Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

ঠাকরুন মা -- ৩৭ /



    ঠাকরুন মা 


          অর্ঘ্য ঘোষ 


 ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



এর আগে দু-চারজন কনেষ্টবল কিম্বা পুলিশ নিয়ে থানার বড়বাবুকে তিনআনিদের বাড়িতে উঠাবসা করতে দেখেছেন বটে , কিন্তু এত পুলিশ নিয়ে বড়ো বড়ো অফিসারদের কেউ কোনদিন দেখেন নি গ্রামের মানুষ। তার উপরে শিখাও আলোচনার খোরাক হয়েছে। সে শুধু সুন্দরীই নয় , এ গ্রামে চাকরী করা বৌ আর কেউ নেই। তাই সবাই সেই আলোচনাতেই বিভোর হয়ে উঠে। যোগনাথ আর শ্রীমতী  আবার সেই আলোচনায় ইন্ধন যুগিয়ে চলে। তারা ধরে ধরে শিখার সুখ্যাতি করে বেড়ায়।সেদিনের পর থেকে অনেকেই অন্নপূর্ণার সঙ্গে গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে। অথচ ওইসব লোকগুলোই একদিন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তার বাড়িতে ওইসব তাবড় তাবড় লোকদের দেখেই তারা বোধহয় তাদেরও কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছে। তার উপরে সেদিন বিচারপতি বলে দেওয়ার পর থেকে থানার ওসি দু'বেলা দু'জন পুলিশ পাঠিয়ে খোঁজখবর নেন।অনেক রাত্রি পর্যন্ত পুলিশ দু'জন তাদের পাহারা দেয়। অন্নপূর্ণার খুব অস্বস্তি হয়। আবার গ্রামের মানুষের আচরণে মনে মনে খুব হাসিও পায়। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। স্বাভাবিক ভাবেই মেশে সবার সঙ্গে। ওইভাবেই দিন কেটে যায় অন্নপূর্ণার। কিন্তু বিয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই হৈ-চৈ পড়ে যায় গ্রামে। তিনআনিদের কাছে এসে পৌঁছোয় উচ্চ আদালতের পুনঃবিচারের চিঠি। উড়ো আগুনে ঘর পোড়ার মতো অবস্থা হয় তাদের। দিব্যি সব চুকেবুকে গিয়েছিল। আবার যে টিকি ধরে টানাটানি শুরু হবে তা বোধহয় ওরা ভাবতেও পারে নি। তাই অন্নপূর্ণার উপরে প্রচন্ড আক্রোশ হয় তাদের। কিন্তু করারও কিছু নেই। অন্নপূর্ণার পরিবারের উপরে পুলিশ প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে। কিছু করতে গেলে যে উল্টো বিপত্তিতে পড়তে হবে তা তারা ভালোই জানে। তাই ভিতরে ভিতরে অক্ষম আক্রোশে ফুঁসতে থাকে তারা। গায়ের আগুন ঝেড়ে ফেলতে ছোটাছুটি পড়ে যায় তাদের। ছোটাছুটি পড়ে যায় সন্দীপনেরও। তারও তলব পড়ে কলকাতায়। পরদিনই রওনা দিতে হয় তাকে। রঞ্জুও ফিরে যায় তার সঙ্গে। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় চোখের জল ধরে রাখতে পারে না অন্নপূর্ণা। রঞ্জুও কেঁদে ফেলে। মা আর শিখাকে নিয়ে সে গৌরবকে কলকাতায় আসতে বলে।তারপর সন্দীপনের সঙ্গে রওনা দেয়। ট্রেনে আসতে আসতেও  কেবলই বাড়ির কথা, মায়ের কথা, দিদির কথা, গৌরব - শিখার কথা মনে পড়ে রঞ্জুর। গৌরবটারও বিয়ে হয়ে গেল।সে'ই কেবল দলছুট পাখির মতো পড়ে রইল। কথাটা ভাবতে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে রঞ্জুর। সামনে বসে সেটা কান এড়ায় না সন্দীপনের। সে রঞ্জুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। খুব মায়া হয় তার।  ডুবে যেতে যেতে খুড়কুটোর মতো কাউকে ধরে হয়তো ভালোবেসে ছিল মেয়েটা। কিন্তু তার মাসুল যে ওভাবে চোকাতে হবে তা সে ভাবতেও পারে নি। একসময় রঞ্জুর চোখের কোন দুটো চিকচিক করে উঠতে দেখে সন্দীপন। খুব ইচ্ছা করে সযত্নে সেই জল মুছিয়ে দেয়। কিন্তু পরিবেশ - পরিবেশ পরিস্থিতির কথা ভেবে নিজেকে সংবরণ করে।


