Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৩৫




  




       অন্তরালে 


              অর্ঘ্য ঘোষ 



     ( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 


গ্রামের দিকে সাধারণত প্রথম সন্ধ্যাতেই যাত্রার চল রয়েছে।  সেই অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রাম থেকে একে একে যাত্রা দেখতে হাজির হতে শুরু করেছেন মানুষজন। তার আগে থেকেই গ্রামের লোকের সামনের দিকে বসার জন্য চট - তালাই পেতে জায়গা দখল করে রেখে গিয়েছেন।  ডেকোরেটারের লোকেরা  মাইক - লাইট ফিট করতে শুরু করে দিয়েছে।আশেপাশের মধ্যে এবারই প্রথম মনোহরপুরে জেনারেটরের আলোয় যাত্রা হচ্ছে , তাই এবারের যাত্রা ঘিরে লোকের আলাদা আগ্রহও রয়েছে। সেইজন্যই বোধহয় এবার একটু সকাল সকাল লোক সমাগম হতে শুরু করেছে। সেইসব দেখতে দেখতে প্রিয় মেক - আপের জন্য গ্রীনরুমে ঢুকতে যাবেএমন সময় প্রসাদ মোড়লের খামারবাড়িতে তারস্বরে বেজে ওঠে মাইক। সাজঘর থেকে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে প্রিয়। প্রসাদ মোড়লের খামারবাড়ির দিকে চাইতেই দেখতে পায় সেখানে বেশ কিছু লোক জটলা করছে। আর দুটো মাইক মাচানতলার দিকে মুখ করে বাঁধা রয়েছে। সেই মাইকে কান ঝালাপালা শব্দে গান বাজানো হচ্ছে। যাত্রার বিঘ্ন ঘটাতেই যে প্রসাদ মোড়ল এই নোংরামিটা করছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রিয়র। তাদের যাত্রার বিঘ্ন ঘটানোর জন্য প্রসাদ মোড়ল নাকি সকাল থেকে বাউল , বোলান এমন কি কীর্তন গান করানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় লোক পাঠিয়েছিল। কিন্তু কারও বায়না ছিল , কেউ বা একই দিনে যাত্রা হচ্ছে শুনে গান করতে রাজী হয়নি। তাই শেষমেশ আক্রোশ মেটাতে  দুটি মাইক ভাড়া করে নিয়ে এসেছে। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে  প্রিয়। এই ভাবে মাইক বাজলে কেউ যাত্রা ভালো ভাবে শুনতেই পাবে না। কিন্তু কি করা যায় ভেবে কিছু কুলকিনারা পায় না সে। এই সময় কিছু বলতে যাওয়া মানেই ঝামেলা অনিবার্য। আর ঝামেলা মানেই নির্ঘাত যাত্রায় তার  বিরূপ প্রভাব পড়বে। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় দর্শকরা সব গুটি গুটি বাড়ির পথ ধরবে। তাদের এতদিনের পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে। ততক্ষণে অন্যরাও একে একে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রসাদ মোড়লের আচরণে সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন।  তাদের মধ্যে জীতেনকাকা বলেন -- এবার ব্যাটার মরণ পাখা গজিয়েছে। এবার  নির্ঘাত মরবে। 
প্রশান্তকাকা বলেন , সত্যি আর সহ্য করা যায় না। আমরা একের পর এক সহ্য করে  যাচ্ছি বলে ও যা খুশী করে যাচ্ছে। এবার ঘা কতক না লাগালে আর চলছে  না। চল তো সব , ব্যাটাকে আছা করে ঘা কতক লাগিয়ে মাইক দুটোকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে আসি ।
প্রিয় দ্রুত হাত বাড়িয়ে আগলে দেয় তাদের। তারপর অনুনয়ের সঙ্গে বলে -- দয়া করে কেউ মেজাজ হারাবেন না।সবাই মাথা ঠান্ডা রাখুন। ভুলেও কেউ ওর খামারবাড়ির দিকে পা বাড়াবেন না। আমরা মাইক ভাঙলে ও নিজে নিজে বাক্স প্যাটরা ভেঙে আমাদের  বিরুদ্ধে সোনা-দানা টাকা-পয়সা লুটের অভিযোগ তুলবে। সেইজন্যই তো ও আমাদের উত্তেজিত করতে এটা করছে।  তাহলে আমরা কেন ওর পাতা ফাঁদে পা দিতে যাব ? 
জীতেনকাকা বলেন , সে ও হতে পারে। যে অবলা জীবের খাবারে বিষ মেশাতে পারে সে সব পারে।
প্রশান্তকাকা বলেন --- তাহলে তো যাত্রাটাই বন্ধ করে দিতে হয়।
--- না - না, তা কেন হবে। সবার এখানে থাকার দরকার নেই। আপনার সবাই সাজঘরে গিয়ে মেক আপ নেওয়া শুরু করুন। আমার তো দু' সিন পরে রোল আছে। আমি এদিকটা দেখছি। আর্যদারা আসুক, ওদের সঙ্গে পরামর্শ করে কি করা যায় দেখছি।




