই দাঁড়িয়েছি বেশিরভাগ দিন। কিন্তু আজও মনে আজ তাজমহলের কথা। মনে আছে ইতিহাসের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় কার্তিকচন্দ্র দাস উদাত্ত কন্ঠে আবৃত্তি করতে করতে ক্লাসে ঢুকতেন --- কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল, এ তাজমহল।বলতেন , বলো তো ঘোষ তাজমহল কার সৃষ্টি ? সেদিন উত্তরটা দিতে পারিনি, কিন্তু পরে আর ভুল হয়নি। কারণ মাস্টারমশাই ওই কবিতার মাধ্যমে শাহজাহান-মমতাজকে মনে গেঁথে দিয়েছিলেন।


                                                                        আজও যেন কানে বাজে তার সেই উদাত্ত কন্ঠস্বর। একইভাবে কানে বাজে  প্রয়াত প্রধানশিক্ষক নবকিশোর হাজরার আংকেল পোজার, প্রয়াত জগদীশ রায়ের "  ভনয়ে বিদ্যাপতি তুয়া বিনা গতি নাহি আরা " কিম্বা তারাপ্রসন্ন রায়ের "উই আর সেভেন " সহ বিভিন্ন মাস্টার মশাইয়ের পড়ানো সেইসব পাঠ্যের অংশ বিশেষ।প্রশ্ন জাগে, আমার মতো বেঞ্চের উপরে দাঁড়ানো ছাত্রের যদি আজও সেদিনের সেই পাঠ্য মনে থাকে তাহলে একালের গড়পড়তা ছেলেমেয়েদের এই হাল কেন ? এই প্রশ্নই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার নানা বেয়াব্রু দিক প্রকট করে দিয়েছে। আমাদের সময়ে দেখেছি কামাক্ষ্যাবাবু, বিনাকরবাবু, ধনীরামবাবু সহ অন্যান্য শিক্ষক মশাইরা প্রতিদিন একই সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাপা পদবিক্ষেপে হেটে প্রার্থনা শুরু হওয়ার অনেক আগে স্কুলে পৌঁছোতেন। পন্ডিতমশাই , মৌলভীসাহেব, সত্যবাবু, তপনবাবু, পরমেশ্বরবাবুর মতো শিক্ষক যারা হোস্টেল কিম্বা কোয়ার্টারে থাকতেন তারাও একই সময়ে স্কুলে হাজির হতেন।  সত্যনারায়ণ রুজ, দিলীপ দাসদের মতো বেশ কিছু শিক্ষক সাইকেলে একই ধারা বজায় রাখতেন। ক্লাস থাক বা নাই থাক ফিরতেনও একই সংগে।

                                                              সেসময় অধিকাংশ শিক্ষক মশাইয়েরই হাতে থাকত এক বা একাধিক বই। বাড়িতে তো পড়তেনই, ক্লাসে যাওয়ার আগে টিচার্সরুমে বসেও অনেক শিক্ষক মশাইকে চোখ বুলিয়ে নিতে দেখছি। সেইজন্যই বোধ হয় তারা আমাদের মতো পিছনের বেঞ্চের ছেলেমেয়েদের মনের গভীরে " বাবার হলো আবার জ্বর সারিল ঔষধে, বেনী আ সহ কলা',  "ডেকে হেকে কিলিয়ে মারো"র মতো বহু খটোমটো জিনিস হাড়ে মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। আর আজ কোথাই সেই মুন্সিয়ানা ? সেসময় অনুকূলবাবু, জগদীশবাবু, কাশীবাবুদের মতো অনেক শিক্ষকমশাইয়ের বাড়ি গিয়ে দেখেছি দামী আসবাবের কোন বাহুল্য নেই , কিন্তু রয়েছে বহু বই। আর এখন বেশকিছু শিক্ষকের বাড়ি গিয়ে দেখেছি ঘরে ঘরে সব দামী আসবাব , বইপত্রের স্থান নেই বললেই চলে। কারও কারও বাড়িতে কিছু বই নজরে এসেছে, তবে তা নেহাতই প্রকাশকের কাছে পাওয়া নমুনা কপি কিম্বা নিজের বিয়ে , ছেলের পৈতে, মেয়ের জন্মদিনে পাওয়া উপহারের বই। তবে তাও পড়া হয় কিনা সন্দেহ। পরে পেশাগত কারণে নানাভাবে আমাদের সেই শিক্ষকের কাছে ছুটে গিয়েছে। তখন একদিন জগদীশবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম , স্যার এত এত বই কি জানার জন্য পড়েন? মুচকি হেসে স্যার বলেছিলেন, জানার কি শেষ আছে রে। শুধু নিজে জানাটাই তো সব নয়, অন্যকে জানানোর জন্যও আগে নিজে জানতে হয়। না পড়লে জানাব কি করে ? আর আজ ?

