চীনের সঙ্গে লড়াইয়ে বীরভূমের রাজেশ ওঁড়াং সহ যেসব সেনাবাহিনীর জওয়ান শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই অংশটি নিবেদিত হলো --
( কিস্তি --- ৭৮ )
কিন্তু প্রতিনিধিদলের পরবর্তী পদক্ষেপে তার মুখে ঘনিয়ে আসে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া।কিছুক্ষণের মধ্যেই খাতাগুলো ফিরিয়ে নেওয়া হয়।সেগুলোতে চোখ বুলিয়ে সুপ্রিয়বাবু বলেন , দেখা যাচ্ছে শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে এগিয়ে থাকা প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষায় অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছেন চাকরি পাওয়া প্রার্থীরা।স্বভাবতই তাদেরই চাকরি পাওয়ার কথা।বাঞ্ছারামবাবুও বলেছেন সেইজন্যই তারা চাকরি পেয়েছেন। তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার তেমন কিছু মূল্য নেই। আর শিক্ষাগত যোগ্যতার যথার্থতা যাচাই করার সুযোগও নেই।কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় সেই সুযোগ আমাদের রয়েছে।মাস দুয়েক আগে যে প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হয়েছিল সেই প্রশ্নপত্রেই আবার একবার পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। দু' মাস আগে যারা নিজে হাতে পরীক্ষা দিয়ে যে নম্বর পেয়েছেন আশা করা যায় আজও তারা সেই নম্বরই পাবেন। কি বাঞ্ছারামবাবু তাই তো ?
উত্তর দেবেন কি, প্রশ্নটা শুনে মুখটা যেন ঝুলে যায় তার। একই অবস্থা হয় চাকরি পাওয়া প্রার্থীদেরও। এত বড়ো বিপদের সম্মুখীন হওয়ার কথা তারা স্বপ্নেও ভাবেন নি।অন্যদিকে চাকরি না পাওয়া প্রার্থীরা তখন যেন উৎসাহের আঁচে ফুটছেন।এতদিন তো তারা এই চ্যালেঞ্জই জানিয়ে আসছিলেন।চাকরি পাওয়ার চাইতে অযোগ্যতার গ্লানি তাদের মানসিক অবসাদগ্রস্থ করে তুলেছিল। সূর্যের অবশ্য কোন হেলদোলই নেই। সে নির্বিকারের মতো প্রশ্নপত্র নিয়ে উত্তর লিখে জমা দেয়।
সেইদিনই স্কুলের শিক্ষকমশাই এবং প্রতিনিধিদলের সদস্যরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খাতা দেখে নম্বর অনুযায়ী ক্রমতালিকা তৈরি করে ফেলেন।সেই তালিকা দেখে তারাই ' থ ' হয়ে যান।দেখা যায় চাকরি পাওয়া প্রার্থীরা ডাহা ফেল। আর তালিকার প্রথমদিকে রয়েছে চাকরি না পাওয়া প্রার্থীরা।শীর্ষে রয়েছে সূর্যের নাম।হলের ভিতরে তখন একদিকে চাপা হাহাকার অন্যদিকে উচ্ছাস।তারই মাঝে মুখ খোলেন সুপ্রিয়বাবু। বাঞ্ছারামবাবুর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন , কি চেয়ারম্যান সাহেব এবার কি বলবেন ? পরীক্ষার নামে কি হয়েছে তা আপনিও ভালোই জানেন। আমরাও জানলাম। আমরা আমাদের রিপোর্ট আদালতকে জানাবো।আদালত যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে।আপতত আপনি আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী অযোগ্যদের বরখাস্ত করে যোগ্যদের নিয়োগপত্র দিন।
ল্যাজেগোবরে অবস্থার মধ্যেও বাঞ্ছারামবাবু বলে উঠেন -- দলের নির্দেশ ছাড়া আমি কিছু করতে পারব না।
