Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

অন্তরালে -- ৩৭



    
  অন্তরালে 


   অর্ঘ্য ঘোষ 



( ধারাবাহিক উপন্যাস ) 



আস্তে আস্তে গ্রাম ছেড়ে যায় ডাক্তারবাবুদের গাড়ি। প্রিয়রা যাত্রার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা জিনিসপত্রগুলো এক জায়গায় গুটিয়ে রাখতে শুরু করে। সব কিছু গোটাগুটি করতেই রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে। রাত পোহালেই অনেক কাজ। যাত্রাপার্টির লোকেদের লাভপুরে পৌঁচ্ছে দিয়ে আসতে হবে। স্টেজ তৈরির জন্য তক্তা - কাপড় সহ যার বাড়ি থেকে যা নিয়ে আসা হয়েছিল, তা ফেরত দিয়ে আসা আছে। ওইসব জিনিসপত্র নিয়ে আসার সময় উদ্যোক্তাদের যে উৎসাহ দেখা যায় , ফেরত দিয়ে আসার সময় সাধারণ সেটা দেখা যায় না।উদ্যোক্তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হয়।উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার মন খারাপ আর রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিই ওই ব্যাপারে উৎসাহহীনতার অন্যতম কারণ। তবে কারও কারও ফাঁকিবাজির মানসিকতাও থাকে।আন্দোলনের সুবাদে এবারে অবশ্য সেই আশঙ্কা নেই। জীতেনকাকা তবুও সবাইকে সাবধান করে দেন --রাত পোহালেই তো হাজারও কাজের ঝক্কি আছে। অনশনের প্রস্তুতিরও ব্যাপার আছে। এই ফাঁকে সবাই একবার করে বাড়ি ঘুরে আসতে চাইলে যেতে পার। কিন্তু বিছানায় আজ আর গা গড়ানো চলবে না। তাহলেই আর কেউ উঠতে পারবে না। আমি গরুর গাড়ি নিয়ে ফিরে আসার আগেই অন্য সবাইকেও চলে আসতে হবে কিন্তু।
সেইমতো সবাই বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। যাত্রা দেখে ফিরে গ্রাম তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে প্রিয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে যায়। প্রিয় দেখে দরজার ওপারে যেন ভোরের আকাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বাতী। সে স্বাতীর উদ্দেশ্য হাওয়ায় একটা চুমু উড়িয়ে দেয়। সেটা লক্ষ্য করে দ্রুত মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ায় স্বাতী। তার আচরণে বিস্মিত হয়ে যায় প্রিয়। ওইভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না সে। তার মনে হয় মা কিম্বা মধুরিমারা কেউ দেখে ফেলবে বলেই বোধহয় এমনটা করল স্বাতী। কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকেই সেই ভুল ভাঙে তার। দেখতে পায় শেষ রাতে যাত্রা দেখে ফিরে তখনও ঘুম থেকে উঠে নি কেউ। অথচ স্বাতী ঘুমোয় নি। তার ফেরার প্রতীক্ষাতেই কি তাহলে সে জেগে ছিল ? তাহলে ওইরকম মুখভঙ্গি করল কেন ?  কারণটা কি জানতে না পারা পর্যন্ত মনে স্বস্তি পায় না সে। স্বাতীকে একটু একা পাওয়া দরকার। এই সময়ই তাকে একা পাওয়ার উপযুক্ত সময়। কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগেই একান্তে একবার স্বাতীকে পাওয়া দরকার। সেই উদ্দেশ্যে সে বলে - এখনই আবার বেরিয়ে যেতে হবে। একটু চা পাওয়া যাবে কি ?
---- সেই বিকালে বেরিয়ে এই তো ফেরা হল বাবুর। আবার কি রাজকাজ আছে শুনি ? এরপর অসুখ-বিসুখ একটা কিছু হলে কি হবে ? 
---- ভালোই হবে। সেবা করার জন্য তো একজন এখন এখানেই আছে। শুয়ে শুয়ে তার সেবা নেব।
---- বয়ে গিয়েছে আমার কারও সেবা করতে।
ভেংচি কেটে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় স্বাতী। আর সে স্নান করার জন্য স্নানঘরে গিয়ে ঢোকে। স্নানটান করে পোশাক পড়তে পড়তেই চা নিয়ে ঘরে ঢোকে স্বাতী। চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই প্রিয় এগিয়ে গিয়ে তার পাওয়া পুরস্কারের টাকাটা সুতো দিয়ে বেঁধে স্বাতীর গলায় পড়িয়ে দেয়। স্বাতী তার মুখের দিকে চাইতেই সে  মৃদু সুরে গেয়ে ওঠে --- ' হার মানা হার পরাব তোমার গলে।'দুই হাত ধরে স্বাতীকে  কাছে টেনে নেয়। স্বাতীও বাধা দিতে পারে না। প্রিয়র বক্ষলগ্না হয়ে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। আর তার চোখের পাতায় , কপালে প্রিয় একে দেয় চুম্বনের আলপনা।  তার মুখটা তুলে ধরে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। স্বাতীর আবেশে ভরা চাউনিতে আটকে যায় প্রিয়র  চোখ। সে স্বাতীর ঠোঁটের কাছে নামিয়ে আনে তার ঠোঁট। স্বাতী দ্রুত তার ঠোঁট সরিয়ে নেয়। অভিমানে তার নাকের পাটায়  মুক্তোদানার মতো ফুটে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিষ্ময়ে স্বাতীর মুখের দিকে চায় প্রিয়। 
স্বাতী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে , না তুমি তো ওই ঠোঁট দিয়ে তোমার নায়িকাকে চুমু খেয়েছো। তাই আমি আর আমার ঠোঁটে তোমাকে ঠোঁট ছোঁওয়াতে দেব না।
স্বাতীর কথা শুনে হেসে ওঠে প্রিয়। ফের স্বাতীর মুখটা তুলে ধরে বলে , এতক্ষণে মানিনীর অভিমানের কারণটা বুঝলাম।পাগলি মেয়ে একটা। আরে কাল ছিল চুমুর অভিনয়। ঠোঁটে ঠোঁটও ঠেকে নি। আর আমার নায়িকা তো তুমিই। 