                                                           পড়ার সময় কোথাই শিক্ষকমশাইদের ? আজ তো শুনি অধিকাংশ স্কুলেই প্রধানশিক্ষক তো বটেই, শিক্ষকদের বড়ো অংশই ৫০ / ২০০ কিমি দুরের বাড়ি থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে স্কুলে আসেন। আবার শেষ ট্রেনটা যাতে মিস না হয় তার জন্য সেই মাফিক রুটিনও বানানো হয়।সময়ে বাড়ি ফেরার জন্য অনেকক্ষেত্রে প্রক্সি প্রথাও চলে। প্রথম দিকের বিজ্ঞানের ক্লাসটা বহিরাগত বাংলা শিক্ষক করে দেন। আর শেষের দিকে বাংলা ক্লাস করে দেন স্থানীয় বিজ্ঞানের শিক্ষক। এইভাবেই নানান ধরণের  বোঝাপড়াতেই জগত চলছে, তাহলে শিক্ষকদেরই বা চোরের দায়ে ধরা হবে কেন?  ধরা হবে কারণ শিক্ষকদেরই আমরা জাতির মেরুদণ্ড বলি, তাদেরউপরের নির্ভর করে গড়ে ওঠে আমাদের ভবিষ্যৎ।শিক্ষকরাই আমাদের নীতি আর্দশের স্তম্ভ। 


                                               কিন্তু কোথাই নীতি, কোথাই আদর্শ? বাইরে যারা ঘোরাফেরা করেন তারা জানেন, ১৫০/২০০ কিমি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে আর যাই হোক শিক্ষকতা করা যায় না। অথচ সেটাই করা হয়। কিন্তু কেন করা হবে ? শিক্ষকরা তো তাদের বেসিক পে' র উপর ১৫ শতাংশ হারে সর্বাধিক মাসিক ৬০০০ টাকা পর্যন্ত সরকারি বাড়ি ভাড়া পান। শিক্ষক মশাইদের ক্ষেত্রে তাদের বাসস্থানের নিদ্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। কিন্তু সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে কর্মস্থলের ৮ কিমি দুরত্বের মধ্যে থাকাটা বাধ্যতামূলক। শিক্ষকরা পুরোপুরি সরকারি কর্মী না হলেও তারা সরকারি সাহার্য্য প্রাপ্ত স্কুলের কর্মী হিসাবে বিবেচিত হন। সরকারি কর্মীদের মতো বেশ কিছু সুবিধাও ভোগ করেন। 


                      তাহলে তারাই বা কেন স্কুলের ৮ কিমি দুরত্বের মধ্যে থাকবেন না? এখানেই আসে নীতির প্রশ্ন। নিয়ম থাক বা না থাক, এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে সরকার কি বাড়ি থেকে ডেলিপ্যাসেঞ্জারী করার জন্য তাদের বাড়ি ভাড়া দেন ? যদি যাওয়া আসা করতেই হয় তাহলে বাড়ি ভাড়াটা তো প্রত্যাখ্যান  করাই উচিত। তবেই তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শিক্ষাগুরুর কাছে ত্যাগের পাঠ শিখবে। কিন্তু কোন শিক্ষক তেমনটা করেছেন বলে জানা নেই। আসলে চুটিয়ে টিউশানি কিম্বা নিজের ছেলেমেয়েদের ভালো কোন স্কুলে পড়ানোর জন্যই তারা শহরে বাস করেন। আর তার কাছেই ১ ঘন্টার টিউশানি পড়ার জন্য তিনঘন্টা সময় নষ্ট করে তারই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ২৫/ ৩০ দুরের শহরে ছুটতে হয়।  এই ঘটনাই প্রমাণ করে দেয় নিজেদের স্কুলের প্রতিই আস্থা নেই শিক্ষকদের।ছাত্ররাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষের সংগে কথা বলে জানা গিয়েছে, দশম এবং দ্বাদশ শ্রেনীতে দিনের পর দিন এক বড়ো সংখ্যক পড়ুয়াই গড়হাজির থাকে।