                                    তার কথা শুনে সবাই সাজঘরে চলে যায় বটে, কিন্তু প্রিয় নিজে মনে কোন স্থিরতা পায় না। তার মনে হয় , গ্রামের মানুষের ক্ষোভ হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রসাদ মোড়লের নোংরামিতে সবাই আজ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। অস্থির মন নিয়েই আর্যদাদের আসার প্রতীক্ষায় সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব উদ্বেগ বোধ হয় তার। যাত্রা শুরু হতেও আর দেরি নেই। যন্ত্রীরা সব আসরে যন্ত্র দিতে শুরু করেছেন। সেই সময় দূরে গাড়ির হেড লাইট দেখে স্বস্তি ফেরে প্রিয়র মনে। সে ধরেই নেয় আর্যদারা পৌঁচ্ছে গেলেই একটা উপায় হবেই।সেই আশায় সে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু গাড়িটা মাচানতলায় এসে থামতেইএক নিমেষেই তার মনের স্বস্তি উড়ে যায়। সে দেখতে পায় গাড়ি থেকে নামছেন থানার নতুন বড়বাবু চরণ বোস। এই আশঙ্কাটাই তো সে করেছিল। প্রসাদ মোড়ল নিজে কিছু করতে না পেরে পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারে বলেই সে সবাইকে ওর প্ররোচনা পা দিতে বারণ করেছিল। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও গ্রামে পুলিশ  এল কেন ভেবে পায় না সে।ততক্ষণে গাড়ি থেকে আরও ৮/৯ জন পুলিশ নেমে দাঁড়িয়েছেন বড়বাবুর পাশে। প্রিয়কে সামনে পেয়ে বড়বাবু জিজ্ঞেস করেন -- হ্যা রে তোদের গাঁয়ে প্রিয় কে আছে রে ?
বড়বাবুর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় প্রিয়। তার মুখে নিজের নাম শুনে সে ততটা আশ্চর্য হয় না। প্রসাদ মোড়লরা যে তার নামেই কিছু লাগাবে , তা তো জানা কথা। সে আশ্চর্য হয় , বড়বাবুর মুখে তুই-তোকারি শুনে। বড়বাবু প্রায় তার সমবয়সী।অথচ অবলীলায় তাকে তুই-তোকারি করছেন। সবাইকে তুই তোকারি করাটাই বোধহয় পুলিশের ধর্ম। এই তো আজকের যাত্রার বইয়েই  রয়েছে , এক পুলিশ অফিসার তার বাবার বয়সী এক বৃদ্ধকে তুই তোকারিই শুধু নয় , খিস্তি করেই কথা বলছেন। পালাকার যখন লিখেছেন তখন নিশ্চয় ওই ধরণের ঘটনা ঘটে।
---- কি রে তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছি , সেটা কি কানে যায় নি ? 
ফের বড়বাবুর তুই তোকারি শুনে সে কিছুটা রাগের সঙ্গেই বলে , আমিই প্রিয়। কেন কি হয়েছে ?
---- যাত্রাটা কি তুই করাচ্ছিস ? 
---- আমি নয় , আমরা।
---- ওই হোল , শুনলাম তুই-ই নাকি পালের গোদা।
বড়বাবুর মুখের ভাষা শুনে রাগ চড়তে থাকে প্রিয়র। অন্যসময়  হলে সে আচ্ছা করে দু'কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ত না। কিন্তু যাত্রার কথা ভেবে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয় তাকে। তাই রাগটা চেপে রেখে সে বলে , হ্যা , তাহলে তাই। 
সেই সময় কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ায় আরও একটি গাড়ি। প্রিয় দেখতে পায় সেই গাড়ি থেকে নামছেন ডাক্তারবাবু, আর্যদা সহ আরও কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের দেখে ভরসা পায় প্রিয়। বড়বাবু অবশ্য তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাদের একপলক দেখেই বলেন -- যাত্রা যে করছিস , প্রশাসনকে জানিয়েছিস ?
---- না, তা তো করা হয় নি। বহুদিন ধরেই তো আমরা যাত্রা করছি। কই কখনও পারমিশান নিতে হয় বলে শুনিনি। 
