Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৩৬



  অন্তরালে 

    অর্ঘ্য ঘোষ 


( ধারাবাহিক উপন্যাস )




তেঁতো ওষুধ খাওয়ার মতো মুখ করে দু'জন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে প্রসাদ মোড়লের খামারবাড়ি অভিমুখে এগিয়ে যান বড়বাবু। তার কিছুক্ষণ পরই থেমে যায় প্রসাদ মোড়লের মাইক। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে প্রিয়রা।সবাই এসে ডাক্তারবাবু আর সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে যায়। সাংবাদিকদের কাছে তো বটেই ডাক্তারবাবুর কাছেও এ গ্রামের মানুষের কম ঋণ নেই। ভিজিট তো সেই এক টাকা , তার উপরে বহু মানুষকে ওষুধ পর্যন্ত কিনে দিয়েছেন। তাই গ্রামবাসীরা সেই ডাক্তারবাবুকে পেয়ে আহ্লাদে যেন আটখানা হয়ে ওঠেন। কৃতজ্ঞতা জানাতে এসে ডাক্তারবাবু আর সাংবাদিকদের ঘিরে ধরেন। সবাই তাদের নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চান। সেই আবদারে ডাক্তারবাবুরা খুব দোটানায় পড়েন। কাকে ছেড়ে কার বাড়ি যাবেন। যার বাড়ি না যাবেন তারই অভিমান হবে।কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তো সবার বাড়ি যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই ডাক্তারবাবু হাত জোড় করে বলেন - আপনাদের আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ। কিন্তু দোহাই আপনাদের , কিছু মনে করবেন না। সবাই আমাদের  বাড়ি নিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে আমরা কার  বাড়ি ছেড়ে, কার বাড়ি যায় বলুন ? যার বাড়ি না যাব তারই অভিমান হবে তো। পরে কখনও এসে সারাদিন আপনাদের সঙ্গে কাটিয়ে যাব। আজ বরং  চলুন সবাই এক সঙ্গে বসে যাত্রা দেখি।
ডাক্তারবাবুর কথার যৌক্তিকতা অনুধাবন করে আর কেউ আর পীড়াপীড়ি করেন না।সেইসময় বড়বাবু ফিরে আসেন প্রসাদ মোড়লের বাড়ি থেকে। তিনিও যাত্রা শুরু করার জন্য তাড়া দেন। আর্যদাকে উদ্দেশ্য করে বলেন --- কই সাংবাদিক মশাই , এবার যাত্রা শুরু করতে বলুন। আমদের তো আবার থানায় ফিরতে হবে। বড়োবাবুর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় প্রিয়। যে লোক একটু আগে তাদের যাত্রা বন্ধ করতে এসেছিল সেই লোকই এখন তাদের যাত্রা সুসম্পন্ন করার জন্য শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবেন। একেই বলে "সাপের মাথায় জড়ি।" ভাগ্যিস সেদিন ফোনে আর্যদাকে কথাটা জানিয়েছিল সে। নাহলে কি হত বলা যায় না। যাত্রা না হলে গ্রামের বদনাম তো হতই , প্রসাদ মোড়লের উসকানিতে কেউ কেউ ঝামেলা বাঁধাতেও পারত।সেই জন্য আর্যদাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় প্রিয়। বড়বাবুর তাড়ায় আর্যদা তার দিকে চাইতেই সে বলে, এখুনি শুরু করে দিচ্ছি। আপনারা সামনে গিয়ে বসুন। বলেই দুজন ছেলেকে কয়েকটা চেয়ার নিয়ে ওদের সবার ভালোভাবে বসা আর চা-টিফিনের ব্যবস্থা করে দিতে বলে। তারপর সাজঘরের দিকে এগিয়ে যায় প্রিয়। সাজঘরে ঢোকার মুখেজীতেনকাকা এসে বলেন , ডাক্তারবাবুরা ঠিক কথাই বলেছেন। আজকের দিনে কারও বাড়িতে খেতে গেলে অন্যদের মান-অভিমান হত। তাবলে তো ওদের না খাইয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় না। যাত্রাপার্টিদের জন্য তো রান্না হচ্ছেই , ওই সঙ্গে ওদের জন্যও রান্না করে নেব ঠিক করেছি।ক্লাবের পুকুরে মাছ ধরতে পাঠিয়েছি অজিত ধীবরকে। 