                                               তার মানে এই নয় যে , ওইসব ছাত্রছাত্রীরা ফাঁকিবাজ। বরং দেখা গিয়েছে, ওইসব ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে তুলনামূলক ভালো ফল করেছে। আসলে তারা  স্কুলের লেখাপড়ার প্রতি ভরসা হারিয়ে সেইসময় টিউশানি পড়ে বেড়ায়। তাই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এখন কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে ছেলেমেয়েদের সাইকেল, টোটো, বাস, ট্রেনে শুধু টিউশানি পড়তেই দেখা যায়। এই ঘটনাও প্রমাণ করে দেয় বহু স্কুলে সে অর্থে কিছুই হয় না। আমাদের সময় অংক,  বড়োজোর ইংরাজীতে তাও মাধ্যমিক পরীক্ষার কয়েকমাস আগে টিউশানি জুটত। অবশ্য ওইসব পরীক্ষার আগে শিক্ষকমশাইরা বিনা পারিশ্রমিকে কোচিংও দিতেন।  সেসময় স্কুলে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে খুব বেশি হলে একটা ফার্স্ট ডিভিশন হতো। কিন্তু বাকি যারা পাশ করত তারাও তাজমহলের ইতিকথাটা জানত। আসলে তখন এই অবক্ষয় ছিল না। শিক্ষকদের বেতন খুউব কম ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল মানুষ গড়ার মানসিকতা। 


                                                       আর এখন হয়েছে পার্টি করার মানসিকতা। কোন রকমে একবার শাসকদলে নাম লেখাতে পারলেই হলো। তখন আর স্কুলে পড়ানোর পরিবর্তে পার্টির মিটিং- মিছিল, সভা সঞ্চালনা আর নেতাদের তোষামোদ করে বেড়াতে পারলেই হলো। তখন আর কেউ টিকিটাও ছুঁতে পারবে না। আমি এক শিক্ষককে জানি একসময় ছাত্রমহলে তার খুউব জনপ্রিয়তা ছিল। পড়ানোর বিষয়ে যত্নবান ছিলেন ওই শিক্ষক। তার বিষয়ে ছেলেমেয়েরা ভালো নম্বরও পেত। কিন্তু শাসক দলে নাম লিখিয়ে তিনি এখন মূলত মিটিং, মিছিল আর সভা সঞ্চালনা করে বেড়ান। ছেলেমেয়েরাও আর আগের মতো নম্বর তুলতে পারে না। এই অবক্ষয় অবশ্য বামজমানার শেষ ১০ বছরে শুরু হয়েছিল। শিক্ষকদের উপর থেকে কন্ট্রোল চলে গিয়েছিল সরকারের। বরং শিক্ষক সংগঠনগুলিই পরোক্ষে সরকারকে কন্ট্রোল করত। 

                                   কারণ শিক্ষকরাই যে ভোট বৈতরণী পারাপারের অন্যতম কাণ্ডারী। কাণ্ডারীকে চটিয়ে মাঝনদীতে নৌকা কে'ই বা ডোবাতে চায়? কিন্তু সবখানেই কি অন্ধকার? তাও তো নয় ,  আজও তো শুনি গভীর রাতেও মুমূর্ষু ছাত্রকে রক্ত দিতে ছুটছেন একদল শিক্ষক। দুঃস্থ ছেলেমেয়ের বই কিম্বা পড়ার খরচ যোগাড় করার জন্য চাঁদা তুলে বেড়াচ্ছেন কোন শিক্ষক সংগঠন। ক্যান্সার আক্রান্ত ছাত্রের চিকিৎসার জন্য পথে পথে কার্যত ভিক্ষা করছেন শিক্ষকরা। অবসর নেওয়ার পরও শিক্ষকের ঘাটতি মেটাতে স্বেচ্ছাশ্রমে বছরের পর বছর পড়িয়ে চলেছেন কোন শিক্ষক।

