Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

কবিতাগুচ্ছ - ১০



      পত্রকারের জবানী



           অর্ঘ্য ঘোষ



মদের গ্লাসে বরফের মতো চুইয়ে চুইয়ে সন্ধ্যা নামছে দূর খোয়াইয়ের বনে।

ব্যালকনিতে আমি একা একেবারে একা।

দুর শহরে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে ব্যস্ত সুবর্ণা।

শয্যাশায়ী পক্ষঘাতগ্রস্থ মা।

ব্যালকনিটাও আমার নেই।

চড়া সুদে বাধা সুবর্ণার সাজানো ফ্ল্যাট।

এক মাসের মধ্য ছেড়ে যেতে হবে  , কোথাই যাব জানি না। 

আমার তো আর যাওয়ার জায়গা নেই।

থাকার মধ্যে ট্রি টেবিলে সাজানো রয়েছে 

দুঃসময়ের জন্য জমিয়ে রাখা দামী মদ

আর  সুসময়ে কেনা সুদৃশ্য গ্লাস।

এসময় তোদের কথা খুউব মনে পড়ছে জানিস দেবু।

তোর মনে আছে দেবু আমাদের সেই বাউণ্ডুলেপনা।

সাহিত্য সভার খবর পেলে কোথাই না গিয়েছে আমরা 

কোটাসুরের দিদিভাই আশ্রম   , বিষ্ণুপ্রিয়া ঠাকুরের ডাকে পাহাড়পুর 

কিম্বা লাভপুরের ধাত্রীদেবতা।

তোর মনে পড়ে দেবু , প্রতিবার আমরা জয়দেবের মাঘমেলায় যেতাম। 

কনকনে ঠান্ডায় হরিদাস আখড়ায় খড়ের কুটো বিছিয়ে ওম খুঁজতাম।

গোল হয়ে বসে মাঝখানে বিছিয়ে নিতাম খবরের কাগজ।

তারই উপরে চুর করে ঢালা মূড়ি তেলেভাজা, লঙ্কার  বেগুনি ।

দেবু তোর মনে আছে , সুদীপ্তটা একদম ঝাল খেতে পারত না।

খেত আর খালি হু হা করত।

তুই মাথায় চাপড়ে দিয়ে বলতিস,

আহারে খোকন সোনা, বাড়ি যা মা দুধ ভাত মেখে বসে আছে।

মুখচোরা সুদীপ্তর মুখটা লাল হয়ে উঠত।

কবিতা লেখার হাতটা কি মিষ্টি ছিল সুদীপ্তর।

মুড়ি খেতে খেতেই আমরা মুখে মুখে বানাতাম কবিতা কোলাজ।

অনর্গল শক্তি, সুনীল, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আউরাতাম।

তোর মনে পড়ে দেবু , 

মানসের দিদির বিয়েতে গিয়ে সুদীপ্ত হঠাৎ তোকে প্রেমের 

প্রস্তাব দিয়ে বসেছিল।

তুই চোখ মটকে বলেছিলি,

 আগে সাবালক হ, ঝাল খেতে শেখ তারপর ভাবব।

মহালয়ার সেই ভোরটা আজও ছবির মতো যেন চোখের সামনে ভাসছে।

আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় গমগম করছে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র।

চারদিকে আগমনীর সুর।

কেবল বরলাতে সুদীপ্তর বাড়িটাই নিঝুম।

বিছানায় পড়ে রয়েছে সুদীপ্তর ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের মৃতদেহ।

বেচারা সুদীপ্তর কাঁদবার ফুরসতটুকু পর্যন্ত নেই।

তার চোখে মুখে মায়ের সৎকারের চিন্তা।

আমরা তখন সবাই কাঠ বেকার।

কিন্তু মনে তুড়িতে জগতকে উড়িয়ে দেওয়ার দৃঢতা।

সেই মনোভাব থেকেই তুই খুলে দিলি হাতের চুড়ি, 

সমরেশ হাতের ঘড়ি , চারু টিউশানি পড়ানোর টাকা, 

আমি লিটিলম্যাগের বিজ্ঞাপনের জন্য তোলা টাকা।

তারপর সেই দিনটার কথাও কি ভোলা যাবে কোনদিন ?

সবার জমানো টাকায় আমাদের প্রথম 

কবিতা সংকলন পাঁচ বাউণ্ডুলের পাঁচালি প্রকাশের স্মৃতি কি ভোলা যায় বল ?

