Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

ঠাকরুন মা -- ৩৮ /




     ঠাকরুন মা 



        অর্ঘ্য ঘোষ 


( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



জ্যেঠু-জ্যেঠিমাদের সঙ্গে একতলায় পাশাপাশি ঘরে থাকে রঞ্জু। সন্দীপনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে দোতলার একটি ঘরে। সন্দীপনদা থাকাতে রঞ্জুর খুব সুবিধা হয়েছে। সে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। পড়াশোনায় কোথাও আটকে গেলে সে তার কাছে দেখিয়ে নিতে পারে। রঞ্জুও সন্দীপনকে কোন কাজ করতে দেয় না। বিছানা ঝাড়া , ঘর গোছানো তো আছেই , ছাড়া জামাপ্যান্টটা পর্যন্ত কেচে ইস্ত্রি করে দেয়।আর সেসব করতে গিয়েই দুজনের মধ্যে নৈকট্য গড়ে ওঠে। তার প্রতি রঞ্জুর এহেন  মনোযোগ নিয়ে ধন্দ সৃষ্টি হয় সন্দীপনের মনে। তার কাছে কি চায় মেয়েটা ? পড়া-টড়া দেখিয়ে দেয় বলেই কি ? একদিন একা পেয়ে রঞ্জুকে প্রশ্নটা করেই ফেলে সে। গলার স্বর কিছুটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে , তুমি কেন আমার এত খেয়াল রাখ বলো তো ? 
কথাটা শুনেই বুকের মধ্যে যেন বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা বিপুল জলরাশি ছাড়া পাওয়ার জন্য উথাল-পাথাল করে ওঠে। কিন্তু মুখ ফুটে সহসা কিছু বলতে পারে না। মনে মনে বলে , কেন বোঝ না তুমি ? মুখে বলে , কেন আবার ? জ্যেঠু-জ্যাঠাইমারও তো করি।
---- ওনাদের জন্য করা আর আমার জন্য করা কি এক হলো ?
--- কেন নয় ?
--- ওনারা হলেন তোমার আশ্রয়দাতা। তোমাকে কত ভালোবাসেন। আর হলাম গিয়ে তাদেরই আশ্রিত।
---- ওঃ আপনি বুঝি আমাকে ভালোবাসেন না ?
ওই প্রশ্নের মুখে চরম অস্বস্তিতে পড়ে যায় সন্দীপন। কি নিলিপ্ত জিজ্ঞাসা , অথচ তার উত্তর কত তাৎপর্যবাহী।  কোন উত্তর দিতে পারে না সন্দীপন। আমতা আমতা করতে থাকে। রঞ্জু মুখ টিপে হেসে বলে , থাক আর কষ্ট করে বলতে হবে না। আপনি যে আমাকে একটুও ভালোবাসেন না তা বুঝে গিয়েছি।
কি যেন বলতে গিয়েও বলা হয়না সন্দীপনের।সেদিন আর কথাও এগোয় না। কিন্তু নৈকট্য বাড়তে থাকে। যেদিন কোর্টের কাজ থাকে না সেদিন জ্যেঠুমার সঙ্গে তো বটেই , রঞ্জুকে একাও বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান সন্দীপন। জ্যেঠিমাই তাদের ঠেলে ঠেলে পাঠান। কোনদিন চিড়িয়াখানা , কোনদিন যাদুঘর আবার কোনদিন বা শুধুই গঙ্গার ধারে কাটিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাড়ি ফেরে তারা। তাদের দেখে যেন চোখটা জুড়িয়ে যায় অসীমবাবু আর তার স্ত্রীর।দুজনেই ওদের ঘিরে মনে মনে একটা আশা পোষণ করেন।একদিন ওরা বেরিয়ে যেতেইস্বামীর কাছে আশাটা ব্যক্ত করেন নিরুপমাদেবী -- হ্যা গো দুটিতে ওইভাবে আমাদের চোখের সামনে হেসে খেলে নিজের ছেলেমেয়ের মতো থাকতে পারে তেমন কিছু হয় না ?
---- নিরু কথাটা যে আমার মনে আসে নি তা নয়। কিন্তু রঞ্জুর অতীত তো জানো। সন্দীপনের মতো একটি ব্রাইট ছেলে ওই প্রস্তাবে রাজী হবে কিনা কে জানে ? 
---- ওদের দুজনকে দেখে রাজী হবে বলেই মনে হয়। নাই যদি হয় , তাহলেও একবার প্রস্তাব দিতে দোষ কোথায় ?
--- বেশ সে সময় সুযোগ মতো দেওয়া যাবে।