                                             আবার কেউ নিজের চোখের অপারেশন না করিয়ে অবসর নেওয়ার সময় সারা জীবনের সঞ্চয়ের সিংহভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিচ্ছেন নয়নের মনি ছাত্রছাত্রীদের খেলার মাঠের জন্য। বিদায় সংবর্ধনা মঞ্চে তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে -- আমি চোখে দেখতে না পেলে কি হবে, আমার নয়নের মনি ছেলেমেয়ের হাসিমুখই যে আমার চোখ আলোয় ভরিয়ে দেবে। তখন গর্ব হয় বইকি, দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসে।  মনে হয় ওই শিক্ষককে প্রনাম করে বলি, স্যার আপনারা আছেন বলেই পৃথিবীটা আজও সুন্দর। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় গর্বের পরিধিটা দিন দিন বড়ো ছোট হয়ে আসছে।



                 ------০------



              অসুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র

                             
      (  রামপুরহাট সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল  )  


              ( ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র )
    
এ যেন প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। ঝাঁ চকচকে রামপুরহাট সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের নীচে ওই মহকুমারই ময়ুরেশ্বর থানা এলাকার হতশ্রী ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। হবে না'ই বা কেন? রামপুরহাট রাজ্যের খোদ প্রাক্তন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা বলে কথা। তা হোক তাতে আমাদের কারও আপত্তি থাকার কথা নয় , তাই আপত্তি নেইও। কিন্তু আমাদের একটা জিজ্ঞাসা আছে, গ্রামের মানুষের কি রোগ বালাই নেই? তাদের কি ডাক্তার -- ওষুধ লাগে না ? 


শহরে তবু নার্সিংহোম আছে , প্রাইভেট প্র্যাকটিসের চেম্বার আছে। কিন্তু গ্রামের মানুষের কি আছে? ওঝা, কবিরাজ, হাতুড়ে আর তাবিজ - কবজ। কারণ এলাকার ২০/২৫ টি গ্রামের ভরসাস্থল ঢেকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বছর চারেক ধরে কোন ডাক্তারই নেই। বরাদ্দ ৭ জন স্টাফের মধ্যে একজন ফার্মাসিস্ট, একজন নার্স আর একজন চতুর্থ শ্রেনীর কর্মী জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছেন ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেটি এখন গরুর খোঁয়াড় না জ্বালানী সংরক্ষণ কেন্দ্র তা বোঝাই দায়। এই চার বছরে নেই নেই করেও কমপক্ষে ১০/১২ বার লিখিত ভাবে প্রশাসনের কাছে ডাক্তারের দাবি জানিয়েছেন গ্রামের মানুষ। চার বছরে কমপক্ষে ১৫ বার সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।


                    অথচ ওই এলাকাতেই বাড়ি পঞ্চায়েতের প্রধান, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিদের। ওই এলাকার মানুষের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছেন জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ। সবাই সব জানেন, তবু দুঃখ ঘোচে নি এলাকার মানুষের।শেষমেষ এলাকার বাসিন্দারা ডাক্তারের দাবি জানিয়েছিলেন জেলারই বাসিন্দা তথা প্রাক্তন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর কাছে। বর্তমানে প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দফতর বদলেছে কিন্তু ওই এলাকার বাসিন্দাদের ভাগ্য আজও বদলায় নি। স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, সেই বাম আমল থেকেই ডাক্তারের ঘাটতি চলছে। ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চাইছেন না। এমনই নানা ফিরিস্তি শুনিয়েছেন তারা। অব্যবস্থা, ইউনিয়নবাজি সব আমলেই ছিল। হয়তো থাকবেও। কিন্তু এর আগে টানা চার বছর কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ডাক্তারহীন হয়ে পড়ে থাকার কথা জানা নেই। ঢেকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই সেই সময় মিলেছে বিষ খাওয়া, প্রসব, ডায়রিয়া সহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য পরিযেবা। 


                               আর ডাক্তারদের গ্রামে যেতে না চাওয়ার অজুহাত কেন মানা হবে ? শিক্ষক, পুলিশ সহ প্রায় সমস্ত সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে যেখানে নিয়োগ করা হবে সেখানে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক হলে ডাক্তারদের ক্ষেত্রে তো আরও বেশি করে হওয়া উচিত। কারণ সরকারেরইএকটি তথ্য বলছে, একজন ছেলে বা মেয়েকে ডাক্তার তৈরি করতে তাদের পরিবারের যা খরচ হয় তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি খরচ হয় সরকারি অর্থ। আর সরকারি অর্থটা তো কোন কল্পবৃক্ষের পাতা নয়, সেটা মানুষের কাছ থেকে সংগৃহিত কর। তার মধ্যে শহরের মানুষ যেমন আছেন, তেমনই গ্রামের মানুষও আছেন। তাহলে কেন গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেন না? এ প্রশ্নের কোন জবাব মেলে না। আসলে ভোট রাজনীতির স্বার্থে রাশটাই কেমন যেন আলগা হয়ে গিয়েছে। 