                                             ফের স্বাতীর ঠোঁটের সামনে তুলে ধরে তার চুম্বন পিয়াসী ঠোঁট। স্বাতী সেই ঠোঁটে তীব্র আশ্লেষে মিশিয়ে দেয় তার ঠোঁট। তারপর পিছন ফিরে চেয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ছুটে পালায়। স্বাতীর এই ভঙ্গিমাটা ছবির মতো লাগে প্রিয়র।ছবিটা দেখতে দেখতে সে সদর দরজা পার হতে যাবে এমন সময় ভেংচি কেটে দিয়ে ভিতরের দিকে চলে যায় স্বাতী, স্বাতীর স্পর্শানুভুতিতে প্রিয়র রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি যেন এক নিমেষে দূর হয়ে যায়। ফুরফুরে মনে মাচানতলায় পৌঁছোয় সে। তারই মধ্যে জীতেনকাকা গোরুর গাড়ি নিয়ে এসে পোশাকের বাক্স পেটরা , বাদ্যযন্ত্র সব বাঁধাছাদা  করে ফেলেছেন। অন্য একটা গাড়িতে মহিলা শিল্পী , যন্ত্রীরা সব উঠে বসেছেন। ঋজুর কাছে চুক্তির টাকাটা নেওয়ার পর ম্যানেজারবাবুও বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেন। প্রিয়রাও এগিয়ে তাদের বিদায় সম্ভাষণ জানায়। ক্যাচোর কোঁচর শব্দ তুলে রাঙা মাটির পথ ধরে গ্রাম ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় গাড়ি। বাকিরা নেমে পড়েন কাজে।কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি অন্যান্য জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়ে আসা শুরু করে দেয়। কেউ অনশনে যাওয়া বাচ্চাদের খাবার তৈরির জন্য যোগাড়পাতি শুরু করে।প্রিয়রাও রিক্সা মাইক নিয়ে অনশনের প্রচারের প্রস্তুতি নেয়। সেই সময় আচমকা প্রসাদ মোড়লের খামারবাড়িতে বেজে ওঠে মাইক। প্রিয়রা দেখতে পায় প্রসাদ মোড়লের ভাই আর একটি ছেলে তাদেরই মতো রিক্সায় প্রচার মাইক বেঁধে এগিয়ে আসছে। প্রিয়রা ভাবে , ওরাও পঞ্চরসের প্রচার করতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা শুনতে পায় প্রসাদ মোড়লের ভাই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলছে --- একটি বিশেষ ঘোষণা। মন দিয়ে শুনবেন। আজ মনোহরপুর গ্রামে যে পঞ্চরস গানের আয়োজন করা হয়েছিল , অনিবার্য কারণ বশত তা বাতিল করা হয়েছে। এজন্য আমরা দুঃখিত।
ওদের রিক্সাটা মাচানতলা ছাড়িয়ে যেতেই প্রশান্তকাকা বলে ওঠেন --- আচ্ছা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রসাদ মোড়লকে কিল খেয়ে কিল হজম করতে হল।
অশ্বিনীকাকা বলেন , যা বলেছো। এবারে তো স্পষ্ট হয়ে গেল আমাদের যাত্রায় বিঘ্ন ঘটাতেই ও পঞ্চরসের বায়না করেছিল। কিন্তু সেটা করতে না পেরে অনিবার্য কারণের অজুহাত দেখিয়ে পঞ্চরস গান বাতিল করে দিল। আরে অনিবার্য কারণটা যে কি তা আর আমাদের বুঝতে বাকি নেই।
প্রশান্ত কাকা বলেন , আমি তো তখনই বলেছিলাম। ব্যাটা যা চশমখোর , কুঅভিপ্রায় না থাকলে টাকা - পয়সা খরচ করে পঞ্চরস করাতে যাবে না। সেই পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাওয়ায় দেখছে শুধু শুধু  টাকাপয়সা খরচ করাই হবে। তাই বাতিল করে দিল। সে ওর ব্যাপার ও বুঝবে। আমাদের প্রচার শুরু করে দাও।
