অন্তরালে
অর্ঘ্য ঘোষ
( ধারাবাহিক উপন্যাস )
সেই দুর্যোগের ঘনঘটা তারা টের পায় নবান্নের দুদিন আগে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে প্রসাদ মোড়লরা তাদের নবান্নের আগের দিন নবান্নের দিন ঠিক করেছে। এই ঘটনা গ্রামের ইতিহাসে বিরল। যতই শত্রুতা বা মন কষাকষি থাক না কেন , নবান্নটা সবাই এক দিনেই করে। আসলে নবান্নে পারস্পরিক নিমন্ত্রণের চল রয়েছে। নবান্নেই সবাই প্রথমে নিজের বাড়িতে নতুন ধানের চালগুঁড়ো গোলা মুখে দিয়ে তবে অন্যের বাড়িতে খায়।হঠাৎ করে জন্ম কিম্বা মৃত্যু জনিত কারণে কোন একটি পরিবারে অশৌচ হলে গোটা গ্রাম পূর্ব নির্ধারিত নবান্নের দিন পিছিয়ে দেয়। ওই পরিবারের অশৌচ দশা অতিক্রান্ত হওয়ার পর নবান্নের দিন নির্ধারণ করা হয়। একমাত্র যদি অশৌচ দশা ঘুচতে অগ্রহায়ণ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে তবেই পরিবারটিকে বাদ রেখে দিন করা হয়।
সেক্ষেত্রে পরিবারটির জন্য মন খারাপের অন্ত থাকে না গ্রামবাসীদের। আবার গ্রামে বিয়ে --অন্নপ্রাশনের মতো ভোজকাজ থাকলেও সেইসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংগতি রেখেই নবান্নের দিন স্থির হয়। নবান্নের দিন ঘিরে এই একাত্মতা খুব ভালো লাগে প্রিয়র। সেটাই এবার নষ্ট হতে বসেছে দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। তাই বিভাজন রুখতে শেষ চেষ্টা হিসাবে সে বলে , আছা আর একবার ওদের বলে দেখলে কেমন হয় ?
সবাই বলে , কোন লাভ হবে না। গাল বাড়িয়ে চড় খেতে হবে।
সেই আশংকাটাও উড়িয়ে দিতে পারে না প্রিয়। তাই বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করে না সে। কারও ইচ্ছে হলে সে নিজের মনোমত দিনে নবান্ন করতেই পারে। সেই কথা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দেয় সে। কিন্তু প্রসাদ মোড়লের নবান্নের দিন ফের সবার মন অশান্ত হয়ে ওঠে।সেদিন তারা দেখতে পায় গ্রাম তো বটেই আশেপাশের গ্রামগুলিতেও পোষ্টার চেটাচ্ছে প্রসাদ মোড়লের লোকেরা। সেই পোষ্টার থেকেই জানা যায় প্রিয়দের পান্ত নবান্নের দিন দাসকলগ্রামের অধীর মণ্ডলের পঞ্চরস হচ্ছে প্রসাদ মোড়লের খামারবাড়ির সামনে।
সেটা জানার পরই যেন আকাশ ভেঙে পড়ে প্রিয়দের মাথায়। কারণ ওইদিনই যে তাদের যাত্রা রয়েছে। সাধারণত পান্ত নবান্নের দিন যাত্রা , নাটক, পঞ্চরসের মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে। সেই হিসাবে তাদের নবান্নের দিন প্রসাদ মোড়লদের পঞ্চরস গান হওয়ার কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে তাদের পান্ত নবান্ন অর্থাৎ যাত্রার দিন পঞ্চরস গানের আয়োজন করাটা আক্রোশের বর্হ্বিপ্রকাশ তা অনুমান করতে কারও অসুবিধা হয় না। এক গ্রামের সঙ্গে অন্য কোন গ্রামের শত্রুতা থাকলে আক্রোশ মেটাতে এই ধরণের ঘটনা ঘটে। এক গ্রামে যাত্রা হলে অন্য গ্রাম বাউল, বোলান এমন কি হরিনামেরও আয়োজন করে। কিন্তু একই গ্রামে তা ঘটে না বললেই চলে।তাই সবাই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে।প্রশান্তকাকা বলেন , এটা খুব নোংরামি করল প্রসাদ মোড়ল। একই দিনে গ্রামে দুটো অনুষ্ঠান হলে ঝামেলা হওয়ার আশংকায় অনেকেই আসবেন না। আমাদের পরিশ্রমটাই বৃথা যাবে।
প্রিয় বলে , শুধু কি তাই ? ওদের হাতেই পুলিশ-প্রশাসন। কোন ঝামেলা হলে তার দায় আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে জেল খাটিয়েও ছাড়বে। কে জানে সেই পরিকল্পনা নিয়েই পঞ্চরস করাচ্ছে কিনা ?
