Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

লুপ্তপ্রায় খেলা -- ৩৬



  


   
 ( শুরু হল হারিয়ে যাওয়া বা হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন খেলা নিয়ে ধারাবাহিক লেখা  )


               লুপ্তপ্রায় খেলা 


                           
                   

                 ( ছবি - সোমনাথ মুস্তাফি )

                       

                    ' মার্বেল খেলা ' 


বছর তিরিশেক আগেও গ্রামে তেমন দোকানপাট ছিল না। কিন্তু শীত অর্থাৎ ধানতোলার মরসুম এলেই অলিতে গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠত অস্থায়ী দোকানপাট। গ্রামবাসীরা ধানের বিনিময়ে ওইসব দোকান থেকে কিনতেন তেলেভাজা , সস্তার প্রসাধনী সহ অন্যান্য সামগ্রী। কচিকাঁচারাও ওইসময় মাঠে মাঠে ঘুরে ঝড়ে পড়া ধানের শিষ কুড়িয়ে নিয়ে ভিড় জমাত ওইসব দোকানে। ধানের বিনিময়ে তারা যা কিনত তার মধ্যে অন্যতম ছিল ' মারবেল ' বা গুলি।ওইসময় ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে ঘুরত রংবেরংয়ের ' মার্বেল।' অপেক্ষাকৃত মোটা সাদা রংয়ের চিনামাটির মার্বেলও মিলত। তাই মূলত শীতকাল থেকে শুরু হয়ে যেত ওই খেলা। যতদিন দোকানে এবং নিজেদের সংগ্রহের মারবেল শেষ না হত ততদিন চলত খেলা।বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ওই খেলা বড়ো একটা খেলতে দেখা যায় না।তাই আজ আর দোকানে মার্বেলের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে।   



                                  ' মার্বেল ' খেলা মূলত চারপ্রকার। জেতাজিতি , খাটাখাটি , গাইবাছুর এবং ' ওয়ান-টু।' 'জেতাজিতি ' একককেন্দ্রিক খেলা।১০/১২ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে ওই খেলা চলে।খেলার জন্য প্রয়োজন গোবর দিয়ে তকতকে করে নিকানো উঠোন।সেই উঠোনের মাঝখানে ছোট্ট একটি গর্ত করা হয়।খেলার ভাষায় গর্তটি ' গোপ ' হিসাবে পরিচিত।গোপ থেকে ফুট দুয়েক দুরে তিন ফুট একটি সরলরেখা টানা হয়। সেটিকে বলা হয় ' গচ্চা ' দাগ।' গচ্চা ' দাগ থেকে ফুট সাতেক দুরে আরও একটি সরলরেখা টানা হয়।সেটির প্রচলিত নাম ' দানঘর বা দানদাগ।'  ক্রমানুযায়ী  কে কার পর দান নেবে তা স্থির করে নেওয়া হয় কোন গণনা পদ্ধতির মাধ্যমে।প্রথমেই আলোচনার মাধ্যমে স্থির করে নেওয়া হয় ' এক - এক , দুই-দুই না তিন-তিন ' খেলা হবে।অর্থাৎ প্রতিজন খেলোয়াড়কে ' এক-একে একটি , দুই -দুইয়ে দুটি  , তিন তিনে তিনটি বা ততোধিক সংখ্যক মার্বেল দিয়ে খেলা শুরু করতে হয়।তবে ' এক -এক ' খেলাই বেশি প্রচলিত।       