                জল ভরা চোখে রঞ্জুকে দেখে অন্যরকম লাগে তার। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে । সেই সসময় আচমকা তার দিকে মুখ তুলে তাকায় রঞ্জু। তখন লজ্জায় সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সন্দীপন। মুখ নামিয়ে নেয় রঞ্জুও। সন্দীপনের চাউনি তার মনে দোলা দিয়ে যায়। আচ্ছা সন্দীপনদাও তো তার মনের মানুষ হতে পারে। সেও তো সন্দীপনদাকে নিয়ে সুখের সংসার গড়ে তুলতে পারে। মায়ের বন্ধুরা তো তাদের রূপের কত সুখ্যাতি করত।  সন্দীপনদার পাশে তাকে কি খুব বেমানান দেখাবে ?  পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় তার মুখে করুণ হাসি ফুটে ওঠে। কোথায় সন্দীপনদা আর কোথায় সে? তার একটু রূপ ছাড়া আর কি আছে ? আগে হলে তবু কথা ছিল , কিন্তু কুলে কালি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর কে তাকে গ্রহণ করবে ? কে বিশ্বাস করবে সে আগের মতোই আছে ?ট্রেনের দৃষ্টি বিনিময়ের লজ্জা এড়াতে রিক্সায় নানা  অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে বলতে বাড়ি ফেরে তারা।বিচারপতির সঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করে আদালতে চলে যায় সন্দীপন। ফেরেও একই সঙ্গে। সেদিন আর বাড়ি ফেরা হয় না তার। নিরুপমাদেবী কিছুতেই ফিরে যেতে দেন না তাকে।সন্দীপনও তার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না। সেদিনই প্রথম নয় , তারপর থেকে আদালতের কাজে এসে মাঝে মধ্যেই বিচারপতির বাড়িতেই রাত্রিবাস করতে হয় তাকে।রঞ্জুর খুব ভালো লাগে। সন্দীপনদার সঙ্গে গল্প করে সময়টা যে কিভাবেই কেটে যায় বুঝতে পারে না। মনের একাকীত্বটা ভুলে যায় সে। সন্দীপনদার কাছে মা'দের খবরও পায়। জ্যেঠু জ্যেঠিমারও খুব পচ্ছন্দ সন্দীপনদাকে। ততদিনে সন্দীপনের অনুরোধে তাকে তুমি বলা শুরু করেছেন তারা। আদালত থেকে ফিরে জ্যেঠু সন্ধ্যেবেলা সন্দীপনদার সঙ্গে আইনী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সন্দীপনদা আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় বই বের করে দেয়। জ্যেঠু তো তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একদিন কথা প্রসঙ্গে  জ্যেঠিমাকে বলেন , সন্দীপন খুব বুদ্ধিমান ছেলে। ও হাইকোর্টে প্র‍্যাকটিস করলে অল্পদিনেই সুনাম করবে।
--- তা সেটাই বলো না ওকে।
--- কিন্তু গ্রাম ছেড়ে এসে কি করতে পারবে ? থাকবেই বা কোথাই ? 
---- কেন না পারার কি আছে ? আমাদের এতবড়ো বাড়ি থাকতে আর অন্য কোথায় থাকতে যাবে ?
---- কিন্তু ওর আত্মসম্মান জ্ঞান খুব প্রখর। বললেই কি আর ও আমাদের বাড়িতে থাকতে চাইবে ? 
---- না চাওয়ার কি আছে ? আমরা তো ওর বাবা মায়ের মতো। বাবা মায়ের কাছে আবার আত্মসম্মান কি গো ? তোমাকে বলতে হবে না। আমিই বলব। কই দেখি না করুক তো কেমন করতে পারে ?