জীতেনকাকা, অশ্বিনীমাস্টার বলেন , তাহলে উপায় ? এত খেটেখুটে রিহের্শাল দিয়ে শেষে কি প্রসাদ মোড়লের চক্রান্তে আমাদের যাত্রা বন্ধ করে দিতে হবে নাকি ?
--- উপায় একটা আছে। সবকিছু ঠিকঠাক হলে ওদের অস্ত্রে ওদেরকেই বধ করে দেওয়া যাবে। তবে সেটা যেন এখনই ঘুণাক্ষরে প্রকাশ না পায়। তাহলেই ওরা সামলে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে।
সবাই বলে , না না প্রকাশ পাবে কেন ? বলো শুনি কি উপায় ? কিছুতেই মনে স্বস্তি পাচ্ছি না।
---- বলছি। তার আগে কেউ একজন ওদের পঞ্চরস অপেরার পোষ্টারে ফোন নম্বর দেওয়া থাকলে লিখে নিয়ে এস। আর ঋজুদা তুমি ওই সঙ্গে আমাদের যাত্রা দলের ফোন নম্বরটাও নিয়ে এসো। বায়নাপত্রের কাগজটা তো তোমার কাছেই আছে। সেটাতেই ফোন নম্বর পেয়ে যাবে দেখ।
সেই মতো ঋজু আর রাজু ফোন নম্বর আনতে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি ফোন নম্বর নিয়েই ফেরে তারা।ফোন নম্বর লেখা কাগজটা প্রিয়র হাতে দিয়ে ঋজু বলে , প্রসাদ মোড়লের বাড়ির সামনে মঞ্চ গড়ার জন্য খুঁটি পোঁতা শুরু হয়ে গিয়েছে দেখলাম। বেশকিছু লোক গোল হয়ে শলাপরামর্শও করছে।
---- করাচ্ছি শলাপরামর্শ। তুমি ফোনটা দাও তো একবার।
বলে ঋজুর কাছে থেকে ফোনটা নিয়ে প্রিয় প্রথমেই রামকৃষ্ণ পঞ্চরস অপেরার কর্ণধার অধীর মণ্ডলকে ধরে। নিজেদের
নাম ঠিকানা গোপন করে জানতে চায় , ১৫ অগ্রহায়ণ তাদের কোথাও গান আছে কিনা। অধীর মন্ডল জানান , ১৫, ১৬ দুদিনই বায়না হয়ে আছে।
--- দুদিন কোথাই বায়না আছে একটু বলা যাবে ? কাছাকাছি হলে আপনাদের গান শুনতে গিয়েই বায়না করে দিতাম।
---- ১৫ তারিখ রামকৃষ্ণপুর , আর ১৬ তারিখ মনোহরপুরে।
---- আচ্ছা অধীরবাবু কোনরকমে ১৫ তারিখের বায়নাটা বাতিল করে আমাদের এখানে গানটা করা যায় না।
--- না - না সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। বায়না হয়ে যাওয়ার পর সেখানে গান করতে আমরা আইনত বাধ্য। তাছাড়া কথার খেলাপ হলে দলের বদনাম ছড়াবে। তখন কেউ বিশ্বাস করে আমাদের দল বায়নাই করতে চাইবে না। দলটা উঠে যাবে। আপনারা বরং ১৭ তারিখে দিন করুন। ওইদিন ফাঁকা আছে , হয়ে যাবে।
--- বেশ তাহলে তাই হবে। আমরা রামকৃষ্ণপুরে গান শুনতে গিয়ে প্যান্ডেলেই বায়না করে আসব আপনাদের।
এতক্ষণ ফোনে প্রিয়র কথা যেন হা করে গিলছিল সবাই। কথা শেষ হতেই জীতেনকাকা বলেন , তোমার পরিকল্পনাটা কি বলো দেখি , তুমি কি প্রসাদ মোড়লের আগেই পঞ্চরস করতে চাও নাকি ?
প্রশান্তকাকা বলেন , সেটা হলে ওর মুখে ঝামা ঘষে দেওয়া হত। কিন্তু অত খরচের ধাক্কা কি আমরা সামলাতে পারব ? শুনেছি অধীর মোড়ল নাকি ৭/৮ হাজার টাকা নাইট নেয়। যাত্রা - পঞ্চরস মিলিয়ে তো অনেক টাকার ব্যাপার। প্রসাদ মোড়ল এতদিন ধরে বহু টাকা মেরে রেখেছে। তার কাছে টাকাটা নস্যি। কিন্তু আমাদের তো তা নয়।
জীতেনকাকা বলেন - তাছাড়া ওদের পঞ্চরসের আগে তো দিনও ফাঁকা নেই শুনলাম। ওদের পরে করে তো আর লাভ হবে না। তাহলে কি করবে শুনি ?
