ঠাকরুন মা
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
আক্ষেপ ঝরে পড়ে তার গলায় -- সেটা হলে তো ভালোই হতো রে। জন্মই শুধু দিয়েছি তোদের , বাবা হিসাবে কোন কর্তব্যই তো করতে পারি নি। আমার তো গাছতলাতেই থাকাউচিত ছিল। কিন্তু মদনদা সে আর থাকতে দিলেন কই ?
----- মদনদা! মানে কি আমাদের গোমস্তাকাকা ? কি করেছেন উনি ?
----- হ্যা রে , তোদের গোমস্তা কাকাই তো আমাকে দু-দুবার বাঁচালেন লোক লজ্জার হাত থেকে । আগের ঘটনা তোর অজানা নেই , আর এবারও উনিই তো কয়েকদিন আগে গিয়ে ওইসবজিনিস দিয়ে এসেছেন। আমি প্রথমে নিতে চায় নি , কিন্তু উনি বললেন, অন্নপূর্ণাবুঝি আমার মেয়ে নয় ? তখন আর হাত গুটিয়ে থাকতে পারিনি রে মা। গোমস্তাকাকাকে যতদেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে অন্নপূর্ণা। মানুষে মানুষে কত তফাত। তার শ্বশুরবাড়ির লোকরা তার আপনজন হয়েও দেনা-পাওনার ব্যাপারে কত নির্মম , আর তাদেরই অন্নে প্রতিপালিত হয়েও গোমস্তাকাকা কত মানবিক। অথচ যৎসামান্য বেতনে খুব মেপেজুপে সংসার চালাতে হয় তাকে। সেই প্রসঙ্গে কিছু বললেই একগাল হেসে উড়িয়ে
দেবেন সব। বলবেন , মোটে তো দুজন মাত্র লোক। বেতনের সব টাকা নিজেদের কাজে লাগালে সংসারে হয়তো আরও কিছু সুখ কিনতে পারতাম। কিন্তু শান্তি কিনতে পারতাম কি ? আমার আর কতটুকুই বা সামর্থ্য ?সীমিত সেই সামর্থ্য দিয়েই আমি নিজের জন্য সুখকেনার পরিবর্তে আমার চারপাশের মানুষগুলোর জন্য কিছু করে আমি শান্তি কিনতে চায়।
------- এইভাবে সবাইকে সব দিয়ে দিচ্ছেন , বিপদ আপদ যদি কিছু একটা হয় ?
------- আমার বিপদ আপদ কিছু হবে না। আর হলে কেউ না কেউ ঠিক পাশে দাঁড়াবে। নাহলে দিনরাত্রি হতো না , চন্দ্র সূর্য উঠত না।
গোমস্তাকাকার কথা শুনতে শুনতে কেমন যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে যায় অন্নপূর্ণার মন । অজান্তেই জল আসে চোখে। কত বড়ো হৃদয় থাকলে তবেই মানুষের প্রতিবিশ্বাস রাখা যায় , বিপদ আপদে ভরসা রাখা যায়। শুধু তার ক্ষেত্রেই নয় , অন্নপূর্ণা বাবার মুখে শুনেছে অভাবের জন্য যারা জমিদারের খাজনা দিতে পারে না তাদেরও নানা ভাবে সাহায্য করেন গোমস্তাকাকা। তাদেরও তো ঋণের অন্ত নেই গোমস্তাকাকার কাছে। শুধু বোনের হার কিম্বা বাসন্তীর মুখেভাতের ওইসব জিনিসপত্রই তো নয় , গোমস্তাকাকার উদার হৃদয়ের পরিচয় মিলেছে বারবার। বাসন্তীর মতোই প্রতিটি সন্তানের জন্যই গোমস্তাকাকা একইভাবে গোপনে বাবার হাতে সব কিনে দিয়ে এসেছেন।বংশরক্ষার তাগিদে শাশুড়ি মায়ের চাপে পুত্র সন্তানের জন্য পর পর পাঁচটি মেয়ের জন্ম দিতে হয় তাকে। সেজমেয়ে হৈমন্তীর জন্মের পর খুব মুষড়ে পড়ে অন্নপূর্ণা।শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কাছে গঞ্জনা শুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত হয়ে পড়ে সে। অঢেল
রূপের সঙ্গে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেয় হৈমন্তী। তার দুটি পা ' ই সরু লিকলিকে। হাঁটা চলা করতেই পারে না। হামাগুড়ি দিয়ে চলা ফেরা করে। ভগবান কেন যে বারবার তার সঙ্গে এমন করেন , তা ভেবে পায় না সে। তবে এসবের মাঝেও ভগবান কিছুটা যেন মুখ তুলে চান। পাঁচ মেয়ের পর তার কোল আলো করে আসে পর পর দুটি পুত্র