সেই মতো প্রিয় আর ঋজু বেড়িয়ে পড়ে প্রচার মাইক নিয়ে। প্রচার সেরে বাড়ি ফিরতে তাদের দুপুর গড়িয়ে যায়। দ্রুত খাওয়া দাওয়া সেরে একটু গা গড়িয়ে নেবে মনে করে প্রিয়। টানা কয়েকদিনের ধকলে শরীর যেন আর বইছে না। চোখ টানছে , কিন্তু আলস্যেরও অবকাশ নেই। রাত পোহালেই অনশন কর্মসূচি। নানান কাজ রয়েছে। সেইজন্য প্রথম সন্ধ্যাতেই মাচানতলায় মিটিং ডাকা হয়েছে। সব কাজ সেরে আজও বাড়ি ফিরতে কত রাত হবে কে জানে। তাই প্রিয় গা'টা একটু গড়িয়ে নেওয়ার জন্য নিজের ঘরে যায়। কিন্তু বিছানায় আর গা গড়ানো হয় না তার।মধুরিমা তাকে নিয়ে পড়ে।স্বাতীকে নিয়ে তার ঘরে আসে মধুরিমা। তারপর দাদার দিকে চেয়ে বলে , তুই তো বেশ ছেলে। কোন ফাঁকে চুপি চুপি এসে মানভঞ্জনের পালাটা সেরে গিয়েছিস টের পেলাম না। তবে যাই বলিস না কেন দাদা , কাল কিন্তু তোর সঙ্গে মেয়েটাকে খুব সুন্দর মানিয়েছিল। ওই রকমটি আর কাউকে দেখলাম না।
তাকে রাগানোর জন্যই যে বৌদি ওই কথা বলছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না স্বাতীর। তবু মুখ ফসকে সে বলে ফেলে , বৌদি তুমি এর মধ্যে আমাকে টানবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি।
---- ওই দেখ আমি আবার কখন তোকে টানাটানি করতে গেলাম। একেই বলে--- ' পড়ল কথা সবার মাঝে ।যার কথা তার গায়ে বাজে।' বেশ বাবা আমার আর টানাটানিতে কাজ নেই যে সারপ্রাইজের কথাটা বলতে এসেছিলাম সেটাই বরং বলে ফেলি।
বোনের কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকায় প্রিয়। আর তা দেখে মধুরিমা বলে , মুখ দেখে মনে হচ্ছে কথাটা শোনার জন্য দুজনেরই যেন তর সইছে না। বেশ তাহলে বলেই ফেলি। আমার শাশুড়িমাতা এবারই বাড়িতে জামাই ষষ্ঠী করতে চান। 
কিছু না বুঝেই প্রিয় বলে , সে তো খুব ভালো কথা। পেট পুরে খেয়ে আসা হবে।
--- তা তো বলবেই। তুমি যে দিনকে দিন এত বেহায়া -- কান কাটা হয়েছো তা তো জানতাম না।  
---- মানে ?
---- মানে আমার শাশুড়ি মায়ের তো একটাই মেয়ে।  জামাই ষষ্ঠী করতে হলে তারই বিয়ে দিতে হয়। তারা আবার তোমাকেই জামাই বাবাজীবন করবেন বলে বসে আছেন। সেটা তো তোমার অজানা নয়। তাই বলছি নিজের বিয়ের কথা শুনে এমন আহ্লাদ প্রকাশ করাটা তো ------। 
কথাটা আর শেষ করে না মধুরিমা। মেয়েটা ছোট থেকেই এইরকম। এমনিতে দাদা বলে ,  কিন্তু পিঠোপিঠি বলে পিছনে লাগতে ছাড়ে না। আর পিছনে লাগার সময় তুই থেকে মাঝে মধ্যে তুমিতে উঠে যায়। নিজের কথার জালে জড়িয়ে লজ্জায় প্রিয়ও কিছু বলতে পারে না।
মধুরিমাই বলে , ঠিক আছে তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। বাবা-মাকে বলে একেবারে তোমাদের চার হাত এক করে দেওয়ার কথা ফাইন্যাল করে দিয়েই যাব।
ননদকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মধুরিমা। যাওয়ার সময় স্বাতীও দিয়ে যায় আরও একটা সারপ্রাইজ।


       ( ক্রমশ ) 





নজর রাখুন / সঙ্গে থাকুন 


শীঘ্রই দেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে আমার তৃতীয় উপন্যাস ------
  
                                  


                       ----০---



No comments:

Post a Comment