              জেঠ্যু-জ্যেঠিমার কথা শুনে রঞ্জুও খুব খুশী হয়। সন্দীপনদাকে ঘিরে ততদিনে তার মনে কেমন যেন একটা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোন কারণ নেই , তবু তার আসার দিন প্রতীক্ষায় অধীর হয়ে থাকে। সন্দীপনদা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সে তার পুরনো ক্ষতটা ভুলে থাকে। কতদিন ভেবেছে একান্তে মনের কথাটা বলবে সন্দীপনদাকে। কিন্তু বলি বলি করেও কিছু বলা হয় না তার। কাজ শেষ করে সন্দীপন যখন পরদিন ফিরে যায় তখন তার মনটা বিষন্ন হয়ে পড়ে। সেই সময় তাকেই জ্যেঠিমা উদ্দ্যেশ্য করে বলে, কি রে তোর কি মনে হয় , সন্দীপন আমার কথা ঠেলতে পারবে ? 
---- তোমাদের যে রকম শ্রদ্ধা করে , মনে তো হয় না তোমাদের কথা ফেলতে পারবে। তাছাড়া ওর নিজের তো উপকার হবে।
---- আরে আমাদেরও কি কম উপকার হবে ভাবছিস ? বিয়ে হয়ে এসে থেকেই তো দেখছি তোর জ্যেঠু আইনের বই মুখে বসে আছেন। 
--- এই দেখ , আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে কেন বল দেখি ? 
---- না করবে না ? বাড়ির কাছেই বেলুর মঠ, দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট। কত দুর দুরান্ত থেকে লোকেরা দর্শণ করে চলে যাচ্ছে। তুমি কোনদিন আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার সময় পাও ?  বললেই তো বল , গাড়ি আছে - নিরাপত্তা রক্ষী আছে , যাও না যেখানে যেতে চাও। একা - একা আর কার যেতে ভালো লাগে ? রঞ্জু আসার পর তবু যা হয় একটু বেরনো হয়।
স্ত্রীর অনুযোগটা উড়িয়ে দিতে পারেন না অসীমবাবু। তাই আত্মরক্ষার্থে তিনি বলেন , দেখো আজ আমাকে দোষ দিচ্ছ দাও , কিন্তু বিয়ের আগেই কিন্তু আমি তোমাকে গঙ্গার ধারে বসে বলেছিলাম বিচারপতিকে বিয়ে করে পরে পস্তাবে না তো ? জবাবে তুমি কি বলেছিলে মনে আছে ?


