Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৩৪



   

      অন্তরালে 



            অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



সঙ্গে সঙ্গে ঋজু বলে ওঠে -- শয়তান বলে শয়তান। ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে ঘা'কতক লাগিয়ে দিই। ওর জন্যই নবান্নের আনন্দটা এবারে মাঠে মারা যেতে বসেছে।ঋজুদার কথা শুনে সম্বিৎ ফেরে প্রিয়র। সে বোঝে কথাটা  তার বলা উচিৎ হয় নি। কথায় কথা বাড়ে। কথায় উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়ে। সে'ই যদি মেজাজ হারিয়ে বেফাঁস কথা বলে ফেলে তাহলে বাকিদের হাত চালিয়ে দিতে কতক্ষণ ? তাতে যে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। শুধু নবান্ন বা যাত্রাই তো নয় , সামনেই যে রয়েছে তাদের অনশন কর্মসূচি।তার আগে কোন আইনী জটিলতায় জড়িয়ে গেলে সব বানচাল হয়ে যাবে। তাতে প্রসাদ মোড়লেরই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। কোন রকমে তাদের জেলে ঢোকানোর জন্যই তো সে পায়ে পা লাগিয়ে এইভাবে ঝামেলা বাঁধাতে চাইছে। কিন্তু তার পাতা ফাঁদে কাউকে পা দিতে দেবে না সে। ঋজুদাকে বলে , ছাড়ো তো ওর কথা। বরং চলো মাচানতলায়  গিয়ে কালকের কর্মসূচি সব ঠিক করি।সেইমতো তারা মাচানতলায় পৌঁছোয়। ইতিমধ্যেই সেখানে তখন আলোচনা জমে উঠেছে। আগে ঠিক ছিল আজই শেষ রিহের্শাল হবে। কিন্তু দিন পাল্টে যাওয়ায় সেই মতটাও বদলাতে হয়েছে। কারণ রাত পোহালেই তাদের যাত্রার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সেই জন্যই আজ সবার কাজ ভাগ করে দেওয়া হবে। নাহলে সামলে ওঠা যাবে না। ঠিক হয় বাবাজী তো বাড়ি বাড়ি নবান্নের সামগ্রী তুলতে যাওয়ার সময় প্রচার করবেনই , ঋজু আর প্রিয়ও সকাল সকাল মাইক নিয়ে প্রচারে বেরিয়ে যাবে। জীতেন কাকা, রাজুরা গোরুর গাড়ি নিয়ে লাভপুর থেকে যাত্রাদলের ফিমেল - যন্ত্রীদের আনতে যাবেন। প্রশান্তকাকা আর অশ্বিনী মাস্টার বাকি ছেলেদের নিয়ে বিভিন্ন বাড়ি থেকে তক্তা নিয়ে এসে স্টেজ তৈরি আর যাত্রা দলের লোকেদের খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। দিনের বেলায় তো খাওয়ার ঝামেলা নেই। যাত্রাদলের লোকেদের বিভিন্ন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দেওয়া হবে। কিম্বা বিভিন্ন বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসে মাচানতলায় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু রাতে রান্নাটা করতেই হবে। কারণ  দিনভর নবান্নের খাটাখাটির পর মেয়ে বউরা একে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে , তার উপরে যাত্রা দেখতে আসার তাড়া থাকবে। তাই তাদের উপরে ফের রান্নার ভার চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। তাছাড়া ডাক্তারবাবু আর আর্যদা তো আসবেনই, অন্যান্য সাংবাদিকরাও আসতে পারেন। তাদেরও তো না খাইয়ে ছাড়তে পারবে না তারা। তাই মাচানতলাতেই রান্নার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গ্রাম কমিটির চাষ করা পুকুর থেকে কিছু মাছ ধরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলে পাড়ার অজিত ধীবরকে। রান্নার নটকোন  এবং অন্যান্য খরচের জন্য ঋজুদা প্রশান্তকাকার হাতে কিছু টাকা তুলে দেয়।উত্তেজনায় সেদিন রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারে না প্রিয়। মাঝেমধ্যেই উত্তেজনায় ঘুম ভেঙে যায়। মধ্যরাত পার করে ঘুম নামে তার চোখে। একটা মিষ্টি স্বপ্নের আবেশে মাখামাখি হয়ে যায় তার ভোরের ঘুম। স্বপ্নে তার নায়িকা হয়ে আসে স্বাতী। ডায়াসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা যখন গান ধরে তখন হাজার দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। গান থামতেই হাততালিতে ফেটে পড়ে তারা।