                                                     নিয়ম হলো , নির্ধারিত সংখ্যক মার্বেল সবাইকে  প্রথম দানচালকারীর হাতে তুলে দিতে হয়। দানচালকারী সমস্ত মার্বেল হাতের তালুর উপর রেখে ' গোপ ' নিশানা করে ছুড়ে দেয়।ছোড়ার সময় তাকে দুটি বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়। বিষয় দুটি হলো, 'দানদাগে' পা দেওয়া থেকে বিরত থাকা আর গোপ নিশানা করে ছোড়ার সময় সমস্ত মার্বেলকে গচ্চাদাগ পার করা। কিন্তু ওই দুটি নিয়ম লঙ্ঘিত হলে তাকে 'গচ্চা' দিতে হয়।অর্থাৎ যত সংখ্যক মার্বেল বা গুলি দিয়ে এক-এক জন খেলা শুরু করেছিল সেই সংখ্যক গুলি পূর্বের গুলির সঙ্গে যোগ দিয়ে ফের দান চালতে হয়। যতবার নিয়ম লঙ্ঘিত হয় ততবারই ' গচ্চা।' লাগে।সেক্ষেত্রে নিজের কাছে গুলি না থাকলে অন্যের থেকে ধার নেওয়া যেতে পারে।পরে অবস্থা ফিরলে অর্থাৎ দান জিততে পারলে অবশ্য সুদ সহ সেই ধার শোধ দিতে হয়।কিন্তু ধার না মিললে অর্থাৎ গচ্চা দিতে না পারল ' মরা ' হয়ে বসে থাকতে হয় তাকে।সবার একবার করে দান নেওয়ার পর সে দান নেওয়ার সুযোগ লাভ করে। তবে ততক্ষণ পর্যন্ত দান চালু থাকলে তবেই সেই সুযোগ মেলে।কেউ তার মধ্যে দান জিতে নিলে আর ওই সুযোগ মেলে না।


                                                    কিন্তু  'গচ্চা ' বাঁচিয়ে সফল ভাবে দান চেলে দানচালকারী যদি এক বা বা একধিক গুলি গোপে ফেলতে পারে তাহলে সেগুলি তার পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তবে ওইসব গুলি পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে আরও একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। সেই পরীক্ষাটি হলো ' মার।' ওই পর্যায় অন্যান্য খেলোয়াড়রা গোপের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা গুলির মধ্যে একটিকে নিদিষ্ট করে দেয়। দানচালকারীকে ' আটা ' অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত মোটা গুলি বা চিনামাটির গুলি দিয়ে সেই গুলিটিকে নিশানা করে মারতে বা স্পর্শ করাতে হয়।কোথাও কোথাও আবার নিদিষ্ট করে দেওয়া গুটিটিকে বাদ দিয়ে অন্যগুলির মধ্যে যেকোন একটি মারার নিয়ম প্রচলিত আছে।সেক্ষেত্রে নির্ধারিত গুটি কিম্বা একই সঙ্গে একাধিক গুটি মারা পড়লেই গচ্চা দিতে হয়। মারার ক্ষেত্রেও দু'রকম নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। একটি হল ' গুরু গুরু ' অর্থাৎ হাত দিয়ে আঁটাটিকে আলতো ভাবে গড়িয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট গুটিটিকে স্পর্শ করাতে হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হল , টিসানো।ওই পদ্ধতিতে নিদিষ্ট গুলি নিশানা করে আটা ছুড়ে মারতে হয়। সফল ভাবে নিদিষ্ট গুলিকে মারতে পারলেই ' দানচালকারী' দান জিতে যায়।সেক্ষেত্রে 'গোপে 'পড়া সহ অন্যান্য গুলিও তার হয়ে যায়। আটা নিদ্দিষ্ট গুলি স্পর্শ করতে না পারলে তাকে শুধুমাত্র 'গোপে' পড়া গুলি নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু আটা যদি ' গচ্চা ' দাগ পার হতে অসমর্থ  হয় বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অন্য গুলি স্পর্শ করে তাহলে সমস্ত সুযোগ হারিয়ে তাকে গচ্চা দিতে হয়।আগের মতোই গচ্চা দিলে অবশ্য ফের দান নেওয়ার সুযোগ আছে। একই ভাবে ক্রমান্বয়ে বাকিরা দান পায়।                                             