সন্তান। একটি পুত্রের পর অবশ্য সে আর মা হতে চায় নি। কিন্তু শাশুড়ি জেদ ধরেছিলেন , এক ছেলের উপর ভরসা করা যায় না। বিপদ আপদ হতে কতক্ষণ। অগত্যা আবার মা হতে হয়েছিল তাকে। পুত্র সন্তান জন্মানোর পর প্রতিবন্ধী মেয়ে জন্ম দেওয়ার গঞ্জনাটা কিছুটা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু অন্নপূর্নার চিন্তা যায় না মেয়েটাকে নিয়ে । জমিদারবাড়ির অবস্থাও সেই রকম নয় , নামটুকুই সম্বল। তার উপরে স্বামী তেমন কিছুই করেন না। দুই ভাসুর তবু জমিজমা কিছুটা দেখাশুনো করে নিজ নিজ আখের গুছানোর চেষ্টা করেন।
গোমস্তাকাকার কাছেই আভাসে ইংগিতে তার কিছু খবর সে পায়। গোমস্তাকাকাই বলেন , মা ছোটবাবু তো কিছুই দেখেন না। পরে কি যে হবে।
----- কি আর হবে কাকা , মাথার উপরে তো শ্বশুর -- শাশুড়ি আছেন। যা করার ওনারাই করবেন।
----- ওনারাও তো চিরদিন থাকবেন না , তখন কি হবে ?
---- তখন আপনি থাকবেন। আমাদেরটা আপনি দেখবেন।
---- আমিই কি আর তখন থাকব মা ? জমিদারিও তখন আর থাকবে কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে ছোটবাবুর জমি সব লুটে পুটে না নেয়।
----- সে যেদিন যা হওয়ার হবে। আগে থেকে ভেবে তো আর কিছু করতে পারব না।
কথাগুলো বলে বটে, কিন্তু দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিতে পারে না সে। সাতটা ছেলেমেয়ে , তার মধ্যে আবার এক মেয়ে প্রতিবন্ধী। প্রতিবছর জমিদারির আয় কমছে। শ্বশুরমশাই প্রায়ই ভাসুরদের সঙ্গে আলোচনা করেন , জমিদারি আর থাকবে না মনে হচ্ছে। সরকার নিয়ে নেবে। যদি সত্যিই তাই হয় , তাহলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যে পথে বসতে হবে
অন্নপূর্ণাকে। তার আশংকাই যেন সত্যি হয় শেষ পর্যন্ত। বিপর্যয়ের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসে জমিদারবাড়িতে। কয়েকদিন ধরেই শ্বশুরমশাই আর ভাসুরদের মধ্য কেমন একটা চাপা উদ্বেগ লক্ষ্য করছিল অন্নপূর্ণা। কিন্তু কয়েকদিন পর বিষয়টি আর চাপা থাকে না। সেদিন সকালে তখন সবার হাতে চায়ের কাপ। তারই মাঝে পিওন এসে একটি চিঠি ধরিয়ে দেয় শ্বশুরমশাইয়ের হাতে। চিঠিটি পড়ে গুম মেরে যান শ্বশুরমশাই। সবাই তখন তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ পরেই মুখ খোলেন তিনি। কিন্তু এক লহমায় গলার জোর যেন অনেকখানি কমে গিয়েছে। ক্ষীণ স্বরে বলেন , যা ভয় করেছিলাম তাইই হয়েছে সরকারের ঘর থেকে চিঠি এসেছে , বেশিরভাগ জমিই ছেড়ে দিতে হবে। জমিদারি আর থাকবে না। কথাটা শুনেই সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। দুশ্চিন্তায় পড়ে অন্নপূর্ণাও। ভাসুদের তো দুটি করে মেয়ে। তারই কেবল সাতটি ছেলেমেয়ে। তার মধ্যে আবার একটি প্রতিবন্ধী। তাছাড়া ভাসুরদের সব নিজস্ব সঞ্চয় রয়েছে। তাদেরই কেবল কিছু নেই। জমিদারি তহবিল থেকে মাসিক যৎসামান্য কিছু টাকা মেলে , তাতেই স্বামীর হাত খরচ সহ ছেলেমেয়েদের টুকিটাকি খরচ জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হয়। তাই জমিদারি চলে গেলে কি হবে ভেবে পায় না অন্নপূর্ণা। স্বামী যে কোন কাজ করে পরিস্থিতির সামাল দেবেন সেই সম্ভাবনাও নেই। কারণ আর পাঁচটা জমিদারবাড়ির ছেলেদের যা হয় তার স্বামীর ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছে। ছোট থেকে বিলাস ব্যসনে মানুষ