                                                       নাহলে মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিসের অপচেষ্টা হয়। বাম আমলেও দেখছি ,কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংবাদ প্রকাশিত হলে কাজ হয়েছে। এখন কে কার গোয়ালে ধোঁওয়া দেয়? সব ডোণ্টকেয়ার ভাব। ভাবখানাই এমন, লিখছে লিখুক, কিচ্ছুটি হবে না। বুলেট দিয়ে মানুষখেকো বাঘকেও ঘায়েল করা যায় কিন্তু চামড়া মোটা হয়ে যাওয়া গন্ডারের ক্ষেত্রে তা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসার আশংকাই প্রবল। তাই আমাদের সরকারি হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিসের অপচেষ্টার মতোই হজম করে নিতে হবে একমাত্র শিশুপুত্রের মৃতদেহ আঁকড়ে ফুলমতি সোরেনদের কান্না। বছর দুয়েক আগে ময়ুরেশ্বরের বেলিয়ার ফুলমতির ছেলেকে সাপে কাটে। ২০ কিমি দুরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছেলেক নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না তার। তাই লোকপাড়ার এক হাতুড়ের চেম্বারে ছেলেকে নিয়ে ছুটে এসেছিলেন ফুলমতি। কিন্তু ছেলেকে বাঁচানো যায় নি। সেদিন ফুলমতির কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল বাতাস। প্রশ্ন জাগে আর কত ফুলমতির কান্নার পর স্বাস্থ্যকর্তাদের ঘুম ভাঙ্গবে ???  


                            -----০-----


           অসুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র--২ 

               
           

                     




শাসক দলের পর এবার দেখা যাক ঢেকা সহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন বিরোধী দলের ভূমিকা। সংবাদ মাধ্যমের মতো বিভিন্ন অব্যবস্থা নিয়ে তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে। পেশাগত কারণেই একরঙা থেকে তেরঙা পতাকাধারী সব দলের নেতাদেরই সংগেই যথেষ্ট জানা শোনা রয়েছে। সেই সুবাদেই পঞ্চায়েত থেকে জেলাস্তরের ওইসব নেতাদের অনুরোধে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচীর খবর আমাদের কভার করে দিতে হয়। দিনের পর দিন ঢেকা সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অব্যবস্থা সম্পর্কে সংবাদ করার পরও কোন সুরাহা না হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জবাবদিহি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ ওইসব নেতাদের জনে জনে ধরে বলেছি , দাদা একই খবর লিখে লিখে তো ক্লান্ত হয়ে গেলাম। ডাক্তারের দাবিতে আপনারা একটা আন্দোলন -টান্দোলন করুন তো দেখি। 


                                                                         সবাই ইস্যুটা মন দিয়ে শুনেছেন।তারপর বলেছেন দারুন ইস্যু, কয়েকদিনের মধ্যেই আন্দোলনে নামছি। চার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সেই কয়েকদিন পর আর আসে নি। আসবে কি করে ? তাদের আন্দোলনের চাপ যে বড্ড বেশি। দিল্লির রাজপথে শাসকদলের সাংসদরা পানের পিক ফেলে নোংরা করলে কোন বিরোধীদলকে তা পরিস্কারের দাবিতে কোটাসুর মোড়ের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় পথ অবরোধ করতে হয়। আবার কোন বিরোধীদলকে বাইরের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বান্ধবীর ম্যালেরিয়া হলে ময়ুরেশ্বরের ক্যানেল অফিস মোড়ে মাইক বেঁধে মশাদের অবিবেচনার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে এলাকা গরম করতে হয়। এমনই হাজারো জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক মানের আন্দোলনের চাপে তারা যদি তুচ্ছ ঢেকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের মতো আঞ্চলিক দাবির জন্য আন্দোলন করার সময় না পান তাহলে তো তাদের দোষ দেওয়া যায় না।