আর যায় কোথায় ? কড়া মেজাজে সুপ্রিয়বাবু ধমকে ওঠেন , রাখুন মশাই আপনার দলের নির্দেশ। আগে কোর্টের নির্দেশ মানুন।নাহলে পুলিশ ডেকে আপনাকে শ্রীঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।তখন জেলের ভিতরে যত পারেন দলের নির্দেশ পালন করবেন।সুপ্রিয়বাবুর দাবড়ানি খেয়ে কেমন যেন ভড়কে যান বাঞ্ছারামবাবু। নির্দেশ পালন করার জন্য তিনি সবে পকেট থেকে পেন বের করেছেন আর পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে হলঘরের সামনে হামলে পড়ে জনতা।তারা দাবি তোলেন যা হবে সবাইকে জানিয়ে হোক।আমরাও জানতে চায় আসল ঘটনা। অগত্যা সেই দাবি মেনেই খোলা স্কুল চত্বরেই চেয়ার টেবিল সাজিয়ে ফেলা হয়।ততক্ষণে অত্যুৎসাহী কয়েকজন মাইক ফিট করে ফেলেছেন গাছের ডালে। মাইক্রোফোনটা সুপ্রিয়বাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে তারা বলেন - প্লিজ স্যার, মাইকে বলুন তাহলে পিছনে যারা আছেন তারাও শুনতে পাবেন।
সেই অনুরোধ মেনেই সুপ্রিয়বাবু বলতে শুরু করেন -- আদালতের নির্দেশ মেনেই আজ আমরা পুরনো প্রশ্নপত্রেই ফের পরীক্ষা নিয়েছিলাম।কিন্তু দেখা গেল চাকরি পাওয়া পঞ্চান্ন প্রার্থীর মধ্যে একজনও কোয়ালিফাইই করতে পারে নি। বাদ পড়া প্রার্থীরাই যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন যার জন্য এই রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে সেই সূর্য।
সুপ্রিয়বাবুর কথা শেষ হয় না। উচ্ছাসে ফেটে পড়ে জনতা। সূর্যর নামে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠেন তারা -- সূর্য তুমি গ্রামের গর্ব / তোমার সম্মান হবে নাকো খর্ব।
বাইরে দাঁড়িয়ে সেই শ্লোগান শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সুস্মিতা আর মনোতোষের।আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় তাদের চোখ। মেয়ের হাত ধরে মনোতোষ বলেন -- এমনটা যে হবে তা আমি জানতাম।
সুস্মিতা বলে , বাবা দাদাকে তো তাহলে চাকরি দেবে ওরা। আর দাদাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না বলো ?
মনোতোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু বলা হয় না তার। সেই সময় ফের মাইকে ভেসে ওঠে সুপ্রিয়বাবুর গলা -- তাই আদালতের নির্দেশে যারা অবৈধভাবে চাকরি পেয়েছিলেন আজই তাদের নিয়োগ বাতিল করে ক্রমানুসারে যোগ্যজনদের নিয়োগপত্র দেওয়া হচ্ছে।
ঘোষণা শেষ হতেই ফের ব্যাপক হাততালিতে ফেটে পড়ে জনতা। কোথা থেকে আবীর এনে অকাল হোলি খেলায় মেতে উঠেন তারা। তাদের উচ্ছাস দেখে রাজনৈতিক নেতা এবং নিয়োগপত্র বাতিল হয়ে শিক্ষকদের পরিবারের লোকেরা গুটি গুটি পায়ে বাড়ির পথ ধরেন। কেউ কেউ --ওরে পালাচ্ছে পালাচ্ছে , ধর ধর বলে পিছু ধাওয়া করে।ওরা প্রাণপণ ছুটে পালিয়ে বাঁচেন।তখন সমানে মাইকে নাম ঘোষণা করে একে একে যোগ্যদের ডেকে নেওয়া হচ্ছে।বাঞ্ছারামবাবু সই করে তাদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিচ্ছেন। সব শেষে ডাকা হয় সূর্যকে। তার হাতে নিয়োপত্র তুলে দেওয়ার পর সুপ্রিয়বাবু বলেন , তোমার লড়াই সার্থক হল। তোমার জন্যই আজ এতগুলো বেকার ছেলের যোগ্যতার প্রকৃত মূল্যায়ন হল।তাই আমি চাই তুমি কিছু বল।
বলেই সুপ্রিয়বাবু মাইক্রোফোনটা তার মুখের সামনে ধরেন। আর সুর্য আচমকা নিয়োগপত্রটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলতে শুরু --- দুর্নীতিগ্রস্থ এই সরকারের অধীনে আমি চাকরি করতে চাই না। আমার বাবা চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। আমিও প্রত্যাখ্যান করলাম। আমার শুধু প্রমাণ করার ছিল আমি অযোগ্য নই , ধর্মের ষাঁড়ও নই। চাকরির চাইতে একটা বেকারের কাছে নিজেকে প্রমাণ করাটাই বড়ো চ্যালেঞ্জ। এই সমাজে প্রকৃত শিক্ষার কোন দাম নেই।