আজ একে একে সব মনে পড়ে যাচ্ছে জানিস।

সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তোরা সবাই বেছে নিলি স্কুল মাষ্টারির নিরাপদ জীবন।

আমি হলাম পত্রকার, শুধুই পত্রকার।

চাইলে সেদিন তোদের মতো নিরাপদ জীবন বেছে নিতে পারতাম।

পারি নি কেন জানিস ?

 আমি জানতাম একসংগে দুটি কাজ ঠিকভাবে করা যায় না।

কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সব যেন কেমন অর্থহীন।

ন্যায়, নীতি নিষ্ঠা পাঠ্য বইয়েই মানায়।

তোরা আমার মুল্যবোধের এই পরিবর্তনে মনে মনে হাসছিস হয়তো।

আমিও হাসছি জানিস অর্থহীন হাসি।

তিন মাসের বেতন সহ অফিস ধরিয়ে দিয়েছে ছাঁটাইয়ের নোটিস। 

সবাই যেন কি করে জেনে গিয়েছে ব্যাপারটা।

যার সঙ্গে দেখা হয় সেই জিজ্ঞাসা করে, কি সব শুনছি , তুমি সেফ তো ?

জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোই ছেড়ে দিয়েছি। 

আমার হাসি আসবে না তো কার আসবে বল ?

তিনমাসে তো নিজে উদ্যোগী না একটা জীবন শেষ হয় না।

এখনও দেওয়ালের পেরেকে ঝুলছে প্রেস কার্ড, 

পাড়ার ছেলেদের দেওয়া মানপত্র।

টেবিলে পরিপাটি করে গোছানো ফ্যাক্স , ল্যাপটপ, পেন নোটবুক।

সবার ব্যস্ততা ফুরিয়ে গিয়েছে।

দায় নেই খবর নেওয়া ও দেওয়ার।

দরজায় সাঁটানো নেমপ্লেটটাও আজ গুরুত্বহীন।

বেশ কিছুক্ষন আগে সোনাঝুড়িতে পাখিদের কিচির মিচির থেমে গিয়েছে।

আমার বুকের ভিতর এখন সব সময় কুডাক ডেকেই চলে দলছুট যেন কোন পাখী।

জানিস ,আমি এখন রাতে ঘুমোতে পারিনা।

 দুশ্চিন্তায় অন্যের ঘুম উবে যাওয়ার কথা কত লিখেছি।

এখন ট্রেনের সিটি গুনে কেটে যায় আমার নির্ঘুম রাত।

এ সময় পেটে একটু মদ পড়া বড়ো দরকার।

কিন্তু বিশ্বাস কর , 

পাচদিন ধরে গ্লাসে ঢেলে রাখা মদে শুধু বরফ মেশাচ্ছি 

কিন্তু মুখ তুলতে পারছি না।

ঘুমের ওষুধ মেশানো গ্লাসে ভেসে ওঠছে মেয়ে, মা, স্ত্রীর মুখ।

কিছুতেই মুখগুলোকে বলতে পারছি না , 

এই নাও তিন মাসের টাকা, তারপর কি করবে জানি  না।

দেবু , ওদের জন্যই আমাকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

শুরু করতে হবে এক নতুন লড়াই।

 -----০------




    পড়ে পাওয়া




দুধের শিশু পাই না খেতে।  
       
গনেশে খায় দুধ।। 
                  
কুকুর থাকে দুধে ভাতে। 
             
মানুষ পাই না খুদ।।     
                
পাথর থাকে অট্টালিকায়।    
      
ফুটপাতেতে মানুষ।।

মানবতা ধুলোয় লুটায়।

উধাও মান আর হুশ।।

দশের মাথা দেশের নেতা।

ওরাই নাকি ভদ্রলোক।।  
            
 মুখ লুকোয় কোথা।

ওরা শোনায় পুন্যশ্লোক ।

দেশ-দশ শুধু কথার কথা।
   
আসল তো  সেই  লুটেই  খাওয়া। 
         
মিথ্যে ,যথা ধর্ম জয় তথা। 
           
বেঁচে থাকাটাই পড়ে পাওয়া।

    ---০---  




         চিরকুট



অনিমেষদা , আজও কি আমাকে মনে পড়ে ? 