---- তাহলে তো যাত্রা করা যাবে না। বন্ধ করতে হবে সব। 
---- সে কি করে সম্ভব ? লোকজন সব চলে এসেছে।  এখন যাত্রা বন্ধ করে দেওয়াটা কি সম্ভব বলুন ? 
---- তা আমি কি করে বলব ? পারমিশান না নিয়ে যাত্রা করাতে গেলি কেন ?  
---- নবান্নে যাত্রা করাতেও যে পারমিশান লাগে তা আমাদের জানা ছিল না। বহু জায়গায় তো এইরকম যাত্রা হয় , ক'জন পারমিশান নেয় বলুন তো ?
---- সে জবাব কি তোকে দিতে হবে রে হারামজাদা  ?
---- কুল - কুল অফিসার। এত অল্পেই মাথা গরম করে ফেলবেন না , কথাগুলো বলে বড়োবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আর্য। কখন যে আর্যদারা তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা তারা কেউ টের পায় না। বড়বাবু নতুন এসেছেন ,আর্যদা বা অন্যান্য সাংবাদিকদের চেনেন না। তাই তাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলেন -- তোমরা আবার কে লাটের ব্যাটা পাটের শাক ? তোমরাও কি যাত্রাদলের লোক নাকি ? 
---- উহু উহু তুমি তুমি নয়।  আপনি আজ্ঞে করে কথা বলুন। আর সে ধরতে গেলে আমরাও যাত্রা দলেরই লোক বইকি। তবে আমাদের অন্য একটা পরিচয়ও আছে। বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে আর্যদা ফের বলেন , তথ্য জানার আইন মোতাবেক নিদ্দিষ্ট প্রক্রিয়া মাফিক সবার সব কিছু জানার অধিকার আছে। যাকগে বাদ দিন সেকথা , একটা কথা বলুন তো এতগুলো মানুষের একটা নির্মল আনন্দ আপনি কেন বরবাদ করে দিতে চাইছেন ? 
--- আমাদের কাছে খবর আছে এই যাত্রা ঘিরে ঝামেলার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারি পারমিশান ছাড়া এইভাবে এত লোকের বেআইনী জমায়েত আমরা করতে দিতে পারি না।
---- বাঃ, ভালো বললেন তো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তো খুন, সন্ত্রাস , ডাকাতি কিম্বা লুঠতরাজের উদ্দেশ্যে জমায়েত হওয়া দুস্কৃতিদের আপনারা টিকিও ছুতে পারেন না। আর নির্ভেজাল আনন্দের জন্য মানুষের এই জমায়েতকে বেআইনী বলছেন ? এমনটা যে হতে পারে সে আন্দাজ আমি করে ছিলাম। তাই উপযুক্ত ব্যবস্থাও আমি করেই এনেছি। নিন দেখে নিন , আপনাদের বড়সাহেবের পারমিশান।
পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বড়বাবুর হাতে ধরিয়ে দেন আর্যদা। কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে বড়বাবুর মুখটা যেন চুপসে যায়। উদাসীন সুরে বলেন , খোদ এস,পি সাহেব যেখানে পারমিশান দিয়েছেন সেখানে তো আর কিছু বলার থাকে না। বেশ করুন আপনারা যাত্রা। আমরা তাহলে যায়।
তিনি গাড়িতে ওঠার উপক্রম করতেই আর্যদা বলেন , আরে মশাই যাবেন  কোথাই ? এই মাত্র আপনি বললেন না যাত্রা ঘিরে ঝামেলার আশঙ্কা রয়েছে।তাহলে সেটা জেনেও আপনি চলে যাচ্ছেন কোন বিবেচনায় ? এরপর যদি কোন ঝামেলা হয় তাহলে কিন্তু আমরা এস,পি সাহেবকে বলব আপনার অফিসার সব জেনেও গ্রাম ছেড়ে চলে যান।আর হ্যা , এতক্ষণ 
পারমিশানের কথা বলছিলেন না ? এখানে কিছুক্ষণ পরেই যাত্রা হতে চলেছে আর ওখানে মাইক বাজছে। যান গিয়ে আগে ওদের মাইক বাজানোর পারমিশান আছে কিনা দেখে আসুন তো !  ঝামেলার সুত্রপাত তো ওখান থেকেই হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ওই কথা শোনার পরই গাড়ির পাদানিতে পা রেখেও নামিয়ে নিতে হয় বড়বাবুকে।



   ( ক্রমশ ) 






নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



No comments:

Post a Comment