                            
                                                  আচমকা তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারে হাততালি নয়, দরজায় কড়া নাড়ছেন মা।মা বলেন , কি রে উঠবি না ? ঋজু তো রিক্সায় মাইক বেঁধে নিয়ে এসে সেই কখন থেকে বসে আছে।
মায়ের কথা শুনে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ে প্রিয়। কলঘরের দিকে যেতে যেতে ঋজুদার উদ্দেশ্যে বলে , তুমি আর রিক্সাচালক চা খাও। আমি ততক্ষণে রেডি হয়ে আসছি।প্রচার করতে যাওয়ার সময়ই প্রিয় দেখতে পায় জীতেনকাকারা দুখানা গোরুর গাড়ি নিয়ে লাভপুরে উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়েছেন। তাদের দেখে হাত নাড়েন।  তারাও প্রত্যুত্তর দেয়। বিভিন্ন বাড়ি থেকে মাচানতলায় চৌকি নিয়ে যাওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রশান্তকাকা আর অশ্বিনীমাস্টার সেগুলো সমান করে বসাচ্ছেন। সেসব দেখেই মাইক্রোফোন ধরে সে বলে উঠে --- আনন্দ সংবাদ , আনন্দ সংবাদ, আগামী কালের পরিবর্তে আজই দেখুন মনোহরপুর 'জীবন সুরক্ষা' কমিটি পরিবেশিত যাত্রা অনুষ্ঠান ' আলোর ঠিকানা। ' অনিবার্য কারণ বশত দিন পরিবর্তনের জন্য আমরা দুঃখিত। মনে রাখবেন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর মনোহরপুর মাচানতলায় এই প্রথম ডে-লাইটের পরিবর্তে জেনারেটরের আলো ঝলমল রঙ্গমঞ্চে ----
ঘোষণা শেষ হয় না। প্রসাদ মোড়ল খামারবাড়ি থেকে কান খাড়া করে সেই প্রচার শোনার চেষ্টা করে। প্রিয় অবশ্য কোন আমলই দেয় না। সে গলায় আরও আবেগ ঝড়িয়ে প্রচার চালিয়ে যায়।  গ্রাম ছাড়াতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় তার। রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পায় একটা সাইকেলে মধুরিমাকে চাপিয়ে নিয়ে সৌরভ আর অন্য একটি সাইকেলে স্বাতী তাদের গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে। হলুদ কালো চুড়িদার পড়েছে আজ স্বাতী। দু'দিকে বিনুনি ঝুলিয়ে আজ স্কুল ছাত্রীর মতো দেখাচ্ছে তাকে। চোখ ফেরাতে পারে না প্রিয়। কিন্তু পাশে ঋজুদা বসে তাড়া লাগায় -- কি রে থামলি কেন , বল ?  
তাড়া খেয়ে সে ফের বলতে শুরু করে --- আনন্দ সংবাদ -- আনন্দ সংবাদ।
ততক্ষণে স্বাতীরা রিক্সার কাছাকাছি এসে পড়ে।  মধুরিমা হাতের ইশারায় রিক্সাটাকে দাঁড় করিয়ে বলে, ভালো দেখালি তো দাদা। যাত্রার দিন পাল্টেছিস তা কই জানাস নি তো ? 
---- আসলে সারপ্রাইজ দেব ভেবেছিলাম।
---- সারপ্রাইজ বেরিয়ে যেত। আমরা তো পান্ত নবান্নের দিন আসব ঠিক করেছিলাম। আয় বাড়ি আয় , তারপর তোর হচ্ছে। তোকেও একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার আছে।বলেই স্বাতীর দিকে তাকিয়ে একটা কটাক্ষ হানে মধুরিমা।স্বাতী লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।রিক্সা এগিয়ে চলে সামনের দিকে।মাইক্রোফোনটা ঋজুদার হাতে দিয়ে একবার পিছন পানে চায় প্রিয়। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেওয়ার আগে স্বাতীও এক পলক চায়। সেই চাউনিতে যেন রাশি রাশি শিউলি ঝড়ে পড়তে দেখে প্রিয়। মধুরিমার কথাটা কানে বাজে তার। ও আবার কি সারপ্রাইজ দেবে কে জানে ! 



