Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৩১




   

     অন্তরালে 



             অর্ঘ্য ঘোষ 



    ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



দৃষ্টি ফেরাতে পারে না প্রিয়ও। স্বাতীকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু বাইরে পায়ের শব্দে সেই ইচ্ছা দমন করতে হয় তাকে। স্বাতীর মুখের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখতে পায় চা জল খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকছে মধুরিমা। সেটা টেবিলে নামাতে নামাতে মধুরিমা বলে -- কতদিন পরে এলি , আজ খেয়েই যা না বাবা। স্বাতীর দাদা আমোদপুর গিয়েছে। বিকালের মধ্যেই ফিরে আসবে। ওর সঙ্গে দেখা করে যাওয়া হবে।
বোনের কথাটা মনে ধরে প্রিয়র। সৌরভকে নিজমুখে বলা হয়নি শুনলে মা হয়তো তাকে আবার পাঠাতে পারেন। সেই কথা ভেবে আর মধুরিমার পীড়াপীড়িতে তাকে মত বদলাতে হয়। স্বাতী মুখে কিছু না বললেও তার চোখে মুখে একই আকুতি দেখতে পায় প্রিয়। অগ্যতা খাওয়া দাওয়া করে সৌরভের সঙ্গে দেখা করেই বিকালের দিকে বাড়ি ফেরে সে। মাকে মধুরিমার শ্বশুর-শাশুড়ির কথাটা জানিয়েই লেখাটা নিয়ে মাচানতলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। ততক্ষণে একে একে যাত্রার কুশীলবরা সব আসতে শুরু করেছেন। প্রিয় গিয়ে তার লেখাটা অশ্বিনী মাস্টারের হাতে তুলে দেয়। মাস্টার মশাই তাতে চোখ বোলাতে শুরু করেন। তার পড়া শেষ হতে না হতেই বাকিরাও সবাই এসে পৌঁছে যান। তাদের দিকে চেয়ে অশ্বিনী মাস্টার বলেন , অপূর্ব হয়েছে।
প্রিয়র লেখাটা তিনি পড়ে শোনাতে শুরু করেন। পড়া শেষ হলে বাকিরাও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। প্রশান্তকাকা তো বলেই ফেলেন , বোঝাই যাচ্ছে না অংশটুকু আলাদা ভাবে লেখা হয়েছে। খুব সুন্দর সংযোজন হয়েছে। আগামী বছর থেকে আমরা আর বই কিনে যাত্রা করব না। প্রিয়ই  আমাদের জন্য বই লিখবে।
সবার উচ্ছস্বিত প্রশংসায় অস্বস্তিবোধ করে প্রিয়। কুন্ঠিত হয়ে বলে , কি যে বলেন না আপনারা। একটা দৃশ্য লেখা আর একটা গোটা  বই লেখা এক হলো ?
অশ্বিনী মাস্টার বলেন , একটা দৃশ্য যে লিখতে পারে সে ইচ্ছে করলে একটা বইও লিখতে পারে। বেশ এবার রিহের্শাল শুরু করা যাক।
প্রশান্তকাকা বলেন -- হ্যা - হ্যা , হাতে আর দিন নেই। এবার থেকে প্রতিদিন পুরো বই রিহের্শাল না হলে সামাল দেওয়া যাবে না।
সেই মতো সেদিন থেকে পুরোদ্যমে রিহের্শাল শুরু হয়ে যায়। রির্হেশাল শেষে বাড়ি ফেরার আগে যাত্রা আর অনশন নিয়ে এক প্রস্থ আলোচনাও হয়। সেদিনের আলোচনায় জীতেনকাকার কথা শুনে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে সবার মনে। কথা প্রসঙ্গে জীতেনকাকা বলেন , প্রসাদ মোড়লের গতিক খুব একটা সুবিধার লাগছে না কিন্তু। কয়েকদিন ধরে দেখছি রাতের বেলা বাইরে থেকে কিছু লোক আসছে। তাদের সঙ্গে কি সব শলাপরামর্শ চলে কে জানে।
প্রশান্তকাকা বলেন , শয়তানটাকে বিশ্বাস নেই। সব সময় চোখ কান খোলা রাখতে হবে।