বসন্তের মন কেমন করা উদাস দুপুরে । 
           
আমি রাই গো , গোঁসাই বাগানের রাই । 
                  
তুমি ছন্দ মিলিয়ে বলতে পোড়ে ও পোড়ায় ।

কথাটা তুমি সেদিন বলো নি মন্দ । 

আজ তা নিয়ে আমারও যত দ্বিধা- দ্বন্দ্ব । 
  
তুমি কি আজ আমারই মতো আছো ?    
              
ছক বন্দী জীবনে বাঁচার জন্যই বাঁচো ?  
   
কেন জানি না তোমার কথা মনে বড়ো পড়ে। 

অন্য রকম ভালো লাগায়  মন যায় ভরে । 

কত  সুখস্মৃতি , পাওয়া না পাওয়ার ব্যাথা । 
            
তোমারও কি  মনে পড়ে  সেসব কথা ?  

আমার তখন দ্বাদশ শ্রেণী , তুমি পড়ো এমে । 
                     
চোখে চোখ পড়লেই হৃদস্পন্দন যেত থেমে । 
                    
আমি তখন ফ্রক ছেড়ে সবে ধরেছি লাল পাড় শাড়ি । 
            
হোস্টেল থেকে দাদার সঙ্গে মাঝে মধ্যে তুমি আসতে বাড়ি ।  
              
কি যেন কি বলবে বলে দাঁড়িয়ে থাকতে নিভৃত গলির মুখে ।
  
আমার নাকের পাটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমত অজানা এক সুখে ।  
   
বলতে তুমি কাব্যি করে , ঘাম তো নয় ফুটেছে মুক্তো দানা ।  
       
আমি বলতাম , এ হলো তোমার কাব্যি শোনানোর বাহানা । 
       
অর্নগল আউড়ে যেতে শেক্সপিয়ার থেকে শেলি ।  
            
শক্তি , সুনীল , কাকে ছেড়ে কার কথা বলি। 

স্বাক্ষী হয়ে আছে কত নিরালা দুপুর , কত না হাসি খেলা ।  
        
সাজি হাতে কেটেছে কত শিউলি কুড়ানো শরতের ভোরবেলা । 

আসল কথাটি শুধু বলি বলি করে হয়নি কো বলা । 
    
সময়ের স্রোতে পাড়হীন পথে ভেসে ভেসে হারিয়ে গিয়েছে ভেলা ।
           
মনে মনে চেয়েছি কতবার শুধু একবার বল মুখ ফুটে । 
       
প্রেমের পরশখানি পেতে কিশোরী হৃদয় মরেছে মাথা কুটে । 
   
বুক ফেটে গেছে মুখ ফুটে তবু কিছু হয়নি বলা ।  
                
আশায় আশায় দিন কেটেছে , এক পাও সে পথে হয়নি চলা ।
     
শেষে ফাল্গুনের এক সন্ধ্যায় চিরকুট ধরিয়ে দিলেন হাতে ।  
         
সেই চিরকুট এখনও আমায় ঘুমোতে দেয় না রাতে ।
               
কোন সম্বোধন নয় , সরাসরি নয়কো কোন প্রেম প্রস্তাব ।   
   
কবিগুরুর গানে ভরা চিরকুটেই ফুটেছিল তোমার মনের ভাব ।
        
সেদিন অলখ্যে কত না কেঁদেছি , আক্ষেপ করেছি কত ।  
   
সেই তো দিলে , আগে দিলে কি এমন কি ক্ষতি হত ?  
          
আমার যে ফেরার আর পথ নেই ।  
                        
বিয়ে পাকা হয়ে গ্যাছে শেষ ফাল্গুনেই ।  
                     
বিয়ের রাতেও তোমায় খুঁজেছে তৃষিত নয়ন ।
            
কতবার এসেছো , সেদিন আসনি রাখতে  নিমন্ত্রণ ।
         
চিরকুটে লিখেছিলে ‘ টলটলে দুটি আঁখি , আনাগোনা করে লজ্জা।   
  
ও দুটি জানি বিষের পেয়ালা , আমার মৃত্যু শয্যা ’।  
            
সেই তুমি কেমন করে চোখ রাখবে চোখে ? 
                    
