লোকটি
অর্ঘ্য ঘোষ
লোকটিকেএখন সবাই সুদাম পাগলা বলেই ডাকে। আর বলবেই না বা কেন? সুদাম যে এখন হাতের কাছে যাকেই পায় তাকেই পাগল বলে। কথাতেই আছে পাগলই সবাইকে পাগল বলে। বছর খানেক আগে অবশ্য অনেকেই তাকে রীতিমতো সমীহ করে সুদামবাবু বলে ডাকত। বর্ধমানের রায়না গ্রামে মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তার সাজানো সংসার। আর ছিল ইমারতী সামগ্রীর বিরাট ব্যবসা।
সুখে শান্তিতে বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। কিন্তু একদিন যেন শনি হয়ে বাড়িতে এল সুদামের স্কুল জীবনের বন্ধু গৌর। সে শাসক দলের তাবড় নেতা। সরাসরি সুদামকে বলল, শোন আমরা ঠিক করেছি এবার পঞ্চায়েতের সংরক্ষিত প্রধান পদে তোর স্ত্রীকে দাঁড় করাবো। প্রস্তাব শুনে এক কথাতেই না করে দেন সুদাম। গৌরও নাছোড়বান্দা। সে সুদামকে বোঝায় , শোন তোর যা কারবার তাতে একটা রাজনৈতিক কভার থাকা ভাল। তোলাবাজরা আর তাহলে জুলুম করতে পারবে না। কথাটা মনে ধরে সুদামের।
অগ্যতা নিমরাজি হয় সে। শেষ পর্যন্ত ভোটে জিতে পঞ্চায়েতের প্রধান হন সুদামের স্ত্রী জয়িতা। তারপর থেকেই কাজ কর্মের জন্যবাড়িতে দলের লোকেদের আনাগোনা বেড়ে যায়। যাতায়াত বাড়ে গৌরেরও। কাজের জন্য সুদামকে প্রায়ই বাইরে যেতে হয়। তখনও দলের লোকেরা বাড়িতে। রাত্রি পর্যন্ত চা খায়, গল্প গুজব করে তারা। তাদের ভরসাতেই বাইরে থাকার সময় কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকেন সুদামও। কিন্তু তা যে অমূলক তা ধরা পড়ে কয়েকদিন পরেই।
বাইরে থেকে ফিরেই শোনেন, তার একমাত্র মেয়ে দলেরই একটা বখে যাওয়া ছেলের সংগে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। খুব মুসড়ে পড়েন সুদাম। কারও সংগে কথা পর্যন্ত বলেন না। গৌর এসে বোঝাই, মন খারাপ করিস না। কারও সংগে মেয়ের বিয়ে তো তোকে দিতেই হত। সেই ঝামেলাটা তোকে পোহাতে হোল না। মনে অনেক কথা এলেও সুদাম তখন মুখে কিছুতেই বলতে পারল না, ছেলেটা ভালো হলেও কথা ছিল না। কিন্তু একমাত্র নয়নের মনিকে কে প্রানে ধরে একটা বখাটের সংগে মেনে নিতে পারে? মনের কথা মনেই থেকে যায়। ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ফের বাইরে যাওয়া আসা শুরু করেন সুদাম।
তারপর একদিন আকাশ ভেংগে পড়ে তার মাথায়। বাইরে থেকে ফিরে শোনেন গৌরর সংগে পালিয়েছে স্রী জয়িতা। দিন কয়েক ঘোরাঘুরি করে তাদের কোন খোজ মেলে না। মেয়ের বাড়ি ছাড়ার সময় সুদাম মুষড়ে পড়েছিল, এবারে ভেংগে পড়ল। ক্রমে মাথার গোলমাল দেখা দিল তার। শুধু বাড়ির সামনে ডাই করে রাখা বালি ছেটায় আর বলে পাগল পাগল। সেবারে দলের সম্মেলনে সুদামেরই বাড়ির অদুরে বিশাল তোরণ বাঁধা হল। ভাষণ দিতে এলেন প্রাদেশিক নেতা জাব্বার আলি।
