শহিদের মা
অর্ঘ্য ঘোষ
( ১ )
বিড়িতে সুতো জড়াতে জড়াতে কয়েক ফোঁটা চোখের জল কুলোর মশলার উপরে পড়তেই সম্বিত ফেরে শহিদের মায়ের। শহিদের মা ! কথাটা আজ কেমন যেন বিদ্রুপের মতো মনে হয় জাহেদার। অথচ কথাটা যখন প্রথম শুনেছিল তখন তার সারা শরীরে কাঁটা ফুটে উঠেছিল। খাড়া হয়ে উঠেছিল প্রতিটি লোমকুপের লোমও। শব্দটার অর্থ সম্পর্কে অবশ্য সম্যক
কোন ধারণা ছিল না তার। কিন্তু মুন্সীদের টিভিতে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান শুনে শব্দটা যে ভালো কিছু একটা বটে সেই ধারণাটুকু গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া অত সব মান্যিগন্যি করা মানুষগুলো যখন বার বার কথাটা বলছিল তখন কথাটাকে বেশ সম্মানজনকই মনে হয়েছিল জাহেদার।দশ বছর আগে শোনা সেই কথাটা আজও যেন কানে বাজে তার।
আচমকা গোলাগুলির শব্দে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় জাহেদার। গোলাগুলি এখন অবশ্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাত নেই , দিন নেই , গুড়ুম - গুড়ুম লেগেই রয়েছে। গ্রামের দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে শাসক দল গণমঞ্চ পার্টি আর প্রধান বিরোধীদল অরুণোদয় পার্টির সংঘর্ষে প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কোন না কোন গ্রাম। এলাকার মানুষজনের সব যেন কেমন গা সহা হয়ে গিয়েছে। তাদের ভয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার। কারণ যে দল যখন গ্রামের দখল নেয় , সেই দলের বিপক্ষের ঘরবাড়ি এমন কি ছাগল-গরুও লুঠপাট হয়ে যায়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঘরবাড়ি। দিনের পর দিন গ্রাম ছাড়া হয়ে যায় মানুষ। তাই গ্রামের মানুষকে সবসময় ঘটনার গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখতে হয়। বিপদ বুঝলে আগেই জিনিসপত্র গুটিয়ে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে হয়। গ্রাম দখলের পর লুঠই হয়ে প্রধান লক্ষ্য। লুঠের মালের একাংশ যারা লুঠ করে তারা পায়। বাকিটা পার্টির তহবিলে জমা পড়ে। তাই দিয়েই নাকি বোমা - বন্দুক , হাত কামান কেনা হয়। এসব এখন গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও জানে। তারাও অন্যান্য খেলা এবং পড়াশোনা ভুলে লাঠি কিম্বা কাঠের চেলাকে কামান- বন্দুক বানিয়ে গ্রাম দখলের খেলায় মেতে ওঠে। ওইসব কচিকাঁচাদের মুখেও শোনা যায় - গুড়ুম - গুড়ুম - গুড়ুম। ওদেরই বা দোষ কি ? দুই পার্টির সংঘর্ষের জন্য শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে স্কুলেই পৌঁচ্ছোতে পারেন না।
দিনের পর দিন স্কুলের দরজা খোলে না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েও স্বস্তি পায় না বাবা- মায়েরা। আসলে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর উলুখাগড়ার মতো ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের প্রাণ।
তা নিয়ে অবশ্য কোন পক্ষেরই কোন মাথাব্যথা নেই। কেউ কাউকে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়তে রাজী নয়। তারজন্যই যত গোলাগুলি , যত হানাহানি। অরুণোদয় পার্টির লোকেরা বলে , দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে থাকতে গণমঞ্চ পার্টির নাকি শিকড় গজিয়ে গিয়েছে। তারা চায় সেই শিকড় আরও পুষ্ট এবং বিস্তৃত হোক। কিন্তু অরুণোদয় পার্টির লোকেরা আর তা হতে দেবে না। সেই শিকড় ঊঁপড়ে ফেলে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় তারা। কিছু মানুষও গোপনে