                                                      খাটাখাটি নুন্যতম দু'জন বা দুটি দল মিলে খেলা চলে। ওই খেলায় কে আগে দান নেবে অর্থাৎ খাটানোর অধিকারী হবে তা টসের মাধ্যমে স্থির করে নেওয়া হয়। ওই খেলায় প্রথমে মাটিতে দাগ কেটে তৈরি করে নেওয়া হয় একটি বর্গাকার ঘর। সেখান থেকে ১৫/২০ ফুট দুরে সরলরেখা টেনে তৈরি করা হয় দান দাগ। নিয়মানুযায়ী যে বা যারা টসে হারে তাদের ওই ঘরে একটি করে মার্বেল বা গুলি রাখতে হয়। ওই দাগ থেকে দানচালকারীরা বর্গাকার ঘর নিশানা করে নিজ নিজ ' আটা ' ছুড়ে দেয়।এরপর সুবিধা মতো একটি আঙুলের মাথায় আটাটি  রেখে অন্য দুটি আঙুল দিয়ে পিছনে টেনে বিপক্ষের একটি গুলি নিশানা করে সজোরে মেরে বর্গাকার ঘরের দাগ থেকে কমপক্ষে চার আঙুল দুরত্বে পাঠাতে হয়।নাহলে সে খাটানোর সুযোগ হারায়। তখন বাকিরা খাটানোর চেষ্টা করে।কিন্তু দানচালকারী যদি চার আঙুল দুরত্বের মধ্যে গুটি বের করতে পারে তাহলে একই কায়দায় বিপক্ষের গুলি দুরে পাঠানোর সুযোগ লাভ করে। লক্ষ্যভ্রষ্ট অর্থাৎ ওইভাবে আটা ছুড়ে বিপক্ষের গুলি স্পর্শ করাতে ব্যর্থ না হওয়া পর্যন্ত সে একই ভাবে বিপক্ষের গুলি দুরে পাঠানোর সুযোগ পায়।কিন্তু যেখানে সে ব্যর্থ হয় সেখান থেকে বিপক্ষকে বসে বসে কুনুই কিম্বা হাতের একটি আঙুল মুড়ে ঠেলা দিতে দিতে ' নাকে খত ' দেওয়ার কায়দায় বর্গাকার ঘরে পৌঁচ্ছে দিতে হয়। ওই প্রক্রিয়াকে বলে ' খাটাখাটি।'  খাটাখাটি চলাকালীন বিপক্ষকে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি কিম্বা টিকাটিপ্পনী কেটে রাগানোর চেষ্টা করে চালকারীরা।কিন্তু সেইসব উপেক্ষা করে একে একে অন্যান্য খেলোয়াড়দের খাটা সম্পুর্ণ করলে তবেই বিপক্ষরা দান পায়। একজন খেলোয়াড় বিপক্ষের একজন মাত্র খেলোয়াড়কেই খাটাতে পারে।



                       যেকোন সংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে মূলত এককভাবে খেলা হয় ' গাই - বাছুর ' । এক্ষেত্রে একাধিক রেখা দিয়ে বিভক্ত বর্গাকার ঘরে সবাইকে একটি করে গুলি রাখতে হয়। মাঝের গুলিটি গাই এবং বাকিগুলি বাছুর নামে পরিচিত। নিয়মানুযায়ী , সকলকে ২০/২৫ ফুট দুর থেকে বর্গাকার ঘর অভিমুখে নিজেদের আটা ছুড়ে দিতে হয়। যার আটা সব থেকে দুরে পড়ে সেই প্রথমে দান চালার অধিকারী হয়। খাটাখাটির মতো এক্ষেত্রেও তাকে একই ভাবে আঙুলের সাহায্যে আটা ছুড়ে প্রথমে বর্গাকার ঘরের কমপক্ষে চার আঙুল দুরত্বের বাইরে একটি বাছুর বের করতে হয়। যদি সফল ভাবে বাছুর বের করা সম্ভব হয় তাহলে একই কায়দায় বাকি বাছুরগুলিও বের করার সুযোগ মেলে।কিন্তু কোন ক্ষেত্রে বাছুর চার আঙুল দুরত্ব অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে দানচালকারী গচ্চা হিসাবে আরও একটি গুলি দিয়ে ফের নির্ধারিত দুরত্ব থেকে আটা ছুড়ে খেলায় সামিল হওয়ার সুযোগ লাভ করে। তখন দ্বিতীয় দুরত্বে অবস্থানকারী দান চালা শুরু করে।কিন্তু কোন খেলোয়াড় যদি গচ্চা এড়িয়ে সমস্ত বাছুর বের করার পর একই কায়দায় গাইও বের করতে পারে তাহলে তাহলে ক্রমান্বয়ে বেশি দুরত্বে অবস্থানকারী খেলোয়াড়রা একই কায়দায় গাই বের করা স্থানে থাকা দানচালকারীর আটা নিশানা করে নিজেদের আটা ছোড়ে।যার আটা প্রথম দানচালকারীর আটাকে আঘাত করতে পারে সে সমস্ত গুটি বা গুলি পেয়ে যায়। অন্যথায় সকলে ব্যর্থ হলে দানচালকারীই গাই-বাছুরের মালিক হয়ে যায়।