                  জীতেন কাকার বিবেচনা বোধ মুগ্ধ করে প্রিয়কে। সে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে -- খুব ভালো হয়েছে। ওই সঙ্গে পুলিশগুলোর জন্যও চাট্টি খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলেও ভালো হত। ওদেরও সেই যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকতে হবে।
---- ও শালাদের না খাওয়ানোই ভাল। ব্যাটারা তো আমাদের যাত্রা বন্ধ করতে এসেছিল। নেহাৎ সাংবাদিকরা সময় মতো এসে পড়েছিলেন তাই রক্ষে। 
প্রিয় দেখে জীতেনকাকার মতো নির্বিবাদী মানুষও পুলিশের ভুমিকায় ক্ষোভে ফুঁসছেন। আসলে পুলিশের আচরণে অধিকাংশ সাধারণ মানুষই ক্ষুব্ধ। কারণ পুলিশ তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষকে গালাগালি না দিয়ে কথা বলতে পারে না। সাধারণ মানুষও সুযোগ পেলে পরোক্ষে পুলিশকে গালাগালি দিয়ে মনে মনে একধরণের  সুখ পায়। তাই পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দুরত্বও ঘোচে না। জনসংযোগের জন্য তাই পুলিশ যতই  রক্তদান শিবির কিম্বা ফুটবল খেলার আয়োজন করুক না কেন  আজও তারা সাধারণ মানুষের বন্ধু হতে পারে নি।জীতেনকাকাও তো সেইসব সাধারণ মানুষদেরই একজন। সে'ও তো আজই পুলিশের কাছে সেই ব্যবহারই পেয়েছে। তবু সেই অপমান সে মনে রাখতে চাই না। যে কারণেই হোক না কেন পুলিশ তাদের  গ্রামে এসেছে। আজ তারা অতিথির সমান। তাই সে বলে ,  সে যাই হোক। ওরা ওদের কাজ করেছে। কিন্তু আমাদের যাত্রার জন্যই তো ওদের শেষ পর্যন্ত থাকতে হচ্ছে। তাহলে ওদের জন্যও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা না হলে যে আমাদের গাঁয়েরই বদনাম হবে।
--- জানি গো জানি। সেই কথা ভেবেই তো ওদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে। আসলে রাগের মাথায় কথাটা বলে ফেললাম।
জবাবে প্রিয়র আর কিছু বলা হয় না। প্রশান্তকাকা এসে তাড়া লাগান -- চলো চলো সবার মেক আপ হয়ে গিয়েছে।এখুনি প্রথম ঘন্টা দেবে। মেকআপ ম্যানরা বসে আছেন। তুমি মেকআপটা করে নিলেই ওরা একটু নিশ্চিন্ত হতে পারে। অগত্যা মেক আপ নিতে বসে প্রিয়। তার মেক আপ শেষ হতে না হতেই ব্যাপক হাততালির মধ্যে যাত্রা শুরু হয়ে যায়। প্রথম দৃশ্যেই জমে উঠে যাত্রা। তৃতীয় সিনে স্টেজে উঠেই দর্শকাসনে বসে থাকা স্বাতীর  সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় প্রিয়র। সে দেখতে পায় স্বাতীও তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। স্বাতীর কাছে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য সে অভিনয় মন প্রাণ ঢেলে দেয়। তারপর যতবারই মঞ্চে উঠেছে চোখ চলে গিয়েছে সেই নিদ্দিষ্ট জায়গাটিতে। শুধু একাই কি প্রিয় ? স্বাতীও তো চোখ ফেরাতে পারে না। পাজামা - পাঞ্জাবীতে নিজের প্রেমিক পুরুষটি তার স্বপ্নের সওদাগর মনে হচ্ছে। কিন্তু চতুর্থ দৃশ্যে সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ওই দৃশ্যে নায়িকাকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়র চুম্বন দৃশ্য দেখে খুব রাগ হয় তার। কি দরকার ছিল মেয়েটাকে ওইভাবে জড়িয়ে ধরার ? ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাতেই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল ? রেগে রেগে সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাশে বসে ননদের মনের ভাব পড়তে কোন অসুবিধা হয় না মধুরিমার। সে স্বাতীর কানে কানে বলে  -- ওলো অত হিংসার কিছু নেই। ভয়ও নেই ,  ও তোর সতীন হওয়ার জন্য বসে থাকবে না। কাল সকালে গরুর গাড়ি করে ওদের লাভপুরে দিয়ে আসবে দাদারা। তোমার কালো সোনা তোমারই থাকবে।
বৌদির কথার মৃদু প্রতিবাদ করে স্বাতী বলে,  ও কিন্তু মোটেই কাল নয়। বরং তোমার বরের চেয়ে অনেক পরিস্কার।
---- ভালো রে ভালো। আমার বরটা কে শুনি ? 
বৌদির রসালাপে ননদের মনের গুমোট ভাবটা কেটে যায়। একদশ দৃশ্যে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে স্বাতী। 