শিক্ষিতের যোগ্যতা মাপা হয় চাকরি দিয়ে। চাকরি না পেলে এই সমাজ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় , তুমি চাকরি পাও নি তাই তুমি কোন কম্মের নও। তোমার শিক্ষার কোন দাম নেই। কত বেকার অহরহ সেই খোঁচা খেতে খেতে রক্তাক্ত হয়ে যায়। কেউ তার খোঁজও রাখে না। শীতের রাত, মশার কামড় , আমোদ প্রমোদের হাতছানি উপেক্ষা করে পড়াশোনার পর ভালো রেজাল্ট করা ছেলেটির কোন মুল্যই থাকে না সমাজে। আর
ছাত্রজীবনে বাবার টাকায় কাপ্তানি করে বেড়ানো ছেলেরা স্রেফ বাবার টাকায় চাকরি পেয়ে মহামুল্যবান হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষিত তৈরি করে দিয়েছে সরকার। তাই আমি সেই সরকারের দাসত্ব করতে পারব না। প্লিজ , ক্ষমা করবেন আমাকে।
বলেই ছুটে গিয়ে স্থান কাল ভুলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে সূর্য।মনোতোষও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভিজিয়ে ফেলেন দু চোখের কোল। দাদাকে জড়িয়ে ধরে কান্না সামলাতে পারে না সুস্মিতাও। মনোতোষ ছেলের মুখটা তুলে ধরে বলেন -- কাঁদছিস কেন বাবা ? চেয়ে দেখ তোর জন্যই আজ কত বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটেছে। বাবা হয়ে গর্বে যে আমার বুকটা ভরে যাচ্ছে রে বাবা।
---- বাবা আমি প্রমাণ করে দিয়েছি আমি যোগ্য। আর আমার কোন আক্ষেপ নেই। আর কেউ তোমাকে বলতে পারবে না মাস্টার তোমার ছেলেটা ধর্মের ষাঁড় , অর্কমার ঢেঁকি। তোমার মতোই ওদের দেওয়া চাকরি আমি প্রত্যাখ্যান করেছি বাবা। ঠিক করি নি বলো ?
ছেলের কথা শুনে গলা বুজে আসে মনোতোষের। অবরুদ্ধ গলায় কোন রকমে বলতে পারেন -- তুই তো দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করলি বাবা। আমিও মনে মনে চাইছিলাম যারা অন্যায় ভাবে তোকে প্রাপ্য চাকরি দেয় নি তাদের দেওয়া চাকরি তুই ফিরিয়ে দিবি। তুই সেটা করে দেখিয়ে দিলি। ক'জন পারে এমন করতে ?
চোখ মুছে মুখ তুলে চাইতেই সূর্য দেখতে পায় অদুরে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে রজত আর শ্রাবন্তী। তার খুব খারাপ লাগে। সে তো কারও খারাপ চাই নি। তাই শ্রাবন্তীর মুখটা দেখে ক্ষনিকের জন্য হলেও তার মনটা বিষন্ন হয়ে পড়ে। একদিন তো ওই মেয়েটাকেই সে ভালোবেসেছিল। ভালোবাসার জনের ক্ষতি প্রকৃত ভালো যে বেসেছে সে কোন দিনই চাইতে পারে না।কিন্তু এক্ষেত্রে তার চাওয়া না চাওয়ার উপর তো কিছুই নির্ভর করে না। সম্ভব হলে শ্রাবন্তীর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তার প্রত্যাখ্যান করা চাকরিটা সে রজতকে ফিরিয়ে দিত। রজত সেদিন তাকে চড় মারলেও শ্রাবুন্তীর জন্য সে সব ভুলে সেটাই করত। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষের সমবেত আবেগ আর উচ্ছাসে চাপা পড়ে যায় তার বিষণ্ণতা। একসময় তাদের গোল করে ঘিরে ধরে হোলি খেলায় মেতে ওঠেন তারা।
ওইভাবে আবীর মেখে ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন মনোতোষ। ছন্দা এগিয়ে এসে বাপ ছেলের গলায় দুটো মালা পড়িয়ে দেন। উচ্ছস্বিত জনতা আনন্দে ফেটে পড়ে।মনোতোষ আর সূর্যর নামে মুহ মুহ জয়ধ্বনি দেন তারা।অনেক রাত্রি পর্যন্ত উৎসবের মেজাজে কাটান গ্রামের মানুষ। পরদিন সকাল থেকেই শিশুদের আনন্দগানে মুখরিত হয়ে উঠে আনন্দ পাঠশালা। কচি কচি হাত ধরে এগিয়ে আসে অনেক হাত। সেই সব হাতে হাত রেখে কালের কারিগররা শুরু করেন মানুষ গড়ার কাজ। মানুষের বড়ো অভাব আজ।
( সম্পূর্ণ )
No comments:
Post a Comment