                                    সে এলাকার মানুষ পথ অবরোধ জনিত দুর্ভোগ আর মাইকের শব্দে কান ঝালাপালা ছাড়া ওইসব আন্দোলনের বিন্দু বিষর্গ বুঝুন বা নাই বুঝুন নেতাদের আন্দোলন কিন্তু করতেই হয়। আর তার পরেই ওইসব নেতারা ফোন করে বলেন , দাদা আজ প্রশাসনের কান লাল করে দিয়েছি। আন্দোলনে নেতৃত্বটাও আমিই দিয়েছি। একটু দেখবেন দাদা, আমি কিন্তু এখন আর ব্লক কমিটিতে নই , রাজ্য কমিটিতে আছি। পরক্ষণেই সেই দলেরই সারা বছর যাকে মাঠে ময়দানে দেখা যায় না, কোন নির্বাচন এলেই ধোপ দুরস্ত পাজামা--পাঞ্জাবি পড়ে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়া স্বঘোষিত আর এক নেতার ফোন - দাদা, রামাদা কিন্তু নেতৃত্বটা একাই দেয়নি। আমিও ছিলাম। আমার কথাটাও মনে রাখবেন দাদা। অর্থাৎ ওইসব আন্দোলনের খবরের সংগে যেন তাদের নামটাও পদসহ শোভা পায় তারই জন্য এই ফোন সুপারিশ। 


                                             এহেন প্রচার লোলুপতা দেখে মাঝে মধ্যে বড়ো হাসি পায়। এই যদি আন্দোলনের সারবর্তা হয়, তাহলে সেইসব আন্দোলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়। আন্দোলন নয় , আন্দোলনের নামে নিজেকে জাহির করার কি নগ্ন নিলজ্জ প্রয়াস। বামপন্থীদের বড়ো শরিকদের অবশ্য এত প্রচার লোলুপতা দেখি নি। কিন্তু তারাও  অন্যদের মতোই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন বলে জানা নেই। প্রশ্ন জাগে, এরা কবে বুঝবেন ১৫০ টাকা বেতনের মজুর পুত্রহারা ফুলমতিরা জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক মাপের ওইসব ইস্যু বোঝেন না। তারা বোঝেন তাদের জীবন যন্ত্রনা। তাদের জীবন যন্ত্রনা নিয়ে যারা সরব হয় তাদের আন্দোলনেই শরিক হতে দেখা যায় ফুলমতিদের। সমাজের প্রান্তজনেদের জন্য সেই প্রান্তিক আন্দোলন এখন বড়ো একটা তো দেখা যায় না। 

                                                  
                                                           তাই বেশিরভাগ আন্দোলনেই ফুলমতিদের আজ খুব একটা সামিল হতেও দেখা যায় না। আন্দোলনও দানা বাঁধে না। তাই সবকিছু তুড়িতে উড়িয়ে একছত্র আধিপত্য কায়েম করে চলে শাসক। তাদের শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে শোষিতের নাভিশ্বাস ওঠে। তবু আন্দোলন হয় বড়ো বড়ো ইস্যু নিয়ে। সংবাদ মাধ্যমে তা বড় বড় শিরোনামে তা প্রকাশিতও হয়। আর সেইসব সংবাদ পড়ে আমরা আত্মসন্তুষ্টি লাভ করি। কিন্তু তাতে ফুলমতিদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়না। বিশেষ করে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা তাদের অধরাই থেকে যায়। সদ্য পুত্রহারা ফুলমতিদের কান্নায় আমরা তাৎক্ষনিক আ: হা : উ: হু করি। তারপর সব ভুলে যায়। আমাদের ঘাড়ে যে হাজারো আন্দোলনের চাপ।

                  -----০----

                  নিদান 


নলহাটি নির্বাচনের আগে যা বলেছিলেন ফল ঘোষণার পরও বললেন সেই একই কথা। বলছিলেন, যে ওয়ার্ডে আমরা হারব সেখানে কেউ বাড়ি তৈরির অনুদান পাবে না। দুটি ওয়ার্ডে হারার পর বললেন, ওই দুটি ওয়ার্ডে কোন উন্নয়ন হবে না। সে উনি বলতেই পারেন, জেলার দন্ডমুন্ডের কর্তা বলে কথা। হাকিম নড়লেও তার হুকুম নড়ে না। তাছাড়া উন্নয়নটা  তো আমাদের ট্যাক্সের টাকাতে হয় না  , হয় যেন ওনার জমির ধান চাল বিক্রির টাকায়!!! তাই কোথাই উন্নয়ন হবে আর কোথাই হবে না তা উনি ঠিক করবেন না তো কি আপনি আমি ঠিক করব ?উন্নয়নের কথা বরং উনিই ভাবুন, আমরা বরং একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। উন্নয়ণের জুজু দেখিয়ে আদৌ কি কিছু হয় ? 