অরুণোদয় পার্টির লোকেদের সঙ্গে গলা মেলায়। অথচ একসময় অধিকাংশ মানুষ গণমঞ্চ পার্টির আজ্ঞাবহ ছিল। এখন দলের নেতাদের দাদাগিরিতে সাধারণ মানুষও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। গণমঞ্চ পার্টির নেতারা এখন সাধারণ মানুষের বাড়ির হেঁসেলেও নাক গলাতে শুরু করেছেন। তাই অনেকেই এখন মনেপ্রাণে তাদের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছেন। মানুষের সেই মনোভাব আঁচ করে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে দেখে অরুণোদয় পার্টির নেতারা। কিন্তু প্রতিবারই তাদের সব হিসাব উল্টে দিয়ে হৈ হৈ করে ভোটে জেতে গণমঞ্চ পার্টি।
অরুণোদয় পার্টির লোকেরা বিস্তর মাথা ঘামিয়েও কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারে না। এত মানুষের এত ক্ষোভ - বিক্ষোভ ভোটবাক্সে কেন প্রতিফলিত হচ্ছে না তা ভেবে পায় না তারা। কিন্তু জাহেদার ততদিনে গণমঞ্চ পার্টির ধারাবাহিক জয়ের তত্ত্ব জানা হয়ে গিয়েছে। সে নিজেই যে তার স্বাক্ষী। প্রতিটি ভোটের আগের দিন রাতে মুকিম মোল্লা
দলবল নিয়ে তাদের পাড়ায় টহল দিয়ে যায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে যায় , ' কাল যেন সবাই তাদের ক্যাম্পে খাওয়া দাওয়া করে ভোট দিতে যায়।
বেচাল হলেই আর বাড়ির চালছপ্পড় থাকবে না। '
মুকিমের ওই কথার দম জানে গ্রামের মানুষ। এর আগেই সে প্রমাণ দিয়েছে মুকিম। ভোট গণনার পর কতজনের যে বাড়ির চালে আগুন লেগেছে তার ঠিক নেই। তাই ওইফরমান অমান্য করার সাধ্যি কি সাধারণ মানুষের ? তাহলে যে শুধু বাড়িই পোড়ে না , বন্ধ হয়ে যায় সরকারি ভাতা , রেশনের চাল-গম সব। এমন কি গ্রামে থাকাটাও দুস্কর হয়ে ওঠে। তাই যারা গণমঞ্চের শিবিরে যেতে পারে না তাদের বেশিরভাগই আর ভোটকেন্দ্র মুখো হয় না। একেবারে নেতা গোছের লোকেরা ছাড়া কেউ অরুণোদয় পার্টির ছায়া মাড়ায় না। বাকিরা সব গণমঞ্চের শিবিরে গিয়ে হাজির হয়। ভোটের দিন কর্মী এবং ভোটারদের খাওয়ানোর জন্য সেখানে থাকে এলাহি আয়োজন। কোনবার মাছ - ভাত , কোনবার আবার মাংস-ভাতের সঙ্গে শেষ পাতে চাটনি মিস্টিও দেওয়া হয়। অরুণোদয় পার্টির লোকেরাও সব জানে। তাই তারা গোপনে বলে দিয়ে যায় , 'ভোট তো মানুষের মনে আর ঘরের কোনে। ওদের কাছে খাওয়া-দাওয়া করে আমাদের ভোট দিলে কে জানতে পারবে ? তাসত্ত্বেও অরুণোদয় পার্টির পক্ষে ভোট পড়ে সেই হাতে গোনা।
অরুণোদয় পার্টির লোকেরা জানতে না পারলেও জাহেদার তো আজ আর জানতে বাকি নেই ভোটারদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকা স্বত্ত্বেও গণমঞ্চ পার্টির ভোটের ঝাঁপি কেন উপছে পড়ে ? কেনই বা হাতে গোনা কিছু ভোট পায় অরুণোদয় পার্টি ? সেবার পঞ্চায়েত ভোটেই তো আসল রহস্যটা জলের মতো পরিস্কার হয়ে গিয়েছে তার কাছে। জাহেদারা সরাসরি কোন দলের সমর্থক নয়। তবু শাসক দলের বিষ নজরে পড়তে চায় না।
তাই পাড়ার অন্যান্য মেয়ে
-বৌদের সঙ্গে ভোট দিতে সকাল সকাল গণমঞ্চ পার্টির শিবিরে পৌঁছেছিল। সেখানে তখন রান্নার তোড়জোড় চলছে। একদিকে কেটলিতে চায়ের জল ফুটছে। ভোটের লাইনে তখন বেশিরভাগই গণমঞ্চ পার্টির লোক। পিছনে সামান্য কয়েকজন অরুণোদয় পার্টির নেতাদের বাড়ির লোক। তাদের দেখে মুকিম এগিয়ে এসে বলে , ' দাঁড়াও সব চা খাও। বাবর তুই যা তো চট করে ভোটটা দিয়ে আয়। '
সেই নির্দেশ শুনে বাবর ভোটকেন্দ্রের দিকে ছুটে যাওয়ার উপক্রম করতেই মুকিম বলে ওঠে , ' দাঁড়া , তুই তো আচ্ছা মাথামোটা। ছুটে যে চলে যাচ্ছিস , তা নকল ব্যালট পেপারটা নিয়েছিস তো ?'