                                   স্বামীর কথা শুনে লজ্জায় নিরুপমাদেবীর মুখ লাল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় বহু বছর আগের গঙ্গাপাড়ের সেই বিকালবেলাটার কথা। কলেজের পাঠ শেষ করেই সমন্ধ করে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তাদের। সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর  অসীম একান্তে কথা বলার জন্য তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছিলেন। দুরু দুরু বুকে সে একাই গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বলেই তার সব ভয় দূর হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ কথা বলেই অসীমকে ভালো লেগে গিয়েছিল তার। সেদিন নিজেকে তার সামনে মেলে ধরেছিল অসীম। তার সময়াভাবের কথাও বলেছিল। জবাবে সে হবু বরের হাত দুটো ধরে বলেছিল ,  দিনের শেষে এই ভালো মনের মানুষটার মুখটা একবার দেখতে পেলেই আমি আর কিছু চায় না।তখন সন্ধ্যা নেমেছে। টিমটিমে লন্ঠনের আলোয় নদী পারাপার করছে নৌকা। মাঝিদের গান 
ভেসে আসছে। সেই গান ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে দুরের কোন মন্দিরের সন্ধ্যা আরতির ঘণ্টাধ্বনি।সেই মায়াময় পরিবেশে নির্জন নদীতটে অসীমের ঠোঁট তার চোখের পাতা স্পর্শ করে নেমে আসে ঠোঁটে। সে'ও অসীমের গলা জড়িয়ে ধরে তীব্র আশ্লেষে চুম্বন করে।কবেকার কথা , কিন্তু কথাটা পড়তেই আজও তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।লজ্জায় গালে রক্তিম আভা ফুটে ওঠে। জ্যেঠু-জ্যেঠিমার স্মৃতিচারণ বেশ উপভোগ করে রঞ্জু। স্ত্রীকে চুপ করে থাকতে দেখে অসীমকুমার বোধহয় স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রঞ্জুর সামনে অস্বস্তিতে পড়ার আশঙ্কায় নিরুপমাদেবী বলেন , ঠিক আছে মশাই , 'জেনেশুনেই যখন বিষ করেছি পান ' তখন আর কি'ই বা করা যাবে ? সন্দীপনকেই বলব , তুমি বেলুড়মঠ, দক্ষিনেশ্বর , কালীঘাট ঘুরিয়ে দেখিয়ে দাও তো বাবা। 
জ্যেঠিমাকে বলতে হয় না। পরের সপ্তাহে সন্দীপনদা এলে  জ্যেঠুই কথাটা পাড়েন।কোর্ট থেকে ফিরে চা খেতে খেতে সেদিনের মামলার গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন দু'জনে। তখনই কথা প্রসঙ্গে জ্যেঠু বলেন , এই কয়েকদিনেই তো দেখছি তুমি হাইকোর্টের মামলা নিয়ে বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছ। তুমি হাইকোর্টেই প্র‍্যাকটিস শুরু করলেই তো পার।
--- স্যার আমারও খুব ইচ্ছা হাইকোর্টে প্রাকটিস করার। কিন্তু সেই সুযোগ কোথাই আমার ? 
--- সে সুযোগের ব্যবস্থা আমি তোমাকে করে দেব। কিন্তু তার আগে বাপু তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
--- কি কাজ ? 
--- স্যার বলাটা ছাড়তে হবে। আমার স্ত্রীকে তুমি জ্যেঠিমা বলবে আর আমাকে স্যার-স্যার করবে তা হবে না।
---- কিন্তু এখানে যদি প্রাকটিস করি তাহলে কোর্টে তো আপনাকে স্যারই বলতে হবে।
--- এই জন্যই তো তোমার বুদ্ধিমত্তার এত প্রশংসা করি আমি। খুঁত তুমি ঠিক খুঁজে বের করবেই। বেশ তোমার কথাই মানলাম। কোর্টে তুমি আমাকে স্যারই বলবে। কিন্তু বাড়িতে 'নো - স্যর ', অনলি জ্যেঠু। তাহলে ওই কথাই রইল। আমি প্যারীমোহনকে বলে দেব। তুমি এই বাড়িতে থেকে আপাতত ওর অধীনেই প্রাকটিস শুরু করে দাও।
---- এই বাড়িতে থেকে ? 
---- কেন পচ্ছন্দ নই ? 
---- পচ্ছন্দ নই কি বলছেন ? এতো আমার পরম সৌভাগ্য।
---- আমাদের সৌভাগ্য খুব কম কিছু নাকি ? ছেলেমেয়ে সব বিদেশে। এদেশে আর কোনদিন আসবে বলে মনে হয় না। ওইটুকু একটা মেয়ের উপরে ভরসা করে থাকতে হয় দুই বুড়োবুড়িকে। বিপদ আপদ কিছু একটা হয়ে গেলে কি হবে সেই ভেবে মরি।
জ্যেঠুর কথা শেষে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে রঞ্জু বলে , কাউকে তোল্লাই দিতে চাও দাও। কিন্তু নিজেদের বিপদ আপদের কথা বললে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। 
রঞ্জুর কথা শুনে নিরাপমা তাকে বুকে টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে , অমনি মেয়ের অভিমান হয়ে গেল। বুঝিস না কেন , আমাদের বয়স তো হচ্ছে নাকি ? অসুখ বিসুখের উপরে তো কারও হাত নেই। তোরা দু'জনে থাকলে সহজেই সামাল দিতে পারবি। 
রঞ্জু আর কিছু বলতে পারে না। সেই থেকে রঞ্জুর মতোই বিচারপতির বাড়িই সন্দীপনের ঠিকানা হয়ে ওঠে।


                    ( ক্রমশ ) 

No comments:

Post a Comment