সেই কথাটি পড়েছে  মনে হাজার ব্যস্ততার ফাঁকে ।
          
এখন আমি ভালোই আছি , বলতে পারো আছি সুখে ।
         
বিবাহ বার্ষিকীতে বরের সঙ্গে সেলফি তুলি হাসিমুখে । 
      
প্রতি বছর বেড়াতে গ্যাংটক কিম্বা নৈনিতালে যায় ।   
            
মাঝে মধ্যে রেস্তোরাতে ক্যান্ডেললাইট ডিনারও খাই । 
              
আলামারিতে উপচে পড়ে নিত্য নুতন শাড়ি ।   
        
ব্যাঙ্ক লকারে থরে থরে গয়না রকমারি ।
              
বর আমার ব্যস্ত মানুষ রোজ হিল্লি দিল্লি ছোটে ।   
             
আমার মনের খবর নেওয়ার সময় নেইকো তার মোটে । 
                    
এখন আমি ভুলেই গ্যাছি বনলতা সেন কিম্বা মাধবীলতার কথা । 
           
ধুলোয় ঢেকেছে আজ প্রিয় সেই গীতবিতানেরও খাতা ।    
          
নাচের ঘুঙুর সরিয়ে শুধু ছেলের হোমটাস্ক করি মুখে মুখে ।  
            
তাহলেই বোঝ আমি কেমন আছি সুখে ।  
                   
শুধু আমায় ভুলিয়ে রাখে ছেলের মা ডাক । 
                 
থাক , এবার  আমার কথা থাক । 
                       
দাদার মুখেই শুনেছিলেম তুমি দুর শহরের কলেজেতে পড়াও ।  
      
গল্প কবিতা লিখে এখনও নাকি পত্রিকার পাতা ভরাও । 
    
চারিদিকে তোমার কত সুখ্যাতি কত না যশ নাম ।    
           
আমার সম্বল স্মৃতির চিরকুট ভরা হৃদয়ের গোপন খাম ।   
             
এখন আমি ফেসবুক - ম্যাসেঞ্জারে সময় কাটায়।  
      
অনিমেষ নামেরা থাকে আমার বন্ধু তালিকায় । 
    
ভাবি এমনি করেই একদিন তোমায় খুঁজে পাবো । 
                    
খুঁজতে খুঁজতে কত না অনিমেষকে ব্লক করেছি ভাবো ।
  
ফেসবুকে আসতেও কি দেরী করতে হয় ?
                   
ফেসবুকে তো আর অনিমেষ নাই ।

-----০------



                মানুষ



একটার পর একটা পোশাক খুলছে মানুষ।

আবার পড়ে নিচ্ছে নতুন পোশাক।  
                                   
এত বিচিত্র পোশাকে মানুষকে মানায়ও বটে।   
                        
একটার পর  মুখোশ খুলছে মানুষ।

আবার পড়ে নিচ্ছে অন্য মুখোশ ।  
     
এত রকমারি মুখোশে মানুষকে মানিয়েও যায়।   
  
পোশাক আর মুখোশের ভীড়ে 

আসল মানুষকে চেনা বড়ো দায়।

আহা মানুষের আজ কি বাহার  

সাদা গায়ে শুধু কাদার পাহাড়।  

সর্বক্ষণ শুধু ঠকে যাব , ঠকে যাব এই ভয় হয়। 
                            
অথচ সারাটা জীবন আমরা ঠকি , নয়তো ঠকাই।  



    ------০------

             

            বোধ


আমাদের নিজস্ব কোন বাগান ছিল না।  
                                
তবু আমরা ফুলের গন্ধ পেতাম 
      
প্রতিদিন ,প্রতিনিয়ত। 
                  
আমাদের নিজস্ব কোন অসুখ ছিল না।    
                              
তবু অন্যের অসুখের কথা ভাবতাম।      
                           
অবিরাম ,অবিরত।
         
আগে আমরা পাড় উঁচু দীঘির কাছে যেতাম।  

                       
বসতাম, কাজলা কালো জল আঁচলা ভরে খেতাম।   
              
আমাদের এইসব চেতনা,এইসব বোধ হঠাৎ আসে।

তারপর একদিন হঠাৎই হারায়। 

শুধু স্বপ্নের রেশ লেগে থাকে 
      
নয়ন চোঁয়ানো শিশিরে ভেজা ঘাসফুলে। 
                                 
আগে আমরা মানুষের কথা বলতাম।

ইদানিং আর বলি না।

কথারা আজ বড়ো  ব্যাথা  দেয়।
  
ব্যাথার ভারে লতানো মানুষের কথা 

আমরা এখনও কি ভাবি ?
    
ভাবতাম কোনদিনও ?
       ---০---

No comments:

Post a Comment