দলের নেতাদের কাছে সব শুনে তিনি সুদামকে দেখতে এলেন। সুদাম তখনও বালি ছিটিয়ে চলেছে। জাব্বার সাহেবকে দেখে সুদাম হঠাৎ বলে ওঠে , হু-হু, বাবা জানি জানি। তোমরা সব সুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোও। গরীব দরদের ভাষণ দাও অথচ গরীবদের কথা থোড়াই ভাব। নাহলে দেশের লোকের লজ্জার ঢাকার জন্য এক ফালি কাপড় জুটছে না তখন তোমরা তোরণের বাঁশ ঢাকতে থান থান কাপড় নষ্ট কর? সব শুনে জাব্বার সাহেব বলেন, এ যে দেখছি সেয়ানা পাগল। পারিষদরা বলেন, যা বলেছেন মাইরি।
------০-----
ডাক্তারবাবু
বর্ষার রাত। ধুম জ্বরে ছোট্ট ছেলেটা ভুল বকেই চলেছে। স্ত্রী সনকা মাথায় জল পট্টি দিয়েও জ্বর নামাতে পারছে না।আর ঘরে স্থির থাকতে পারল না সৃষ্টিধর।গামছা মাথায় দিয়ে দৌড়ল পাশের গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার দিবাকর সরখেলের ডিসপেন্সারিতে। গরীব দুখীর কাছে ভগবানের পর ওই দিবাকর সরখেলই একমাত্র ভরসা।কারণ ২০ কিমির মধ্যে কোন সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নেই।
একবার ডেকেই সারা মিলল ডাক্তারবাবুর।রোগের বিবরণ শুনে ডাক্তারবাবু ব্যাগে ভরে নিলেন খল-নুড়ি, সিবাজল বড়ি, জোলাপ তৈরির মিক্সচার। তারপর আস্তাবল থেকে বের করলেন ঘোড়া। ব্যাগটা সৃষ্টিধরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে চাপলেন। তারপর বললেন , তুইও চেপে পড় ব্যাটা আমার পিছনে।
ততক্ষণে নেতিয়ে পড়েছে ছেলে। সনকাকে সরিয়ে চিকিৎসা শুরু করে দিলেন ডাক্তার। খল নুড়িতে তৈরি করা ওষুধ খাইয়ে দিলেন। ঘন ঘন থার্মোমিটারে জ্বর পরীক্ষা করতে করতেই রাত ভোর হয়ে যায়। এক সময় জ্বর নেমে যায়। মাঝখানে কাচের গ্লাসে ভেলি গুড়ের লাল চা দিয়ে যায় সনকা। তাই খেয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াতেই একটি থলে ডাক্তারবাবুর দিকে এগিয়ে ধরে সৃষ্টিধর। বলে,বাবু টাকা পয়সা তো নেই। হাঁসে গোটা কয় ডিম পেড়েছিল। সেই কটা নিয়ে যান।
শুনেই কটমট চোখে ডাক্তারবাবু ধমকে ওঠেন - এ বাগদি ব্যাটা বলে কি রে। আমাকে টাকা পয়সা দেখাচ্ছে। আরে ব্যাটা আমার বাপ-ঠাকুরদা যা রেখে গিয়েছেন তাই কি করে খরচ করবো ভেবে পাচ্ছি না, ও আবার আমাকে টাকা দেখাতে এসেছে। ওরে ব্যাটা ডিমগুলো তুলে রাখ,ছেলেকে রোজ সকালে একটা সিদ্ধ করে দিবি। গায়ে বল পাবে। পারলে তুই বরং কাল পরশুর মধ্য ঘোড়ার জন্য এক বোঝা ঘাস কেটে দিয়ে আসিস তাহলেই হবে।
বলেই ঘোড়ার পিঠে চাপেন ডাক্তারবাবু। সরমা -সৃষ্টিধররা আজও আছে। আছে তাদের নিত্য অভাবও। ছেলে মেয়েদের জ্বরজ্বালাও আছে। শুধু ঘোড়াগুলি আর নেই। নেই দিবাকর সরখেলেরাও। কোথাই যেন সব হারিয়ে গেল।
-------০------
অক্ষমতার জ্বালা
চাপটা আর নিতে পারছে না সমীরণ। সারাজীবন চুক্তিতে আয়করের খাতা লেখার কাজ করে সংসার সামলে ছেলেকে মানুষ করতেই শিরদাঁড়া বেঁকে গিয়েছে তার।লাঠি ছাড়া চলতেও পারে না।ডাক্তার বলেছে আর ঘাড় নুইয়ে ওইভাবে খাতা লেখার কাজ করা চলবে না।ডাক্তার তো বলেই খালাস।সে তো আর জানে না খাতা লেখা বন্ধ হলে সংসারও অচল।