                                 এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে দুপুর গড়িয়ে যায় প্রিয়দের। কারণ প্রতিটি গ্রামেই কিছুক্ষণ করে দাঁড়াতে হয় তাদের। ওই গ্রামের মানুষজন পান্ত নবান্নের দিন যাত্রা হওয়ার কথা জানতেন। বরাবরই তো তাই হয়। সেই মতো তারা পান্ত নবান্নের দিনই যাত্রা দেখতে যাব বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। তাই তারা দিন পরিবর্তনের কারণ জানতে চান। প্রিয়দের কারণটা খুলে বলতে হয়। সেই কথা শুনে অধিকাংশ মানুষই বলেন -- লোকটা আচ্ছা শয়তান তো ! ওঠে অনশনের প্রসঙ্গও। গ্রামবাসীরা বলেন , বাবাজীর কাছে সব শুনেছি। আমরা তোমাদের সঙ্গে যোগ দেব ঠিক করেছি। ডাক্তার এলে আমাদেরও তো উপকার হবে।
প্রিয় মনে মনে ভাবে , বাবাজীর গানই ওইসব মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করেছে। গান বিশেষত লোকগান খুব দ্রুত মানুষের মর্মে প্রবেশ করে। হাজার মাইক প্রচারেও তা হয় না। প্রচার সেরে তারা যখন  মাচানতলায় পৌঁছোয় তখন স্টেজ তৈরি হয়ে গিয়েছে। যাত্রা পার্টির লোকেরা খাওয়া দাওয়া করে ক্লাবঘরে ঘুমোচ্ছেন। তারা রিক্সা থেকে নামতেই এগিয়ে আসেন সবাই।প্রশান্তকাকা বলেন , বেশ মজা লেগে গিয়েছে। বিষয়টা জানার পরই প্রসাদ মোড়লের পাঁকে হাতি পড়ার মতো দশা হয়েছে। শুধুই ঘর-বার করছে আর ফোন করেই যাচ্ছে। ওর সাগরেদরা এদিক - ওদিকে সাইকেল নিয়ে ছোটাছুটি করছে।
জীতেনকাকা বলেন -- ওদের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয় কোন প্ল্যান ভাজছে। 
প্রসাদকাকাদের কথা শুনে  মনে মনে প্রমাদ গোনে প্রিয়। দুর্যোগের আঁচ পায়। ঋজুদার ফোনে আর্যদাকে ধরে সে। প্রসাদ মোড়লের গতিবিধির কথা জানিয়ে বলে -- ওরা আমাদের কোন প্রশাসনিক জটিলতায় ফেলার পরিকল্পনা করছে না তো ? 
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আর্যদা জানান ,  সে আশঙ্কা একটা রয়েছে। তবে সময় মতো জানিয়ে ভালো করেছেন। আমি এখান থেকে প্রশাসনিক ব্যাপারটা সামলানো যায় কিনা দেখছি। তবে আমরা তো যাচ্ছিই। তাই ব্যাপারটা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। তেমন কিছু হলে তখন দেখা যাবে।
আর্যদার সঙ্গে কথা বলার পর স্বস্তি পায় প্রিয়। তার মনে জমে ওঠা দুশ্চিন্তার মেঘটা সরে যায়। প্রিয় দেখতে পায় প্রসাদ মোড়লর হাঁকডাক থেমে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে মাইকও। খামারবাড়ি জুড়ে যেন বিয়ে ভেঙে যাওয়া বাড়ির মতো স্তব্ধতা বিরাজ করছে। সন্ধ্যাবেলা থেকেই অবশ্য চিত্রটা বদলে যায়।



        ( ক্রমশ ) 





নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



No comments:

Post a Comment