                       
                         পরের দৃশ্য শুরু হওয়ার আগে মাইকে ঘোষণা হয় -- যাত্রার এই অংশটি সংযোজন করেছেন আমাদের গ্রামেরই ছেলে দেবপ্রিয়। আমাদের সবার প্রিয় -- প্রিয়। 
ঘোষণাটি শেষ হওয়ার পর প্রবল হাততালিতে ফেটে পড়েন দর্শকরা। হাত তালি দিয়ে ওঠে স্বাতী। তাকে ওইভাবে হাততালি দিতে দেখে মুখ টিপে হাসে মধুরিমা। তারপর ননদের গায়ে চিমটি কেটে বলে -- খুব হয়েছে। ওরে সবাই থেমে গ্যাছে।এবার হাততালি থামা। নাহলে সবাই যাত্রা ছেড়ে তোকেই দেখতে শুরু করবে। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয় স্বাতী। গভীর আগ্রহ নিয়ে মঞ্চের দিকে চেয়ে থাকে সে। শুধু সে'ই নয় ,  সবারই চোখ ওই দৃশ্যে আটকে যায়। প্রিয় তার লেখায় ভুল চিকিৎসায় সুবল কাকার সেই ছোট্ট ছেলেটার মৃত্যুর ঘটনাটা তুলে ধরে।  দু-হাতে ছেলেটিকে তুলে নিয়ে প্রিয় মন্ত্রীরকে  বলে ---- বাবুমশাই , আমরা গ্রামের গরীব গুর্বো মানুষ। আমাদের জীবনের দাম তো কুকুর বেড়ালের সমান। কিন্তু কুকুর - বেড়ালদের কত কষ্ট করে সন্তান লালন-পালন করতে হয় জানেন ? আজ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলতে এসেছেন ? টাকা দিয়ে কি মায়ের শুন্য কোল ভরিয়ে দিতে পারবেন ? ক্ষতিপূরণ নয় বাবুমশাই , মায়ের কোলে সন্তানকে ফিরিয়ে দিন, দিন বাবুমশাই ফিরিয়ে দিন।
সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাধর বাবাজী গেয়ে ওঠেন -----

হারিয়ে গ্যাছে খোকন সোনা , তাই  কেঁদে বেড়ায় মা।
চোখের জলে বুক ভেসে যায় , তবু  খোকন ফেরে না।
ফিরবে খোকন স্নেহের টানে। 
 মা চেয়ে রয় পথের পানে। 
আশায় আশায় দিন কেটে যায় , তবু খোকন ফেরে না।