---- দেখুন না কি করি আমি। প্রসাদ মোড়ল একাই আমাদের চিক দিয়ে যাবে ? এতদিন ও আমাদের চিক দিয়েছে। এবার আমরা ওকে দেব।
বলে এবার ফোনে লাভপুর যাত্রাপাড়ার নারায়ণী অপেরার ম্যানেজার শিবপ্রসাদবাবুকে ধরে সে। নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করে , শিবপ্রসাদবাবু ১৫ অগ্রহায়ণ কি আপনাদের গান আছে ?
---- না না , গান নেই। বিবেক গায়ক না থাকায় বায়না নেই বললেই চলে। সবাই তো আপনাদের মতো গায়ক যোগাড় করতে পারে না। কেন কি হয়েছে বলুন তো ?
--- আসলে হয়েছে কি জানেন, যিনি আমাদের বিবেক গাইছেন হঠাৎ করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন ১৬ তারিখে থাকতে পারবেন না। তাই আমরা ভেবেছি যাত্রাটা ১৫ তারিখে নবান্নের দিনেই করব। ওইদিন হলে আপনাদের কোন অসুবিধা আছে ?
--- অসুবিধা একটু হলেও আর কি করা যাবে। আপনাদের দিকটাও তো দেখতে হবে।
যেদিন চাইবেন আমরা সেদিনই যাত্রা করতে যাব।
--- বেশ , সবার সঙ্গে আলোচনা করে আপনাকে জানাচ্ছি। বলে ফোন বন্ধ করতেই প্রিয় দেখতে পায় সবাই ধৈর্য হারা হয়ে পড়েছেন।
প্রশান্তকাকা তো বলেই ফেলেন -- তোর রকম সকম কিছু বুঝতে পারছি না। এই পঞ্চরস দলের সঙ্গে কথা বলছিস , তো পরক্ষণেই আবার যাত্রার দিন পরিবর্তন করতে চাইছিস।
একটু খোলসা করে বল দেখি। না হলে যে আমরা কিছুই মালুম পাচ্ছি না। সাতপাঁচ ভেবে সারা হচ্ছি।
--- বেশ এবার পরিস্কার করেই বলি। কিন্তু আবার বলছি বিষয়টা যাত্রার আগের দিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যেই রাখতে হবে। প্রসাদ মোড়লের কানে যেন পৌঁছোয় না। তার কানে গেলেই সমস্ত পরিকল্পনা বরবাদ হয়ে যাবে।
---- বেশ তাই হবে , তুই খুলে বল দেখি তোর পরিকল্পনার কথা।
---- প্রসাদ মোড়ল যেহেতু আমাদের যাত্রার দিনেই পঞ্চরস করাবে বলে ঠিক করেছে তাই আমার মনে হয় আমরা যদি তার আগের দিন অর্থাৎ পান্ত নবান্নের পরিবর্তে নবান্নের দিন যাত্রাটা করে ফেলি তাহলে প্রসাদ মোড়লের চক্রান্তটা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
--- সেটা কি সম্ভব হবে ?
--- না হওয়ার কি আছে ? যাত্রাপার্টিরও দিন পরিবর্তনে কোন অসুবিধা হবে না বলল।
---- কিন্তু সবাই পান্ত নবান্নের দিন যাত্রা হওয়ার কথা জেনে গিয়েছে। তাদের কি হবে ?
---- মাইক নিয়ে জানিয়ে দিলেই হবে । তারপর তো বাবাজী আছেন। নবান্নের দিন তিনি তো বাড়িতে চাল - ডাল তুলে বেড়ান। ওই সঙ্গে অনশনের পাশাপাশি গান বেঁধে যদি যাত্রার প্রচারটাও করে দেন তাহলে ব্যাপারটা জমে যাবে।
--- সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু পঞ্চরস দলের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টা পরিস্কার হল না।
---- আসলে ওদের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলাম ১৫ তারিখ ওদের ফাঁকা আছে কিনা। ফাঁকা থাকলে যৎসামান্য কিছু টাকা দিয়ে দিনটা বুক করে রাখতে হত। যাতে
আমাদের যাত্রা এগোনোর কথা জানার পর প্রসাদ মোড়লও যেন পঞ্চরস গানের দিন এগিয়ে আনার সুযোগ না পায়। তারপরে মিথ্যা কোন অজুহাত দেখিয়ে বাতিল করে দিলেই হত। এতে বায়নার টাকাটা শুধু শুধু চলে যেত ঠিকই কিন্তু প্রসাদ মোড়লকে মুখের উপর মোক্ষম একটা জবাব দেওয়া হত। কিন্তু সেটা আর দরকারই হোল না। কিন্তু তাদের পরিকল্পনার কথাটা প্রসাদ মোড়ল যখন জানতে পারবে তখন হাত কামড়ানো ছাড়া তার আর কিছু করার থাকবে না।
প্রিয়র কথা শেষ হতেই সবাই বলে ওঠেন --- সাবাস।
( ক্রমশ )
খুব ভালো লাগলো দাদা।দারুণ!👏🏿👏🏿👏🏿
ReplyDelete