                   সন্দীপন কিছু টের না পেলেও জ্যেঠু-জ্যেঠিমায়ের মনোভাবটা রঞ্জুর অবশ্য আঁচ করতে অসুবিধা হয় না। জ্যেঠিমায়ের কথাতেই তার আভাস পায় সে।  কাজের ফাঁকে ফাঁকে জ্যেঠিমা প্রায়ই বলেন, সন্দীপন ছেলেটা খুব ভালো না বল ? 
বিষয়টি উপলব্ধি করেউদাসীনতার ভান করে রঞ্জু বলে , সে তুমিই জানো বাপু। আমার তো কই অন্যরকম লাগে  না ? 
--- তাই বললে কি হয় রে ? কত নম্র - ভদ্র বল দেখি ?  তোর জ্যেঠু আর আমার প্রতি কত দায়িত্ব সচেতন , তোর প্রতিও কি কম ? তোর জ্যেঠুর খুব ইচ্ছা তোকে ওই  রকম একটি ছেলের হাতে তুলে দেওয়ার। 
---- আমি কি ছেলের হাতের মোওয়া যে তুলে দেবে ?
--- কেন ওই রকম ছেলে তোর পচ্ছন্দ নয় ? 
---- জানি না যাও। 
এর বেশি আর কোন কথা বলতে পারে না রঞ্জু। একটা সংশয় গ্রাস করে নেয় তাকে। কি বলবে সে ? সন্দীপনদার প্রতি সে তো কবেই অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু সন্দীপনদার মনের তল সে এখনও পায় নি। তার মনের দরজাটা এখনও খোলে নি।তবে একদিন রাতে দু'হাট করে খুলে যায় সন্দীপনদার মনের দরজা। হঠাৎ করে সেদিন সন্ধ্যা বেলায় ধুম জ্বরে পড়ে  যায় রঞ্জু। জ্যেঠু- জ্যেঠিমারা তো শশব্যস্ত হয়ে পড়েন। কপালে জলপট্টি দিয়েও জ্বর নামে না। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হতেই বেঁকে বসে রঞ্জু। কিছুতেই হাসপাতালে যাবে না সে। ওষুধ খেলে বাড়িতেই সেরে যাবে বলে সে গোঁ ধরে বসে। অগত্যা সন্দীপন ছুটে গিয়ে রোগের উপস্বর্গ বলে ডাক্তারের কাছে ওষুধ নিয়ে আসে।তাতেও কোন কাজ হয় না। উল্টে মাথায় অসহ্য মাথা  যন্ত্রণা শুরু হয়। অস্থির হয়ে পড়েন জ্যেঠু - জ্যেঠিমা। রাত বেড়েই চলে। তবু তারা রঞ্জুর মাথার কাছটি থেকে নড়েন না। তাদেরও খুব ক্লান্ত দেখায়। সন্দীপনই শেষরাতের দিকে জোর করে তাদের শোওয়ার ঘরে পাঠায়। কিন্তু যেতে কি আর তাদের মন চায় ? যেতে গিয়েও ফিরে ফিরে চান। সন্দীপন তাদের আশ্বস্ত করতে বলে , কোনরকম দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না আপনাদের। আমি তো থাকছি। আপনারা বরং একটু রেষ্ট নিন। নাহলে সকলে একসঙ্গে অসুখে পড়লে কে কাকে দেখবে ? আপনারা আবার সকাল থেকে থাকবেন।
সেই কথা শুনে পাশের ঘরে যেতে যেতেও জ্যেঠিমা বলেন , ঠিক আছে কিছু সমস্যা হলেই যেন আমাদের ডাকতে ভুলো না।সন্দীপন সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে। তারপর তারা পাশের ঘরে যান। সন্দীপন একটি টুল টেনে নিয়ে বিছানার পাশে বসে রঞ্জুর মাথায় হাত বোলাতে শুরু করে। রঞ্জু তখন জ্বরের ঘোরে বিড় - বিড় করছে। সন্দীপন সমানে কখনও মাথায় জলপট্টি দেয় ,  কখনও বা কপালে - মাথায় হাত বোলাতে থাকে। আস্তে আস্তে জ্বরটা নামতে শুরু করে।আর চোখ বুজতে বুজতে সন্দীপনকে তার কপালে হাত বোলাতে দেখে অবাক চোখে চেয়ে থাকে রঞ্জু। খুব ভালো লাগে তার। এর আগে কেউ তো এত যত্ন করে তার কপালে হাত বুলিয়ে দেয় নি। সন্দীপনদার স্পর্শে তার উত্তপ্ত শরীরটাও যেন শীতল হয়ে যায়। সে নিজের হাত দুটো দিয়ে কপালের উপর সন্দীপনদার হাত দুটো চেপে ধরে। সন্দীপন তার দিকে 
উদ্বেগভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। তা দেখে মৃদু হেসে রঞ্জু জিজ্ঞেস করে , এত যে সেবা করছ , আমি তোমার কে ? 
---  তুমিও তো আমার অনেক খেয়াল রাখ। তুমিই বা আমার কে ? 
---- অঃ তাই বুঝি শোধ দিচ্ছ ? ভাগ্যিস অসুখটা হয়েছিল!
---- মানে ? 
---- তেমন অসুখ না হলে কেই বা আমার খোঁজ রাখে বলো ? রঞ্জুর কথায় অভিমানের আঁচ পায় সন্দীপন। সে বুঝতে পারে কথাটাতার ওইভাবে বলা উচিত হয় নি। তাই সংশোধনের সুরে বলে , ঠিক তা নয়। তুমি এখানে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলে দেখে তোমাকে ফেলে চলে যেতে পারি নি।


