নয়নিকার প্রতীক্ষা
অর্ঘ্য ঘোষ
( অণুগল্প )
রিঙ্কির যন্ত্রণাকাতর মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারেন না নয়নিকা। দেবী প্রতিমার মতো দেখতে ছিল বড় মেয়ে রিঙ্কি। ওর বাবা চন্দনবাবু ছিলেন সরকারি ঠিকাদার। সেই সূত্রে আলাপ হয় বিডিও অফিসের বড়বাবু ভূবন সেনগুপ্তের সঙ্গে। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। ওই যে কারণে ঠিকাদারদের সঙ্গে সরকারি আধিকারিকদের ঘনিষ্ঠতা হয় আর কি ? তুমি আমাকে দেখো , আমি তোমাকে দেখব। আমি সিমেন্টে পাথরের গুঁড়ো মেশাব তুমি সব জেনেও চোখ কান বুজে আমার বিল পাস করে দেবে। বিনিময়ে আমি তোমাকে টেবিলের তলা দিয়ে কাগজের প্যাকেটে কারেন্সি নোট দেব। আস্তে আস্তে ওই ঘনিষ্ঠতা বাড়ি পর্যন্ত গড়ায়। রিঙ্কিকে দেখে ভুবনবাবুর খুব পচ্ছন্দ হয়ে যায়। একমাত্র ছেলে অরিন্দমের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
রিঙ্কির বাবা আর না করতে পারে না। ছেলে বলার মতো চাকরি বাকরি তেমন কিছু করে না ঠিকই , কিন্তু বাবার দুনম্বরীর অগাধ টাকা পয়সা। শহরে দোতলা পাকাবাড়ি। বাড়িতে নেই এমন কিছু সুখের উপকরণ বাজারেও নেই। বিয়ের পর মেয়ে সুখেই থাকবে। সর্বোপরি ভূবনবাবু বেয়াই হলে আর বিল পেতে তাকে হ্যাপা পোহাতে হবে না। ভুবনবাবুও দেখেন ঠিকাদার বেয়াই হলে বকলমে তারও ঠিকাদারি করা হবে। সেইমতো একদিন মহা ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় রিঙ্কি-অরিন্দমের। ভূবনবাবুর অধীনস্থ ঠিকাদারেরাই সোনাদানায় ভরিয়ে দেন নববধূর শরীর। অমন বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হওয়ায় গর্বে বুক ভরে যায় নয়নিকার।
কিন্তু অচিরেই সেই গর্ব খর্ব হয়ে যায় তার। মেয়ে যখনই বাপের বাড়ি আসে তখনই তাকে কেমন যেন মনমরা দেখায়। জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। ছোটবেলা থেকেই খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে রিঙ্কি। শেষে একদিন চেপে ধরতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। তারপরই মাকে সব খুলে বলে সে। শুনে কপাল চাপড়ানোর দশা হয় নয়নিকার। অরিন্দমকে বাইরে থেকে দেখে ভদ্র ছেলে বলেই মনে হয়। কিন্তু তার যে অন্য মেয়েতে আসক্তি থাকতে পারে তা তাকে দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবে না। সেই সঙ্গে রয়েছে জুয়ার নেশাও। জানতে পারার পরই স্বামীকে শোধরানোর বহু চেষ্টা করেছে রিঙ্কি। কিন্তু কোন লাভ হয় নি। উল্টে জুটেছে শারিরিক আর মানসিক নির্যাতন। এমন কি বিয়ের আগে যে অরিন্দমের বাবা - মা রিঙ্কিকে মামনি - মামনি করতেন তারাও সবার সামনে এখন খানকি মাগী বলেন।তার উপরে রয়েছে টাকার চাপ। যতবারই রিঙ্কি বাপের বাড়ি এসেছে ততবারই ১/২ লক্ষ টাকা অরিন্দমের ব্যবসার জন্য চেয়ে আনতে বলেছেন। লজ্জায় রিঙ্কি সেই কথা বলতে পারে নি। এর ফলে খালি হাতে ফিরে গিয়ে বেধড়ক মারধোর খেতে হয়েছে তাকে। বাবা - মায়ের সামনেই অরিন্দম রিঙ্কির গোপন অঙ্গে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছে।
যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছে রিঙ্কি। আর ওরা তিনজন মেতে উঠেছে পৈশাচিক উল্লাসে। মেয়ের বুকের কাপড় সরাতেই শিউড়ে ওঠেন নয়নিকা।সারা শরীরে থকথক করছে পোড়া ঘা।কথাটা শুনেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন রিঙ্কির বাবা।রেগেমেগে বলেন, আমি আজই ওদের বিরুদ্ধে বধু নির্যাতনের মামলা করে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব।মেয়ের আড়ালে স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন নয়নিকা। গলার স্বর নামিয়ে বলেন , ঘানি ঘুরিয়ে তো লাভ কিছু হবে না। মেয়ে বলে কথা। পেটে সন্তানও এসেছে। আর ভালো ঘরে কোথাও বিয়ে দিতে পারবে ? তার চেয়ে আমি বলি কি ওরা যখন চাইছে তখন না হয় কিছু টাকা ওদের দিয়েই দাও। আমাদের তো দুটোই মেয়ে। যা থাকবে তা তো ওরাই পাবে।মেয়েকেও কাছে টেনে নিয়ে বলেন , কি করবি মা ভুল যখন হয়েই গিয়েছে তখন একটা ছেলেপুলে না হওয়া পর্যন্ত মুখ বুজে থাক। দেখবি ছেলেপুলের মা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রিঙ্কি আর কিছু বলে নি। সেবার দেড় লাখ টাকা সহ মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন চন্দনবাবু। সেই প্রথম নয় , তারপরেও দফায় দফায় আরও কয়েকবার অরিন্দম কিম্বা তার বাবা মায়ের হাতে টাকা তুলে দিয়ে আসেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই তাদের খাঁই মেটে না।
এমন কি ছেলের মা হওয়ার পরও তাদের অত্যাচার কমে না। রিঙ্কি অবশ্য বাবা-মা কষ্ট পাবে বলে সেইসব কথা বলে নি। বললে হয়তো আজকের দিনটা তাদের দেখতে হত না। বীভৎস সে দিনটা যেন ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে নয়নিকার। সেদিন সকালে হঠাৎ অরিন্দমের এক বন্ধু ফোন করে বলে , মাসীমা অরিন্দমরা কি আপনাদের ফোন করে কিছু জানিয়েছে ?
---- না তো বাবা , কেন কি হয়েছে ?
---- আমি বলেছি তা বলবেন না যেন। আজ সকালে আপনাদের মেয়ে অ্যাসিড খেয়েছে। জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
কথাটা শুনেই কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন নয়নিকা। কিছুক্ষণ পর ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তার কান্না শুনে ছুটে আসেন চন্দনবাবু, ছোটমেয়ে মৌলী। সব শুনে তারাও প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তারপর গাড়ি নিয়ে জেলা হাসপাতাল অভিমুখে রওনা দেন তারা। ততক্ষণে জেলা হাসপাতাল থেকে রিঙ্কিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দুর্গাপুরের একটি হাসপাতালে। সেখানে রিঙ্কি যেন তাদেরই প্রতীক্ষায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিল। মেয়ের দিকে তাকাতে পারছিলেন না নয়নিকা। কাছে যেতে তার হাত দুটি ধরে ক্ষীণ স্বরে বলে , মা গো ভিতর জ্বলে যাচ্ছে। আর সইতে পারছি না। আমি অ্যাসিড খাই নি মা। ওরা আমাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। ওর বাবা-মা হাত-পা চেপে ধরেছিল। আর ও আমার মুখে জোর করে অ্যাসিড ঢেলে দেয়। তোমরা ওদের ছেড় না মা। বাবুকে তোমরা দেখ।
বলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে রিঙ্কি। সেই থেকে নাতিটা তাদের কাছেই আছে। খুনীদের এখনও শাস্তি হয় নি। তাই শান্তি নেই নয়নিকার মনে। তার সামনে ভেসে ওঠে মেয়ের সেই যন্ত্রণা কাতর মুখ। কান পাতলেই যেন শুনতে পান মেয়ের ক্ষীণ হয়ে আসা গলার স্বর -- মা ওদের তোমরা ছেড় না।
মেয়ের হত্যাকারীদের শাস্তির প্রতীক্ষায় দিন গোনেন নয়নিকা।
-----০-----
( এই গল্পের স্থান-কাল-পাত্র সবই কাল্পনিক। বাস্তবে কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে সেটা নেহাতই কাকতালীয়। কাউকে আঘাত করার উদ্দ্যেশ্যে এই গল্প নয়। সমাজের একটা খন্ডচিত্র তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র )
No comments:
Post a Comment