বি , এ পাশ করার পরও ছেলের একটা চাকরি জোটে নি।যা সব শুনছে তাতে আর জুটবে বলে মনেও হয় না। স্ত্রী-ছেলের মুখের দিকে তাকাতেই পারে না সে।দোষটা যেন তারই।অন্য বাবারা তাদের আকাট ছেলের জন্য দিব্যি কেমন চাকরি যোগাড় করে নিচ্ছি আর সে স্টার নিয়ে পাশ করা ছেলের জন্যই কিছু করতে পারল না।তার কাছে কত নেতা-মন্ত্রী আসেন কাজ করাতে ।কিভাবে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে রির্টান দাখিল করতে হবে তার নির্দেশ দিয়ে যান।সে দু'চোখে দুনীতিগ্রস্থ ওইসব নেতা -মন্ত্রীদের দেখতে পারে না।কিন্তু পেটের দায়ে তাদের কাজ করতে হয়।তাই কোনদিন সে নিজের ছেলের চাকরির জন্য ওইসব নেতা-মন্ত্রীদের কিছু বলতে পারে না।মনে হয় যেন তাহলে সে ওদের কাছে সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অপরাধের সুযোগ নিচ্ছে।তাই সে শুধু অন্যের ছেলের চাকরি পাওয়ার খবর শোনে।এই তো কয়েকদিন আগেই পড়শি সাগর মন্ডলের ছেলে সুজিতের প্রাইমারির নিয়োগপত্র এসেছে।আর তারপর দিনই সাগর মন্ডলের বাড়িতে পাত্রীপক্ষ হাজির।
যৌতুক সামগ্রী সহ নগদ ১২ লক্ষ টাকায় একেবারে বিয়ে ফাইন্যাল।সেই কথা শুনে এসে সমীরণকে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলেন স্ত্রী অলকা। ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তিনি। থাকো এবার ধর্মপুত্তুর হয়ে , বোকার হদ্দ কোথাকার। কোন প্রত্যুত্তর করতে পারে না সমীরণ। পরিস্থিতিই তাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে।সমীরণের ছেলে শুভ্রও প্রাইমারীর পরীক্ষা দিয়েছিল। সুজিতের থেকে পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে থাকা মাধ্যমিকে স্টার নিয়ে পাশ করেও টেটে কোয়ালিফাই করতে পারে নি। সেই সময়ই সমীরণ কানাঘুষায় শুনেছিল ১০ লক্ষ টাকা দিলে নাকি চাকরি পাকা। সাগরের স্ত্রীর কাছে কথাটা শুনে এসে স্বামীর কাছে কথাটা পেড়েছিল অলকা। হ্যা গো , তোমার তো অনেক নেতা, মন্ত্রী, আমলাদের সংগে জানা শোনা। দেখ না টাকা পয়সা দিয়ে ছেলেটার কোন গতি করা যায় কিনা। ফুৎকারে
বি , এ পাশ করার পরও ছেলের একটা চাকরি জোটে নি।যা সব শুনছে তাতে আর জুটবে বলে মনেও হয় না। স্ত্রী-ছেলের মুখের দিকে তাকাতেই পারে না সে।দোষটা যেন তারই।অন্য বাবারা তাদের আকাট ছেলের জন্য দিব্যি কেমন চাকরি যোগাড় করে নিচ্ছি আর সে স্টার নিয়ে পাশ করা ছেলের জন্যই কিছু করতে পারল না।তার কাছে কত নেতা-মন্ত্রী আসেন কাজ করাতে ।কিভাবে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে রির্টান দাখিল করতে হবে তার নির্দেশ দিয়ে যান।সে দু'চোখে দুনীতিগ্রস্থ ওইসব নেতা -মন্ত্রীদের দেখতে পারে না।কিন্তু পেটের দায়ে তাদের কাজ করতে হয়।তাই কোনদিন সে নিজের ছেলের চাকরির জন্য ওইসব নেতা-মন্ত্রীদের কিছু বলতে পারে না।মনে হয় যেন তাহলে সে ওদের কাছে সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার অপরাধের সুযোগ নিচ্ছে।তাই সে শুধু অন্যের ছেলের চাকরি পাওয়ার খবর শোনে।এই তো কয়েকদিন আগেই পড়শি সাগর মন্ডলের ছেলে সুজিতের প্রাইমারির নিয়োগপত্র এসেছে।আর তারপর দিনই সাগর মন্ডলের বাড়িতে পাত্রীপক্ষ হাজির।
যৌতুক সামগ্রী সহ নগদ ১২ লক্ষ টাকায় একেবারে বিয়ে ফাইন্যাল।সেই কথা শুনে এসে সমীরণকে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলেন স্ত্রী অলকা। ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তিনি। থাকো এবার ধর্মপুত্তুর হয়ে , বোকার হদ্দ কোথাকার। কোন প্রত্যুত্তর করতে পারে না সমীরণ। পরিস্থিতিই তাকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে।সমীরণের ছেলে শুভ্রও প্রাইমারীর পরীক্ষা দিয়েছিল। সুজিতের থেকে পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে থাকা মাধ্যমিকে স্টার নিয়ে পাশ করেও টেটে কোয়ালিফাই করতে পারে নি। সেই সময়ই সমীরণ কানাঘুষায় শুনেছিল ১০ লক্ষ টাকা দিলে নাকি চাকরি পাকা। সাগরের স্ত্রীর কাছে কথাটা শুনে এসে স্বামীর কাছে কথাটা পেড়েছিল অলকা। হ্যা গো , তোমার তো অনেক নেতা, মন্ত্রী, আমলাদের সংগে জানা শোনা। দেখ না টাকা পয়সা দিয়ে ছেলেটার কোন গতি করা যায় কিনা। ফুৎকারে
সেদিন স্ত্রীর কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন সমীরণ। বলেছিলেন , আমি নিজের ছেলের জন্য কাউকে কিছু বলতে পারব না। তাছাড়া অত টাকাই বা কোথাই পাবো।দরকারে ছেলে ব্যবসা করে খাবে। কেউ তো বলতে পারবে না টাকা দিয়ে ছেলেকে চাকরি কিনে দিয়েছি।
সেই কথাটাই আজ ফিরিয়ে দিলেন স্ত্রী। বললেন, হোল তো। এবার থাকো তুমি তোমার সততা নিয়ে। আর ধুয়ে ধুয়ে জল খাও। শুধু বাড়িতেই নয় , যেখানে যায় সেই একই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় সমীরণকে। বন্ধুবান্ধব ছেলে বুড়ো সবাই বলে , কতজন টাকা পয়সা দিয়ে চাকরী বাগিয়ে নিল। তোমাদের এত জানাশোনা এই বাজারেও ছেলেটার জন্য একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে পারলে না ? এই বোকামি কেউ করে ? ঘরে বাইরে বারংবার একই প্রশ্নের সমুক্ষীণ হতে হতে মেজাজ হারিয়ে ফেলে সমীরণ।বাড়ি ফিরেই ছেলে- বৌয়ের সামনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেখানে তখন হাজির ছিলেন সাগর মন্ডলের স্ত্রী সুলতা।তার ছেলে শুভ্রর সঙ্গেই পড়েছে।গতকালই পাশের গ্রামের স্কুলে জয়েন করেছে। ফাল্গুনেই বিয়ে। সাতকাহন করে সেই গল্পই করছিল সুলতা। সেই শুনেই ফের গর্জ্জে ওঠে অলকা। বলে , শোন শোন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছাড়া তো মুরোদ নেই। আর নিতে পারে না সমীরণ।বলে ওঠে , তোমার ছেলে তো টেটে কোয়ালিফাই করতেই পারি নি।
শুনে মাথা নিচু হয়ে যায় ছেলের। তখন আসরে নামেন সমীর মন্ডলের গরবিনী স্ত্রী। বলেন , দাদা তখন আমাদের কথা তো কানে নিলেন না। সেইসময় যদি টাকা দিতেন তাহলে একসংগে ৮ লাখ করে দিলেই হয়ে যেত। রাজী হলেন না বলে ১০ লাখ দিতে হোল। দিয়েছিলাম বলেই তো সাদা খাতা জমা দিয়েও চাকরিটা তো হোল। এই তো বিয়ে দিয়ে সেই টাকা উসুল করেও ৪ লাখ টাকা বাড়তি ঢুকবে ঘরে। চাকরি না হলে তো কেউ অত টাকা পণ দিত না। যাই বলুন দাদা আপনি কিন্তু বোকামিই করলেন।সব শুনে কথা হারিয়ে ফেললেন সমীরণ। এই তাহলে টেট পাশের রহস্য ? সামনে দাঁড়িয়ে ছেলে তখন নত মুখে দাঁড়িয়ে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে অক্ষমতার জ্বালা তাকে কূঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। গালে চিকন দাড়িতে রোমান্টিকতার ছোঁওয়া। স্রেফ বাবার টাকার জোরে চাকরী কিনে তারই বন্ধু আগামী মাসে জীবনসঙ্গী পাবে ।এই বয়েস তো তেমনই চায়। সাত পাঁচ ভেবে কুল কিনারা পায় না সমীরণ। ঘুষ নেওয়া এবং দেওয়া দুইই অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু এমনই যদি পরিস্থিতি হয় তাহলে নিজে সৎ থাকা মানেই বোকা পরিগণিত হওয়া। কোন দিকে যাবে সে ? ইতিহাস, পুরাণ হাতড়াতে থাকে সে।
সেই কথাটাই আজ ফিরিয়ে দিলেন স্ত্রী। বললেন, হোল তো। এবার থাকো তুমি তোমার সততা নিয়ে। আর ধুয়ে ধুয়ে জল খাও। শুধু বাড়িতেই নয় , যেখানে যায় সেই একই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় সমীরণকে। বন্ধুবান্ধব ছেলে বুড়ো সবাই বলে , কতজন টাকা পয়সা দিয়ে চাকরী বাগিয়ে নিল। তোমাদের এত জানাশোনা এই বাজারেও ছেলেটার জন্য একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে পারলে না ? এই বোকামি কেউ করে ? ঘরে বাইরে বারংবার একই প্রশ্নের সমুক্ষীণ হতে হতে মেজাজ হারিয়ে ফেলে সমীরণ।বাড়ি ফিরেই ছেলে- বৌয়ের সামনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেখানে তখন হাজির ছিলেন সাগর মন্ডলের স্ত্রী সুলতা।তার ছেলে শুভ্রর সঙ্গেই পড়েছে।গতকালই পাশের গ্রামের স্কুলে জয়েন করেছে। ফাল্গুনেই বিয়ে। সাতকাহন করে সেই গল্পই করছিল সুলতা। সেই শুনেই ফের গর্জ্জে ওঠে অলকা। বলে , শোন শোন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছাড়া তো মুরোদ নেই। আর নিতে পারে না সমীরণ।বলে ওঠে , তোমার ছেলে তো টেটে কোয়ালিফাই করতেই পারি নি।
শুনে মাথা নিচু হয়ে যায় ছেলের। তখন আসরে নামেন সমীর মন্ডলের গরবিনী স্ত্রী। বলেন , দাদা তখন আমাদের কথা তো কানে নিলেন না। সেইসময় যদি টাকা দিতেন তাহলে একসংগে ৮ লাখ করে দিলেই হয়ে যেত। রাজী হলেন না বলে ১০ লাখ দিতে হোল। দিয়েছিলাম বলেই তো সাদা খাতা জমা দিয়েও চাকরিটা তো হোল। এই তো বিয়ে দিয়ে সেই টাকা উসুল করেও ৪ লাখ টাকা বাড়তি ঢুকবে ঘরে। চাকরি না হলে তো কেউ অত টাকা পণ দিত না। যাই বলুন দাদা আপনি কিন্তু বোকামিই করলেন।সব শুনে কথা হারিয়ে ফেললেন সমীরণ। এই তাহলে টেট পাশের রহস্য ? সামনে দাঁড়িয়ে ছেলে তখন নত মুখে দাঁড়িয়ে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে অক্ষমতার জ্বালা তাকে কূঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। গালে চিকন দাড়িতে রোমান্টিকতার ছোঁওয়া। স্রেফ বাবার টাকার জোরে চাকরী কিনে তারই বন্ধু আগামী মাসে জীবনসঙ্গী পাবে ।এই বয়েস তো তেমনই চায়। সাত পাঁচ ভেবে কুল কিনারা পায় না সমীরণ। ঘুষ নেওয়া এবং দেওয়া দুইই অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু এমনই যদি পরিস্থিতি হয় তাহলে নিজে সৎ থাকা মানেই বোকা পরিগণিত হওয়া। কোন দিকে যাবে সে ? ইতিহাস, পুরাণ হাতড়াতে থাকে সে।
------------০----------
রাজু ভাইয়ের কথা
লোকটির নাম নাসিম আহমেদ ওরফে রাজু মিয়াঁ। অনেকেই তাকে রাজুভাই বলে ডাকতেন। যৎসামান্য বেতনে কাজ করতেন লোকপাড়ার একটি বেসরকারি মোবাইল টাওয়ারে। বাড়ি ময়ুরেশ্বরে। মসজিদে নমাজ পরতে যেতেন না। কিন্তু ইসলাম বিরোধীও ছিলেন না। বরং ঈদ মহরমে গরীব দুস্থদের ৫০/১০০ টাকা জাকাত দিতেন। বলতেন, যত্তসব, নিজের বাবা মা'কে ভাত দেয় না। মসজিদে মৌলবীকে থালা ভর্তি খাবার পাঠাই। নমাজ পড়ে কপাল কালো করার থেকে কবিতা লেখা , বই পড়া ভালো।
বাস্তবিকই কাজের ফাঁকে রাজুভাই বই পড়তেন , কবিতা লিখে ভর্তি করতেন খাতার পর খাতা। সাহিত্যগুণ থাক বা নাই থাক হাতের কাছে যাকেই পেতেন ধরে ধরে শোনাতেন সেইসব কবিতা। আমাকেও শোনাতে আসতেন। কবিতা পাঠ শেষে বলতেন , দাদা স্কুলের মাষ্টার মশাইরা কবিতা শোনার পর খুব হাসাহাসি করে। আমি তখন মজা করে বলেছিলাম , রাজুভাই এবার থেকে আপনি প্রতিটি কবিতার শেষে ' নাসিম আহমের এই কবিতা শুনে ভাই /যদি কেউ হাসে বুঝবো তার মাথাই কোন বুদ্ধি নাই ' লাইন দুটো যোগ করে দেবেন। দেখবেন আর কেউ হাসবে না।
বলা বাহুল্য, তারপর থেকে ভনিতার মতো রাজুভাইয়ের কবিতায় যুক্ত হতে থাকে পঙক্তি দুটি। কাজও হয়। হাসি গিলতে বাধ্য হন অনেকেই। বোকা বনতে কেইবা চাই। কয়েক আগেই রাজুভাই মারা যান। মৃত্যুর আগে টাওয়ারে চুরি করতে এসে চোরেরা তার হাতপা ভেংগে দেয়। তারপর থেকে নানা রোগে ভুগছিলেন। মারা যাওয়ার আগে পরিবারের কাছে তার ঋণের কথা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের লোকেরা সেইসব ঋণ মিটিয়েও দিয়েছে।
আজ বড়ো অপরাধ বোধে ভুগি। নিজে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করি। অথচ রাজুভাইয়ের একটা কবিতাও তাতে ছাপতে পারি নি। সাহিত্য গুনের বিষয়টিই বড়ো হয়েছিল। তার মতো স্বল্প শিক্ষিত নুন আনতে পান্তা ফুরানো লোকের সাহিত্যনুরাগটা একবারও চোখে পড়ে নি।একটা কবিতা মেজে ঘসে ছাপলেই তার চোখে যে স্বর্গীয় খুশী ঝরে পরত তা তো আর দেখা হল না। রাজুভাইয়ের রচনা আমাদের হাসির খোরাক হয়েই থেকে গেল। তাই আমারই শেখানো পঙক্তি আজ বুমেরাং হয়ে আমারই হৃদয়ে বেঁধে ----নাসিম আহমের কবিতা শুনে।
No comments:
Post a Comment