                         কিন্তু সব সাবধানতা ব্যর্থ হয়ে যায়। এতদিন প্রসাদ মোড়ল ভাত মারছিল। এবার হাতে মারা শুরু হয় তার। বৈষ্ণব মানুষ বাবাজীর উপরেও নেমে আসে তার আক্রোশের খাঁড়া। অন্যান্য দিনের মতোই সেদিনও রিহের্শাল শেষে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বাবাজীও টিমটিমে লণ্ঠন হাতে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে বাড়ির পথ ধরেন। বাকিরা তখন বাড়ির দোরগোঁড়ায় পৌঁচেছে কি পৌঁছোয় নি , এমন সময় 'বাঁচাও - বাঁচাও ' বলে ভেসে আসে বাবাজীর আর্ত চিৎকার। সেই চিৎকার শুনেই বাবাজী যে কোন বিপদে পড়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রিয়দের। তারা চিৎকারস্থল অনুমান করে ছুটে যায়। গোয়ালসাহী কাঁদরের পাড়ে ছেলেপোঁতার কাছে পৌঁছোতেই স্তম্ভিত হয়ে যায় তারা। দেখা যায় মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন  বাবাজী। মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। লন্ঠনটা পাশে ভেঙেচুরে পড়ে রয়েছে। বাবাজীর অবস্থা দেখে ঋজুরা পাশের গ্রামে বাপী কোলের কাছে গাড়ি দেখতে ছোটে।  ওই অবস্থাতেও বাবাজী যন্ত্রনায় দাঁতে দাঁত চেপে ঘটনার বিররণ দেন। তার কথাতেই জানা যায় ,  মনের খেয়ালে গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ফিরছিলেন তিনি।ছেলেপোঁতার কাছে পৌঁছোতেই ঝোপের আড়াল থেকে মুখে কাপড় বাঁধা ৫ জন লোক লাঠি হাতে তার পথ আগলে দাঁড়ায়। লাঠির বাড়ি মেরে লণ্ঠনটা ভেঙে দেয়। তারপরই তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি তাদের বলেন, বাবা সব, আমি বৈষ্ণব বাবাজী মানুষ। কারও সাতে পাঁচে থাকি না। তাহলে আমার উপরে তোমাদের এত আক্রোশ কেন ?
ওদের মধ্যে সর্দার গোছের লোকটা বলে --- শালা , তোর বৈষ্ণবের গুষ্টির মুখে পেচ্ছাপ করি। সাতে - পাঁচে থাকতে পার না, কিন্তু তিন -- তেরোতে তো ভালোই থাকতে জানো। দিব্যি ওদের যাত্রাতে ভিড়েছো। আবার গান বেঁধে সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করাও হচ্ছে। তাই তোমার যে কিছু বখশিশ পাওনা হয় চাঁদু।
বলেই তার মাথায় কয়েক ঘা লাঠির বাড়ি বসিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায় , আজ হালকা করে দিয়ে গেলাম।এরপর বেচাল দেখলেই জানে মেরে দেব।
এক টানা কথাগুলো বলে হাঁফাতে থাকেন বাবাজী। তার কথাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় প্রসাদ মোড়লই তাদের যাত্রা আর অনশন কর্মসূচি বানচাল করতে বহিরাগতদের দিয়ে কাজটা করিয়েছে। আর সেটা বুঝতে পেরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রশান্তকাকা। সরাসরি প্রসাদ মোড়লের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে তিনি বলেন , এ শালা ওই প্রসাদ মোড়লেরই কাজ। খুব বাড় বেড়েছে। আর সহ্য করা যায় না। চলো সবাই এবার ওই শালাকেই টেনে ঘর থেকে বের করে ভালো করে কড়কে দিয়ে আসি। যাতে ভবিষ্যতে  কিছু করার আগে যেন পাঁঁচবার ভাবতে হয়।