                সেই কথা শুনে পরিপূর্ণ চোখে সন্দীপনের দিকে তাকায় রঞ্জু। কথাটা শুনে তার শুন্য হৃদয়টা যেন কানায় কানায় ভরে যায়।সে সন্দীপনের হাত ধরে বলে , কি বললে ? আর একবার বলো কথাটা।
---- কোন কথাটা ? 
---- ওই যে বললে না , আমায় কষ্ট পেতে দেখে তুমি চলে যেতে পার নি।
রঞ্জুর কথা শুনে সন্দীপনেরও কেমন যেন হয়ে যায়। সে চেয়ে দেখে রঞ্জু তার দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে বলে , কথাটা শুনে তোমার ভালো লেগেছে ? 
---- হ্যা , খুব ভালো লেগেছে। কেউ তো আমাকে কোনদিন ভালোবেসে এই রকম কথা বলে নি। তুমি এমনি করে আমার সব অসুখ সারিয়ে দিতে পারো না ? 
--- তোমার আবার কিসের অসুখ ? 
--- বোঝ না কেন সন্দীপনদা এই বয়সের মেয়ের কিসের অসুখ হতে পারে ?
রঞ্জুর কথার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না সন্দীপনের। তবুও না বোঝার ভান করে তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে -- তোমার অসুখ এখনও সারে নি ? 
রঞ্জুর গায়ে তখন পড়ছে সন্দীপনদার গরম নিশ্বাস। রঞ্জু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আচমকা সন্দীপনের গলা জ্বড়িয়ে ধরে তার মুখটা  নামিয়ে আনে। তারপর জ্বরতপ্ত ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে সন্দীপনের ঠোঁট।সন্দীপনও নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে না। সেও রঞ্জুর কপালে চুম্বন এঁকে চলে। আর তারপরই শান্ত হয়ে যায় রঞ্জু। সে সন্দীপনের হাত দুটি ধরে বলে , আমাকে নাও না সন্দীপনদা। বিশ্বাস কর তুমি ঠকবে না। 
--- এখানে ঠকাঠকির কথা আসছে কি করে ? 
---- আসলে আমি ভুল পথে পা বাড়ালেও কেউ আমার কোন ক্ষতি করতে পারে নি। আমি আজও কুমারীই আছি।
--- দেখ দেহের শুচিতা নিয়ে আমার কোন বাতিক নেই। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। ভালোবাসাটাই হল আসল। কোন কিছুই ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। 
--- তাহলে বলো এমনি ভাবেই সারাজীবন আমার পাশে থাকবে।
সন্দীপন কোন কথা বলে না। রঞ্জুর চোখের পাতায় এঁকে দেয় অনুচ্চারিত অঙ্গীকার। রঞ্জু পরম আবেশ জড়িয়ে ধরে তার গলা।