গান শেষ হওয়ার পর দর্শকরা  যেন নিথর হয়ে যায়। সবাই শোকে কাতর হয়ে পড়ে। একসময় স্টেজে উঠে যেতে দেখা যায় ডাক্তারবাবুকে। মাইক্রোফোন হাতে তিনি বলেন -- আমি আপ্লুত, আমি অভিভুত। মর্মস্পর্শী সত্যি ঘটনা মুন্সীয়ানার তুলে ধরার জন্য প্রিয় এবং গায়ককে ১০ টাকা করে পুরস্কার দিচ্ছি। বলে সেফটিপিন দিয়ে দু'জনের পোশাকে দুটি ১০ টাকার নোট গেঁথে দেন তিনি।  হাততালি দিয়ে দর্শকরা তাদের অভিনন্দিত করেন। তারপরও প্রিয় সহ আরও কয়েকজনকে ওইভাবে পুরস্কৃত করেন বিভিন্ন জন।পুরস্কার পেয়ে আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন অভিনেতা- অভিনেত্রীরা। গ্রামের যাত্রায় এই পুরস্কার মুল্য অনেক। টাকার অঙ্ক বড়ো কথা নয় , দর্শকের ভালোবাসার স্বীকৃতি মেলে ওই পুরস্কারে। অনেকেই তাই হাজার অনটনেও পুরস্কারে পাওয়া টাকাটা খরচ করেন না। সুতো দিয়ে বছরের পর বছর পেরেকে ঝুলিয়ে রাখেন। প্রিয়ও তার জীবনে পাওয়া এই পুরস্কার সযত্নে তুলে রাখবে। নির্ধারিত সময়েই নির্বিঘ্নে যাত্রা শেষ হয়। তারপর ডাক্তারবাবু আর সাংবাদিকরা ফিরে যাওয়ার উপক্রম করতেই সবাই গিয়ে হাত জোড় করে বলেন -- একটা অনুরোধ রাখতেই হবে। খাওয়া-দাওয়ার সামান্য আয়োজন করেছি। আপনাদের পাশে একাসনে বসে আমাদের চাট্টি খাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। 
ডাক্তারবাবু বলেন --- বাহ: কথাটা খুব সুন্দর করে বললেন তো। এমন সুন্দর করে যারা বলতে পারেন তাদের পাশে একাসনে বসে খাওয়ার সুযোগ তো হাতছাড়া করা যায় না। 
একই ভাবে বড়বাবু এবং অন্যান্য পুলিশ কর্মীদেরও অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু বড়বাবু ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে পুলিশ কর্মীদের নিয়ে চলে যান। বড়বাবু যে রেগে আছেন তা বুঝতে প্রিয়দের অসুবিধা হয় না। আসলে তো সদিচ্ছা থেকে নয় , নিজেদের কথার জালে উল্টো চাপে পড়েই যে তারা থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন তা ওদের এই আচরণ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। সুযোগ পেলে পুলিশ এর শোধ তুলতে ছাড়বে না তা ভালোই জানে প্রিয়। কিন্তু তা নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা করে এই মুহুর্তের আনন্দটা মাটি করতে চাই না সে। সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে মাচানতলায় খেতে বসে তারা। খেতে খেতেই সাংবাদিকদের সঙ্গে অনশন নিয়ে একপ্রস্থ আলোচনা সেরে নেয়। ঠিক হয় অনশনের দিন যথাসময়ে সাংবাদিকরা বি,ডি,ও অফিসে পৌঁচ্ছে যাবেন। খাওয়া-দাওয়ার পর প্রিয়রা এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারবাবুদের গাড়িতে তুলে দেন। প্রিয় বলে , আপনারা আসায় গোটা গ্রামের মানুষ খুব খুশী হয়েছেন। এরকম ভাবেই আমরা আপনাদের সব সময় পাশে পেতে চাই। 
ডাক্তারবাবুরাও সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলেন , আপনাদের আন্তরিকতা আমাদের বার বার এইগ্রামে টেনে আনবে।



  ( ক্রমশ ) 




নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



No comments:

Post a Comment