                                             এই প্রশ্নটা কিন্তু তুলে দিয়েছে নলহাটি পুরসভা নির্বাচনেরই ফলাফল। ১৬/০ করার স্পর্ধিত ঘোষণা স্বত্ত্বেও এবারের নির্বাচনে দুটি ওয়ার্ড হারাতে হয়েছে শাসকদলকে। ১৬ টি ওয়ার্ডের মধ্যে দুটিতে হারা এমন কিছু হতাশাব্যঞ্জক নয়। বরং ২০১২ নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বেশ আশাব্যঞ্জক। ২০১২ সালে ১৫ টি আসনের মধ্যে ৮ টি পেয়েছিল শাসকদল। পরে দল বদল করে আরও দুজন তাদের সংগে যোগ দেয়। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। যে দুটি আসন শাসক দলকে হারাতে হয়েছে উন্নয়নের প্রশ্নে সেই আসন দুটিই তাদের কাছে কন্টকস্বরূপ। তার মধ্য অন্যতম হলো বিদায়ী উপ পুরপ্রধান ইমাম হোসেনের নির্বাচন কেন্দ্র ১ নং ওয়ার্ড।


                                              এবারে অবশ্য সংরক্ষণ জনিত কারণে প্রার্থী হয়েছিলেন তার স্ত্রী খালেদা বিবি। ফ:ব: প্রার্থীর কাছে হেরেছেন তিনি। অন্য ওয়ার্ডটি হলো ৮ নং। গত নির্বাচনে ওই ওয়ার্ডে সোশালিস্ট পার্টির সুব্রত দত্ত জিতেছিলেন। ২০১২ সালেই তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। অভিজ্ঞতা বলছে , দল বদলের সৌজন্যে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা শাসকদলে মন্ত্রীত্ব থেকে দলীয় পদে অভিষিক্ত হন। সেই হিসাবে হারা ওয়ার্ড দুটিতে তো উন্নয়ণের জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা। মানুষের তো দুহাত তুলে তাদেরই ভোট দেওয়ার কথা। তারপরেও কেন হারাতে হলো দুটি ওয়ার্ড ? 


                              অন্যদিকে ২০১২ সালে যে সব ওয়ার্ডগুলি শাসকদল হেরেছিল সেগুলিতে তাদেরই ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ছিটেফোঁটাও উন্নয়ন না হওয়ারই কথা। তাহলে সেই ওয়ার্ডগুলি কি করে শাসকদল দখল করল? ঘটনা বলছে, উন্নয়ণের জুজু কিছু নয়। আসল হচ্ছে ভোটারদের মানসিক দৃঢ়তা , রাজনৈতিক অবস্থান আড়াল রাখার কৌশল। এবারে নলহাটি পুরসভার নির্বাচন যারা দেখেছেন, তারা জানেন শাসক দলের নিজের স্বপক্ষে ভোট করে নেওয়ার কৌশল। তারা যদি ওই দুটি ওয়ার্ডে হার নিশ্চিত তা অনুমান করতে পারতেন তা হলে কি হত বলা যায় না।


                           তাই বোধহয় ফল ঘোষণার দিনেও দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকে ১৬/০ হওয়ার কথা বলতে শোনা যায়। কয়েক বছর আগেও আমারই পঞ্চায়েত এলাকার এক সি,পি,এম নেতাকেও উন্নয়নের জুজু দেখিয়ে প্রায় একই সুরে বলতে শুনেছিলাম ১২/০ ফলের কথা। সেই বছরই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় তারা। তাই প্রশ্ন জাগে , মানুষ মরীয়া হয়ে গেলে জুজু দেখিয়ে কি সত্যিই তাদের রোখা যায়? কতদিন যায় ?

                 -----০----

No comments:

Post a Comment