                     সকালের দিকেই জ্বর পুরোপুরি নেমে যায়। রঞ্জুর জ্যেঠু-জ্যেঠিমারও যেন ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে। রঞ্জু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার পর একদিন সন্দীপনকে একা পেয়ে কথাটা তোলেন অসীমবাবু। স্ত্রীর দোহাই পেড়ে বলেন, বুঝলে সন্দীপন , তোমার জ্যেঠিমায়ের খুব ইচ্ছা তুমি আর রঞ্জু আমাদের বাড়িতেই  ছেলেমেয়ের মতোই থেকে যাও।
---- আছি তো জ্যেঠু , আমরা আপনাদের কাছে সন্তান স্নেহেই লালিত পালিত হচ্ছি।
--- আরে বোকা এ থাকা সে থাকা নয়।
---- তবে ? 
---- দেখ আমাদের ছেলেমেয়েরা আর দেশে ফিরবে বলে মনে হয় না। শেষ বয়েসটা কি করে কাটবে কে জানে! আমাদের খুব ইচ্ছা তোমরা বিয়ে করে আমাদের সন্তানের মতোই এখানেই থেকে যাও।
সরাসরি বিয়ের কথায় অস্বস্তিতে পড়ে যায় সন্দীপন।  সহসা সে কোন কথা বলতে পারে না। সেটা লক্ষ্য করে অসীমবাবু জিজ্ঞেস করেন - রঞ্জুকে কি তোমার পচ্ছন্দ নয় ? 
--- না,  না তা নয়।
--- তবে ?  
--- রঞ্জুর মতটাও তো জানা দরকার।
রঞ্জুর যে অমত হবে না তা তার আচার-আচরণে অনেক আগেই বুঝেছিল সন্দীপন। তারপর তো সেদিন জ্বরের রাতে স্পষ্টই হয়ে গিয়েছে সব কিছু। তবু অস্বস্তি এড়াতেই রঞ্জুর প্রসঙ্গ টেনে আনতে হয় তাকে। তার কথা শুনে অসীমবাবু বলেন , রঞ্জুমায়ের মত তোমার জ্যেঠিমা একরকম নিয়েই রেখেছে ধরতে পারো। তবু তুমি যে মেয়েদের মতামতকে এতখানি গুরুত্ব দাও দেখে ভালো লাগল। তোমার আর কিছু বলার আছে ? 
--- না , আপনারা আমার বাবা-মায়ের মতো। আপনারা যা বলবেন তাই হবে।
--- তাই বললে কি আর হয় ? তোমার বাড়ির লোকেদেরও মতামত নেওয়াটা তো দরকার। 
---- আপনি তো জানেন বাবা-মা গত হয়েছেন। অভিভাবক বলতে রয়েছেন আমার বৌদি। তিনি রঞ্জুরই বড়দি। এ বিয়েতে তার আপত্তি হবে বলে মনে হয় না।
--- তাহলে তো ভালোই হল। রঞ্জুর মা'ও তার সমস্ত দায়িত্ব আমাদের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। তাহলে একেবারে দিনক্ষণ ঠিক করে ওদের খবর দিয়ে চমকে দেব। কথায় আছে ' শুভশ্য শীঘ্রম '। 
সেই মতো দিন তিনেকের মাথায় বিয়ে চূড়ান্ত হয়ে যায়। সেই খবরটা দেওয়ার জন্য শিখার ফোনে  অন্নপূর্ণাকে ধরেন অসীমবাবু। প্রথমে রহস্য করে বলেন , তিনদিনের মাথায় আমার ছোটমেয়ের বিয়ে। আপনার ছেলের বিয়েতে আমি স্বপরিবারে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ছুটে গিয়েছিলাম। আপনাকেও স্বপরিবারে আসতে হবে কিন্তু। আপনার বড় মেয়ে বাসন্তী আর সস্ত্রীক গোমস্তামশাইকেও আনতে হবে।
--- কিন্তু আমরা যে শুনেছিলাম আপনার দুটি মাত্র ছেলেমেয়ে। তারা তো বিয়ে-থা করে বিদেশে আছে। তাহলে -----।
---- ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু জন্ম না দিলেও রঞ্জু কি আমাদের মেয়ে নয় ?
--- মানে ? 
--- আমাদের রঞ্জুমায়েরই বিয়ে। আপনাকে জিজ্ঞেস না করে বিয়েটা চূড়ান্ত করে ফেলেছি। তাই একটা অন্যায় হয়তো হয়েছে। তবে আপনি তো ওর দায়দায়িত্ব সব আমাদেরই 
দিয়েছিলেন , সেই ভরসাতেই বিয়েটা চূড়ান্ত করার সাহস পেয়েছি। আসলে হাতের কাছে ভালো ছেলেটাকে পেয়ে আর হাতছাড়া করতে পারলাম না। ছেলেটাকে আপনারাও চেনেন। হয়তো আপনারাও হাতছাড়া করতে চাইতেন না।