বলে বুক পকেট থেকে একটা নকল ব্যালট পেপার বাবরের হাতে ধরিয়ে দেয় মুকিম। সেটা হাতে নিয়ে ভোটকেন্দ্রের দিকে ছুট লাগায় বাবর। চা খেতে খেতেই দেখতে জাহেদা দেখতে পায় বাবর লাইনের কাছে পৌঁছোতেই গণমঞ্চ পার্টির লোকেরা তাকে সামনে জায়গা করে দিল।
সব দেখেও লাইনের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অরুণোদয় পার্টির লোকেরা টুঁ শব্দটিও করল না। জাহেদা ভেবে পায় না এসময় বাবর নকল ব্যালটপত্র নিয়ে কি করবে ? ওগুলো নিয়ে তো কাল রাতে বাবররাই তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোন জায়গায় ছাপ দিতে হবে তা দেখিয়ে দিয়ে এসেছে। তাহলে কি বাবর ভুলে যেতে পারে বলেই মুকিম ওকে নকল ব্যালট পেপার ধরিয়ে দিল ? তাই বা কি করে হয় ? কথায় আছে গণমঞ্চ পার্টির লোকেরা নাকি 'বাপ ভুললেও ছাপ ভোলে না।' তাহলে বাবরের মতো দীর্ঘদিনের একজন সক্রিয় কর্মীর ছাপ ভুলে যাওয়াটা কি করে সম্ভব ? বাবর ভোট দিয়ে আসার পর অবশ্য রহস্যটা পরিস্কার হয়ে যায়। ভোটকেন্দ্র থেকে ফিরে বাবর একটা কাগজ মুকিমের হাতে তুলে
দেয়। কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বোলানোর আগেই মুকিম জিজ্ঞেস করে , ' কি রে সব ঠিকঠাক করেছিস ? '
' কি যে বলো বস , আজ কি প্রথম কাজটা করছি ? সেই পনেরো বছর আগে তুমি হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলে, তারপর থেকেই তো একই কাজ করে আসছি। ভুল হয় কখনো ?,
আত্মবিশ্বাসের সুর শোনা যায় বাবরের গলায়।কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে নিয়ে মুকিম বলে , ' ঠিক আছে। নকলটা বাক্সে ঢোকানোর সময় কেউ টের পায় নি তো ? '
বাবর বলে, ' কে টের পাবে গুরু ? অরুণোদয় পার্টির কোন এজেন্টই নেই বুথে।আর ভোটকর্মীরা তো ভয়ে জড়োসড়ো।'
মুকিম বাবরের নিয়ে আসা কাগজটা জাহেদার হাতে তুলে দিয়ে বলে , ' চাচী এটা আসল ব্যালট পেপার। আঁচলের ভিতরে লুকিয়ে নিয়ে যাও।ভোটকর্মীরা তোমাকে যে ব্যালট পেপারটা দেবে সেটাতে স্ট্যাম্প মেরে নিয়ে চলে আসবে। আর বাবরেরটা বাক্সে ঢুকিয়ে দেবে। '
ব্যালট পেপারটা হাতে নিয়ে জাহেদা হাঁ হয়ে যায়। সে দেখেতে পায় সেটাতে গণমঞ্চ পার্টির প্রতীকে ছাপ মারা রয়েছে। আশ্চর্য হলেও বিনা বাক্যব্যয়ে নির্দেশ মাফিক নিজের ব্যালট পেপারে ছাপ মেরে এনে সে মুকিমের হাতে তুলে দেয়। তারপর একই ভাবে পাড়ার অন্যান্য লোকেরা ভোট দিয়ে আসে। বাররই তাদের একের পর এক নিয়ে গিয়ে লাইনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আসে। তারাও সব একে একে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ওইভাবে ব্যালটপেপার নিয়ে বেরিয়ে আসে। আর সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অরুণোদয় পার্টির লোকেরা ভোটকেন্দ্রের দরজার সামনে পৌছোতেই পারে না। ভোট দিয়ে এসে পাতা পেড়ে খেতে বসে যায় সবাই। খেতে খেতেই জাহেদা ভাবতে থাকে , এ ভোটের কি মানে হয় ? এতো নিজের নম্বর নিজেই দেওয়ার মতো ব্যাপার। এই জন্যই বোধহয় ফল বোরনোর আগেই মুকিমরা বলে দিতে পারে তারা কত ভোট পাবে।
আশ্চর্যজনক ভাবে মিলেও যায় তাদের সেই হিসাব।
গুরুম -- গুরুম - গুরুম। ফের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায় জাহেদার। গ্রামের লোকেরা ছোটাছুটি শুরু করে দেয়।কিছু লোকজনকে নিয়ে মুস্তাককে ছুটে যেতে দেখে জাহেদা জিজ্ঞেস করে , ' কি হয়েছে বাপজান , সকাল থেকে আজ আবার এত গোলাগুলি কেন ? '
' সায়িন কাজী আর সুরথ মাঝিকে গণমঞ্চের লোকেরা শাবলডাঙ্গার মোড়ে আটকেছে। আমাদের লোকেরা তাদের উদ্ধার করার জন্য লড়াই করছে। গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বলচ্ছে। ঘরদোর সব সামলাও গিয়ে চাচী। ' ছুটতে ছুটতেই কথাগুলো বলে যায় মুস্তাক।
মুস্তাক অরুণোদয় পার্টির লোক। পার্টিঅন্ত প্রাণ। মানুষের হায়দায়েও ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে , কাউকে রক্ত দিতে হবে শুনলেই নিজে থেকে এগিয়ে আসে মুস্তাক। সেই সহমর্মিতা বোধ থেকেই বোধহয় ঘরদোর সামলানোর কথা বলে গেল মুস্তাক। কিন্তু জাহেদার আর ঘরদোর! সে তো সেই দশ বছর আগে রাজনীতির দমকা ঝড়ে
ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে।সেদিনও এই রকম সকাল থেকেই মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দে সচকিত হয়ে উঠেছিল গ্রামের পর গ্রাম। অরুণোদয় পার্টির লোকেদের আনাগোনায় সরগরম হয়ে উঠেছিল মুন্সীপাড়ার বাজার।
সেখপাড়া বাজারের দখল নিয়েছিল গণমঞ্চ পার্টির লোকেরা। অজানা আশংকা আর উত্তেজনায় ফুটছিল গ্রামের মানুষ। আগের রাতেই অরুণোদয় পার্টির রানা আর মালেক সেখ এসে বলে গিয়েছিল উঁচপুরে এক দুপুর ধান কাটতে গেলে পাঁচশো টাকা করে পাবে সবাই। এক দুপুর কাজ করে পাঁচশো টাকা পাওয়া যেন স্বপ্নের ব্যাপার। সেই লোভে গ্রামের আরও অনেকের সঙ্গে গিয়েছিল জাহেদার একমাত্র ছেলে সুরবানও। কিছুক্ষণ পরেই খারাপ খবরটা আসে।
( ক্রমশ )
No comments:
Post a Comment