                                            ওয়ান-টু খেলায় জেতাজিতির মতোই গোপ করা হয় । দানদাগ অপেক্ষেকৃত কিছুটা বেশি দুরত্ব থাকে। এক্ষেত্রে সকলকেই একে একে অথবা একসঙ্গে দানদাগ থেকে গোপ নিশানা করে নিজ নিজ গুটি ছুড়তে হয়। ছোড়ার পর যার যার গুটি গোপে ঢোকে সে মোর আওতার বাইরে চলে যায়। এরপর ক্রমান্বয়ে সর্বাধিক দুরত্বে পড়া গুটির মালিকেরা একে একে আঙুলের টিপে গুটি ছুড়তে ছুড়তে ' ওয়ান -টু - থ্রি থেকে টেন পর্যন্ত গণনা সহ গোপে ঢোকাতে পারলেই সে ' মোর ' আওতার বাইরে চলে যায়।ওই ভাবে একে একে অন্যরাও মোর আওতার বাইরে চলে যাওয়ার পর শেষে যে পড়ে থাকে তাকেই ' মোর ' মেনে নিতে হয়। তখন ' মোরধারীকে ' পূর্ব নির্ধারিত দুরত্ব থেকে ফের নিজের গুটি ছুড়তে হয় গোপ নিশানা করে।গুটি গোপে ঢুকলে তাকে আর ' মোর ' খাটতে হয় না।কিন্তু তার নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে বাকি খেলোয়াড়রা নির্ধারিত দুরত্ব থেকে তার গুটি নিশানা করে নিজেদের গুটি ছোড়ে।তারপর আঙুলের টিপে মোরধারীর গুটি দুরে পাঠানোর চেষ্টা করে।ওই সময় প্রতিটি টিপ মারার সময় সমস্ত খেলোয়াড় ক্রমান্বয়ে ' এক - এ - ইঁদুর , দুই - এ- দাঁত , তিন - এ - তেঁতেন , চার - এ - চোর , পাঁচ- এ পঁচো , ছয় - এ ছুঁচো , সাত-এ - শালিক , আট - এ - এঁটুলি , নয় - এ - ন'সমন্ধ , দশ-এ - বিয়ে বলে মোরধারীকে রাগায় বা  খেপায়। ওইভাবে ' মোরধারী'র গুটি  দুরে পাঠানোর সময় একে একে সবার গুটি লক্ষ্যভ্রষ্ট অর্থাৎ মোরধারীর গুটিকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হলে খাটা শুরু হয় মোরধারীর। তখন মোরধারীকে দুরে চলে যাওয়া গুটি আঙুলের টিপ মেরে গোপে ফিরিয়ে আনতে হয়। যত টিপ ব্যর্থ হয় ততবার অন্যান্য খেলোয়াড়রা তাকে ' এক - এ- একটা ছেলে , দুই - এ - দুটো ছেলে 'বলে রাগাতে থাকে।সব হজম করতে হয় মোরধারীকে। গোপে গুটি না ঢোকা পর্যন্ত তার রেহাই মেলে না।তারপর ফের নতুন ভাবে খেলা শুরু হয়।         
                

      ( চলবে )


         নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 



    


                      --------০--------
                                                                                 
                                                                                       
                                   

No comments:

Post a Comment