---- আমরা চিনি ? 
---- হ্যা , ভালো করেই চেনেন। ছেলেটা যে আপনাদেরই সন্দীপন।
কথাটা শুনে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারে না অন্নপূর্ণা। রঞ্জুর এমন সৌভাগ্যের কথা সে যে স্বপ্নেও কোনদিন ভাবতে পারে নি। তাই আবেগ তাড়িত গলায় বলে , আমরা শুধুমাত্র ওকে জন্মই দিয়েছি। আপনারাই যথার্থ বাবা-মায়ের কাজ করেছেন। আপনারা না থাকলে ও কোথাই ভেসে যেত তার ঠিক নেই। মেয়েটাকে  নিয়ে খুব 
দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। আজ বড়ো স্বস্তি পেলাম। যাব বইকি নিশ্চয় যাব , সদলবলেই বিয়ের দিন পৌঁচ্ছে যাব আমরা।
ঠাকুর তার কথা শোনে না, তবু কথা শেষ করে অভ্যাস বশেই অন্নপূর্ণা ঠাকুরের উদ্দেশ্যেই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে , ঠাকুর আমার সঙ্গে যা করেছ করেছ , ছেলেমেয়েগুলোকে যেন তুমি সুখী কোর ঠাকুর।
হোমের সুপার মানবেন্দ্রবাবুকেও নিমন্ত্রণ জানাতে ভোলেন না অসীমবাবু। বিয়ের দিন সবাই পৌঁছে যায় বিচারপতির বাড়ি। সেখানে গিয়ে রঞ্জুকে নিয়ে পড়ে শিখা। একাকী পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে , তখন তো আমাদের সিনেমা,  নায়ক নায়িকা খুব বলা হচ্ছিল। এখন তো দেখছি তোমরাও কম যাও না।
লজ্জা ঢাকতে রঞ্জু বলে , যা তোমরা যা ভাবছ তা নয়।
শিখা রঞ্জুর চিবুকটা নাড়া দিতে দিতে বলে , আহা রে আমরা কি ভাবছি তা উনি জেনে বসে আছেন। সেই যে বলে না ঠাকুর ঘরে কে ?  না, আমি কলা খায় নি।
হাসি, ঠাট্টা আর খুনসুটিতেই কেটে যায় সময়। শিখাই রঞ্জুকে কনের সাজে সাজিয়ে দেয়। অসীমবাবু খুব একটা আড়ম্বর পচ্ছন্দ করেন না। তাই কোন আড়ম্বরের ব্যবস্থা করা হয় নি। অসীমবাবুর কিছু বন্ধুবান্ধব , প্যারীমোহনদের নিয়ে ম্যারেজ রেজিস্টার ডেকে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। সেই মতোই বিয়ে হয়ে যায় রঞ্জু - সন্দীপনের। ঠিক হয়েছে আড়ম্বরে যে টাকা খরচ করা হত সেই টাকাই বিয়ের পর নবদম্পতির নামে রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে আসা হবে। কত অনাথ-আতুর মানুষ সেই টাকায় সেবা পাবে। সেটাই হবে সব থেকে বড়ো আড়ম্বর। বিয়ের পরদিনই সবাই মিলে যান রামকৃষ্ণ মিশনে। প্রণাম করার পর স্বামীজীর হাতে আড়ম্বর ছেঁটে রাখা টাকাটা তুলে দিতেই তিনি সবার মাথায় হাত রেখে আর্শিবাদ করতে করতে বলেন , আপনাদের মতো করে সবাই যদি ভাবতে পারত তাহলে পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে উঠত।
কথাটা শুনেই সবার বুক ভরে যায়। গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে। সবাই উপলব্ধি করে সত্যিই টাকাটা দিয়ে যথার্থ আড়ম্বরের কাজ হল।আনন্দের আতিশয্যে টানা তিনদিন যে কি করে কেটে যায় টের পায় না কেউ। সবাইকে 
কলকাতার বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে বেড়ায় সন্দীপন আর রঞ্জু। অন্নপূর্ণা কালীঘাট আর দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানায় , মা মুখ তুলেই যখন চেয়েছো তখন খুনিরা যেন সাজা পায় তা তুমি দেখ মা। আর তোমার কাছে কিছু চাই না।


        ( ক্রমশ ) 

No comments:

Post a Comment