                     প্রশান্তকাকার কথা শুনে শশব্যস্ত হয়ে ওঠেন বাবাজী। হাত জোড় করে বলেন , দোহাই বাবারা ভুলেও ওই কাজটি করতে যেও না। সামনে আমাদের দুটো বড়ো কাজ রয়েছে। এসময় ওদের পাতা  ফাঁদে  পা দিলেই সব মাটি হয়ে যাবে।
বাবাজীর কথার যৌক্তিকতা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তাই মনের রাগ তাদের মনেই চেপে রাখতে হয়। গাড়ি পৌঁছোতেই বাবাজীকে নিয়ে প্রিয়রা কয়েকজন বোলপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বাবাজী অবশ্য কিছুতেই চিকিৎসা করাতে বোলপুর যেতে চাইছিলেন না। বার বার বলছিলেন , খুব বেশি কিছু ফাটে নি। ও এমনিতেই সেরে যাবে।ওরকম তো কতই ফাটে, সেরেও  যায়।
কিন্তু প্রিয়রা তার কথা কানে তোলে না। বাবাজীকে নিয়ে তারা সোজা হাজির হয় সুশোভনবাবুর চেম্বারে। সব শুনে সুশোভনবাবু বলেন , লোকটা কি ক্ষেপে গেল নাকি ? ওর দলের নেতারাও কি করে এটা বরদাস্ত করছেন কে জানে ! এতে তো দলেরও বদনাম হবে। অবশ্য দলের সুনাম-বদনাম নিয়ে ওদের কোন মাথাব্যথা আদৌ আছে কিনা সন্দেহ আছে ? নাহলে এত কিছুর পরেও একটা ডাক্তার পাঠাতে পারে না ? 
রাগে গজ-গজ করত করতেই চিকিৎসা শুরু করেন তিনি। অত রাতে কম্পাউন্ডার - টেকনিশিয়ান কেউ ছিলেন না। প্রিয় চুল কেটে ক্ষতস্থান পরিস্কার করে দেয়। ডাক্তারবাবু নিজে হাতে পরম যত্নের সঙ্গে সেলাই করে দেন। দুটো সেলাই দিতে হয়।সেলাই করার পর ডাক্তারবাবু বলেন , আঘাত তেমন গুরুত্বর নয়। তবু একবার  সিটিস্ক্যান করে নেওয়াই ভালো। এখন তো টেকনিশিয়ানরা কেউ নেই। প্রিয় তুমিই বরং সিটিস্ক্যানটা করে আনো।দেখি কেমন পার তুমি। তোমারও স্বাধীনভাবে হাতেখড়ি হয়ে যাক।  ডাক্তারবাবুর কথাটা শুনে থমকায় প্রিয়। এর আগে সে অনেকের সিটিস্ক্যান সহ অন্যান্য পরীক্ষা করেছে। কিন্তু তখন মাথার উপরে একজন অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান থাকতেন। কিন্তু এখন একা যদি ভুলচুক কি একটা হয়ে যায় ? 
তার দুশ্চিন্তার ভাব আঁচ করে ডাক্তারবাবু বলেন , আরে অত ভাবছ কেন ? আমি তো রয়েছি। যাও পরীক্ষাটা করে আন তো দেখি।
ডাক্তারবাবুর কথায় মনে জোর পায় প্রিয়। বাবাজীকে সেন্টারে নিয়ে গিয়ে সিটিস্ক্যানটা করে আনে সে। রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু বলেন , যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। রিপোর্টে খারাপ কিছু নেই।
শুনে সবার মনে স্বস্তি ফেরে। ফেরার আগে ঋজুদা সুশোভনবাবুকে জিজ্ঞেস করে -- কত দেব ? 
--- কি কত দেবে ? 
--- চিকিৎসার খরচ ? 
--- জানো তো আমার বাঁধা রেট। আমি এক পয়সা কমও নিই না , বেশিও নিই না। বলে ঋজুদার হাত থেকে একটা টাকা তুলে নেন তিনি।
সবাই বলেন -- ফিজ না নিলেও স্ক্যানের টাকাটা অন্তত নিন। এত রাতে চিকিৎসাটা পেলাম, সেটাই খুব।
---- শোন এমনিতেই কসাই হিসাবে ডাক্তাদের পরিচিতি আছে। কেউ কেউ হয়তো সত্যি সত্যি সেই ধারারও। কিন্তু আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের একটি সামাজিক কর্তব্য আছে। তোমরা সেই কর্তব্য পালন করছো। আমাকে তার একটুখানি ভাগই না হয় দিলে ? 
এরপর আর কোন কথা চলে না। কেউ কোন কথা বলতেও পারে না।ডাক্তারবাবুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তারা বাবাজীকে তার আখড়ায় পৌঁছে দেয়। ততক্ষণে মা'জীর কাছে খবরটা লোকমুখে পৌঁছে গিয়েছে। তাই উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিলেন তিনি। বাবাজীকে নিয়ে তারা পৌঁছোতেই উদ্বেগ ঝড়ে পড়ে তার গলায় -- হ্যা গো বাবারা একি হোল বলতো ?  বৈষ্ণব বাবাজী মানুষেরও ছাড় নেই। আবার কিছু হবে না তো ? 
প্রিয় তাকে আশ্বস্ত করতে বলে -- মা'জী আর কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এবার থেকে আমরা এসে বাবাজীকে নিয়ে যাওয়া আসা করব।
সেইমতো ' জীবন সুরক্ষা ' কমিটির সদস্যরা পালাক্রমে রিহের্শালের সময় তো বটেই , টহল দেওয়ার সময়ও বাবাজীকে নিয়ে আসা যাওয়া শুরু করে।তাতে বাবাজীর উপরে তো আক্রমন প্রতিহত হয়। কিন্তু অন্যদিকে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে।



         ( ক্রমশ ) 



   নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



No comments:

Post a Comment