হওয়ার ফলে না হয়েছে লেখাপড়া , না গড়ে উঠেছে কোন কাজ করার মানসিকতা। বাপের বাড়ির অবস্থাও তো ওই। সেখান থেকেও কোন সাহায্য পাওয়ার সম্ভবনা নেই। একটা ভরসার জায়গা ছিল গোমস্তাকাকা। কিন্তু জমিদারি চলে গেলে গোমস্তাকাকারও তো একই হাল হবে। ভগবান যদি কোনদিন মুখ তুলে চান তাহলে সে'ই গোমস্তাকাকার দায়িত্ব নেবে। কারণ গোমস্তাকাকা তাকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন।
কিন্তু ভগবান কোনদিন তার আশা পূরণ করবে বলে মনে হয়না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তো সরল সাধাসিধে মানুষের প্রতি ভগবান মুখ তুলে চাওয়ারই সময় পায় না বলে অন্নপূর্ণার মনে হয়। তাই সব থেকে মুষড়ে পড়ে অন্নপূর্ণা। কেমন যেন একটা বিপর্যয়ের আঁচ পায় সে। তাকে আরও শঙ্কিত করে তোলে শ্বশুরমশাইয়ের দীর্ঘনিশ্বাস। মনকে স্বান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তিনি নানা রকম আশার কথা শোনান। পরক্ষণেই আবার নিজেই হতাশায় মাথা নাড়ান। তার ওই ভাবগতিক দেখে শাশুড়িমা প্রশ্ন করেন -- তাহলে কি হবে ?
----- সহজে আমি ছেড়ে দেব না। সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাব। মদনকে একবার ডেকে পাঠাও।
একটু পরেই গোমস্তাকাকা এসে পৌঁছোন। শ্বশুরমমশাই তার উদেশ্যে বলেন, খবর সব শুনেছো নিশ্চয়। তিন আনিদের খবর কি ? ওদের কাছেও নিশ্চয় চিঠি আসবে।
তিনআনির জমিদার হরশংকর একসময় শ্বশুরমাশাইদেরই শরিক ছিলেন। কিন্তু এখন আর কোন সৌহাদ্যই নেই। বরং এখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ। সুযোগ পেলেই কোণঠাঁসা করার চেষ্টা করে তাদের। হরশংকরবাবুদের কথা উঠতেই গোমস্তাকাকা বলেন, চিঠি একটা ওদের নামেও এসেছে শুনেছি। কিন্তু তাতে তো ওদের খুব একটা বেকায়দা করতে পারবে না।
---- কেন ? কেন ?
----- কর্তাবাবু , ওরা বিপদের আঁচ পেয়ে আগেই সম্পত্তি সব আলাদা আলাদা নামে ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে। এখন ওদের জমিজমা সিলিং আওতার নিচেই পড়বে। আপনাকেওকতদিন বলেছি , আপনি কানেই তোলেন নি ?
----- তাহলে এখন উপায় ?
----- উপায় একটাই , ভালো জমিগুলো রেখে বাকিগুলো সরকারকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
------ কক্ষনো না , জীবন থাকতে এক ছটাক জমিও ছাড়ব না। আমি হাইকোর্টে যাব।
------ কর্তা ছোটমুখে বড় কথা হয়ে যাবে। কিন্তু পুরুষানুক্রমে আপনাদের নুন খেয়েছি তাই সব সময় এই পরিবারের ভালোই চেয়েছি। তাই বলি কি কর্তা , কেস কাছারি ভালো জিনিস নয়। কত পরিবার শেষ হয়ে গিয়েছে , তার উপরে এ তো সরকারের নীতির বিরুদ্ধে কেস , সহজে এঁটে ওঠা যাবে না।
---- তুমি সব জেনে বসে আছো। আর জ্ঞান দিতে হবে না তোমাকে। তুমি জমির দলিলপত্র সব ঠিক করো। আমি কালই কলকাতায় হাইকোর্টে যাব।
যথারীতি পরদিনই মামলা দায়ের হয়। দিনের পর দিন চলে সেই মামলা। শেষপর্যন্ত মদনের আশংকাই সত্যি হয়। মামলা লড়তেলড়তে বাড়ির সোনা দানা, সমস্ত সঞ্চয় নিশেষ হয়ে যায়। বিকিয়ে যায় ভালো ভালো জমি।এমন কি চড়া সুদে বাঁধা পড়ে যায় বাড়িটিও। তাও শেষ রক্ষা হয় না।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment