আমার কথা
( আর কয়েকদিন পরেই আমার বাবার চলে যাওয়া এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে । ২০১৬ সালের ১১ নভেম্বর বাবা আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে চলে যান । তার মৃত্যুর পর কিছু অনুভূতির কথা লিপিবদ্ধ করেছিলাম । আজও সেই সব কথাই বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে । )
অনুশাসন
আজ কয়েকদিন হোল তুমি চলে গেছ।এখনো আনাচে কানাচে দগদগে হয়ে রয়েছে তোমার স্মৃতি। পেরেকে ঝোলানো তোমার ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট , প্রেসারের ওষুধের ফয়েল, ইনহেলার, আরও কত হাবিজাবি। তোমার নিত্য বসার জায়গাটি এখনও মাথার তেলে তেমনই সমান কালো।সেসব দেখি আর জলে ভিজে যায় চোখ।আত্মীয়েরা বলেন , শক্ত হও। তোমাদের এখন অনেক দায়িত্ব।মাকে দেখতে হবে।
মাকে দেখতে গিয়েই আরো বেশি করে মনে পড়ে যায় তোমাকে।সিঁদুরে ঢাকা মায়ের সিথিটা এত সাদা বুঝি নি আগে।মায়ের সর্বাংগে তোমার চলে যাওয়ার ছাপ।আমাদের সাদা মাটা আটপৌরে মায়ের না ছিল ভালো শাড়ি, না ছিল অলংকার।তবু তুমি যতদিন ছিলে ততদিন মাকে এত ফাঁকা ফাকা লাগেনি।সাধারণ খোলের শাড়ি আর শাখা নোওয়াতেই দিব্যি সন্তুষ্ট ছিলেন আমাদের মা।তুমি চলে যাওয়ার সময় পাড়ার মহিলারা ঠুকে ভেংগে দিল শাখা।খুলে নিল নোওয়া, পড়িয়ে দিল থান কাপড় ,পায়ে শেষ আলতা। মুছিয়ে দিল সিথির সিঁদুর।
মা কান্নায় তোমার বুকে আছড়ে পড়লেন।তার তো ছিল ওইটুকুই অলংকার।এখনো সযত্নে তাকে তোলা রয়েছে অব্যবহৃত আলতা, সিদুর, সস্তার সুগন্ধী তেল , বাক্সে পুজোয় কেনা একবারই পড়া শাড়ি।আর তো ওসব মায়ের পড়া হবে না কোনদিন।একদিন আমরা আস্তে আস্তে ভুলে যাব তোমাকে।দাদুর ছবির পাশে তোমার ধুলি ধুসর ছবিতেও শুকিয়ে ঝুলবে রজনীগন্ধার মালা।শুধু মায়ের বৈধব্যবেশ ঘুরে ফিরে তোমায় পড়িয়ে দেবে মনে।আচ্ছা বাবা, যেদিন মা'ও চলে যাবেন সেদিন আমাদের কে আমাদের আগলে রাখবে ? কে বলবে হিম পড়ছে ,বাইরে যাস না বাবা ? এত বড়ো পৃথিবীতে আমরা যে বড্ড একা হয়ে যাব বাবা।
----০----
শুন্যতা
একে একে প্যান্ডেলের শেষ বাঁশটাও খোলা হয়ে গেল। আর গোটা বাড়িটাকে গ্রাস করে নিল এক নিসীম শুন্যটা। ১৯ দিন আগে বাবা চলে গিয়েছেন। তবু তার পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম, আত্মীয় পরিজনদের আসা যাওয়া ঘিরে মনে হোত যেন বাবাও আছেন। তার সংস্পর্শ মিশে রয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে।
আত্মীয়রা চলে গিয়েছেন। প্যান্ডেলের লোকেরাও চলে গিয়েছে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে। শুধু দেওয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে রয়েছেন বাবা। আর পড়ে রয়েছে তার হাতে গড়া সাম্রাজ্য। আমাদের বাড়ি। দোল খাচ্ছে নারকেলের পাতা, টুপটাপ করে ঝড়ে পড়ছে পাকা আমড়া, বাঁশঝাড়ে কিচিরমিচির করছে পাখির দল। মনে হচ্ছে বাবা যেন বলছেন, ভয় কি রে ? এসবের মধ্যেই আমি আছি।
বাস্তবিকই , বাবা আমাদের সবকিছু সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। নবজাতকের মাথার বালিশের শিমুল তুলোর গাছ থেকে শেষ যাত্রার খাটের বাঁশের ঝাড়। আগে আমাদের কোন বাঁশবন ছিল না। অন্যান্য কাজ তো বটেই, মৃতদেহের খাট তৈরির বাঁশের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হত। বাবা নিজ হাতে বাঁশববনও তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন। সেই বাঁশ দিয়েই দাদু- ঠাকুরমার খাট তৈরি হয়েছে। ওই বাঁশের খাটেই শেষ যাত্রায় গিয়েছেন বাবাও।
আজ বাবার ভোজের কর্মীদের খাওয়া দাওয়া। কসা মাংসের গন্ধে ম-ম করছে সারা বাড়ি। চোখের জল কিছুতেই বাঁধ মানছে না। বাবা মোটা মাছ - মাংস খেতে খুউব ভালোবাসতেন। ওইটুকুই ছিল তার বিলাসিতা।মনে পড়ে, ছোটবেলায় ১০ টাকা দিয়ে আমাকে সাঁইথিয়ায় ছাট মাংস আনতে পাঠাতেন। ছাট মাংস কিনতে খুব লজ্জা হোত। রাগও হোত বাবার উপর।
তখন তো আর বুঝতাম না, মাসিক ৬০ টাকা বেতনের স্কুল শিক্ষকের পক্ষে সংসারের সবদিক সামলে ছাট ছাড়া ভালো মাংস কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। আর আজ তারই ভোজের কর্মীদের খাওয়া-দাওয়ার কত এলাহি আয়োজন। কিছুতেই মাংস মুখে তুলতে পারছি না। মনে হচ্ছে বাবা এমন মাংসভাত পেলে কত খুশী হতেন। চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে মাখাভাত। ভিজেই যাচ্ছে।
-----০-----
আমার বাবা
আজ বিকালে ঢেকা গ্রামের পাশ দিয়ে হাটতে বেড়িয়ে বাবার কথা খুব বেশী করে মনে পড়ে গেল।৯ মাস হল বাবা চলে গিয়েছেন। তার অভাব এখন প্রতি পদে অনুভব করছি।আজ হাঁটতে বেড়িয়ে যেন বাবাকে ঘিরে ফিরে পেলাম হারানো শৈশব। বাবা তখন শিক্ষকতা করতেন ময়ূরেশ্বরের নন্দীহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমি গ্রামের স্কুলেই দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। মাঝে মধ্যে গ্রামের স্কুল কামাই করে বাবার সংগে যাওয়ার বায়না ধরতাম। তার অন্যতম দুটি কারণ ছিল। প্রথমটি হলো আমি গেলে বাবার ছাত্র খুদুকাকুদের বাড়িতে টিফিনের সময় ভালো খাওয়া জুটত। আর আলপথ ভেঙে বিভিন্ন গ্রামের মাঝে দিয়ে যেতে কি রকম যেন একটা ভালো লাগত।
ঢেকা গ্রামের কামারগড়ের পাশ দিয়ে গোন আলের উপর দিয়ে যেতে হত। দুপাশে পড়ে থাকত বুড়োদীঘি আর রানীভবানী। ছাতা মাথায় বাবা যেতেন আগে আগে। পিছনে পিছনে আমি যেতাম কখনও নাচতে নাচতে, কখনও বা হেলতে দুলতে নানা অংগভংগি সহ মাঠে টানানো ছাগল-গরুকে ভেংচি কাটতে কাটতে। বাবা একের পর এক ধারাপাত , পদ্য মুখস্থ করাতে করাতে হাঁটতেন। আর আমি বাবার সংগে ধারাপাত ঘষতে ঘষতে হঠাৎ দুহাতের তালু প্রসারিত করে ফরিঙ ধরতে সংলগ্ন আখের জমিতে নেমে যেতাম।
বাবা টের পেয়ে বকা লাগাতেন -- এই জন্যই তো তোকে আনতে চাই না। এরকম করলে আর কোনদিন আনব না কিন্তু। বকা খেয়ে ছুটে বাবার সংগ নিতাম। আবার কিছুটা গিয়ে আলের ধারে লজ্জাবতীর পাতা ছুঁয়ে নুইয়ে পড়া দেখতে দাঁড়িয়ে পড়তাম, কখনও ঝোঁপে ফু দিয়ে জোঁকের অস্তিত্ব টের পাওয়ার চেষ্টা করতাম। তারপর ফের বকা খেয়ে খেই হারিয়ে একে চন্দ্র -- দুইয়ে পক্ষ করতে করতে কাছাকাছি পৌঁচ্ছে শুনতাম বাবা তখন ভরাট গলায় আবৃত্তি করছেন -- আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে। ওইভাবে কিলোমিটার দুয়েক হেঁটে স্কুলে পৌঁছানোর পর বাবা নিজে হাতে আমার কাদামাখা পা ধুইয়ে পরিস্কার করে দিতেন।
আজ বেড়াতে গিয়ে দেখলাম সরু হয়ে গিয়েছে সেই আলপথ। দুধারের জমিতে আজও উড়ে বেড়াচ্ছে কত রঙ বেরঙের ফড়িং। পায়ের স্পর্শে মাথা নুইয়ে দিচ্ছে আলের ধারের লজ্জাবতী লতা। যেন মায়া অঞ্জন মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবাকে ঘিরে আমার হারানো শৈশব।বাবাই শুধু নেই।আবার আছেও।আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম বাবার সেই কন্ঠস্বর -- বল বাবু, একে চন্দ্র -- দুইয়ে পক্ষ -- তিন এ নেত্র -- চার এ বেদ ------।
ঢেকা গ্রামের কামারগড়ের পাশ দিয়ে গোন আলের উপর দিয়ে যেতে হত। দুপাশে পড়ে থাকত বুড়োদীঘি আর রানীভবানী। ছাতা মাথায় বাবা যেতেন আগে আগে। পিছনে পিছনে আমি যেতাম কখনও নাচতে নাচতে, কখনও বা হেলতে দুলতে নানা অংগভংগি সহ মাঠে টানানো ছাগল-গরুকে ভেংচি কাটতে কাটতে। বাবা একের পর এক ধারাপাত , পদ্য মুখস্থ করাতে করাতে হাঁটতেন। আর আমি বাবার সংগে ধারাপাত ঘষতে ঘষতে হঠাৎ দুহাতের তালু প্রসারিত করে ফরিঙ ধরতে সংলগ্ন আখের জমিতে নেমে যেতাম।
বাবা টের পেয়ে বকা লাগাতেন -- এই জন্যই তো তোকে আনতে চাই না। এরকম করলে আর কোনদিন আনব না কিন্তু। বকা খেয়ে ছুটে বাবার সংগ নিতাম। আবার কিছুটা গিয়ে আলের ধারে লজ্জাবতীর পাতা ছুঁয়ে নুইয়ে পড়া দেখতে দাঁড়িয়ে পড়তাম, কখনও ঝোঁপে ফু দিয়ে জোঁকের অস্তিত্ব টের পাওয়ার চেষ্টা করতাম। তারপর ফের বকা খেয়ে খেই হারিয়ে একে চন্দ্র -- দুইয়ে পক্ষ করতে করতে কাছাকাছি পৌঁচ্ছে শুনতাম বাবা তখন ভরাট গলায় আবৃত্তি করছেন -- আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে। ওইভাবে কিলোমিটার দুয়েক হেঁটে স্কুলে পৌঁছানোর পর বাবা নিজে হাতে আমার কাদামাখা পা ধুইয়ে পরিস্কার করে দিতেন।
আজ বেড়াতে গিয়ে দেখলাম সরু হয়ে গিয়েছে সেই আলপথ। দুধারের জমিতে আজও উড়ে বেড়াচ্ছে কত রঙ বেরঙের ফড়িং। পায়ের স্পর্শে মাথা নুইয়ে দিচ্ছে আলের ধারের লজ্জাবতী লতা। যেন মায়া অঞ্জন মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাবাকে ঘিরে আমার হারানো শৈশব।বাবাই শুধু নেই।আবার আছেও।আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম বাবার সেই কন্ঠস্বর -- বল বাবু, একে চন্দ্র -- দুইয়ে পক্ষ -- তিন এ নেত্র -- চার এ বেদ ------।
-----০-----
দাদুর কথা
বিজয়া দশমী এলেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় দাদুর কথা। সেসময় দশমীর সকালে দাদু ১০ টাকার নোট দিয়ে পোষ্ট অফিস থেকে পোষ্ট কার্ড আনতে বলতেন। মনে আছে তখন ১৫ পয়সা দাম ছিল পোষ্টকার্ডের। ৬৬ টি পোষ্টকার্ড নেওয়ার পর ফেরতের ১০ পয়সায় টিকটিকির ডিমের লজেন্স খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম।
পোষ্টকার্ড হাতে পেয়েই দাদু বসে যেতেন বিজয়ার চিঠি লিখতে। চশমা ছাড়া দেখতে পেতেন না। তবু সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখতেন সব চিঠি। আমি বলতাম , দাদু অত কষ্ট করে কি হয় ওসব লিখে ? দাদু বলতেন , দেখ আমাদের কত আত্মীয় স্বজন, প্রিয়জন দুরে দুরে ছড়িয়ে আছেন।কতদিন তাদের সাথে দেখা হয় না। এই চিঠি তারা যখন পাবেন তখন আমার স্পর্শ অনুভব করবেন। তাদের পাঠানো চিঠিতে আমিও ওইসব প্রিয়জনদের স্পর্শ পাবো। কারণ ওইসব চিঠিতে তো তাদের হাতের ছোঁওয়া লেগে থাকে। তাদের শরীরের গন্ধও লেগে থাকে চিঠিতে। বড় হলে তুমিও বুঝবে।
শরীরে এবং বয়সে এখন আমি অনেকটাই বড়ো হয়ে গিয়েছি।কিন্তু দাদুর মতো স্পর্শ, গন্ধ পাওয়ার অনুভূতিটাই কোথাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। এখন মোবাইল থেকে ছবি নিয়ে একসংগে অনেককে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার দায় সারি।আরও একটা কথা মনে পড়ে।চারদিন মায়ের পায়ের তলায় থাকার পর এদিন বইপত্র হাতে আসত। মা বলতেন , ভক্তিভরে তিনবার করে শ্রী শ্রী দুর্গা মাতা, সরস্বতী মাতা , লক্ষ্মী মাতার সহায় লিখে পড়তে বসো। না হলে পড়াশোনা হবে না।
ভক্তিটক্তি ঠিক বুঝতাম না। কিন্তু মাথায় থাকত স্কুল খুললেই বার্ষিক পরীক্ষার কথা। তাই দেবীরা প্রসন্ন হয়ে যদি উৎরে দেন সেই আশায় একে একে তিন দেবীর সহায় লেখার পর সমস্যায় পড়তাম দেবীর পরিবারের বাকি সদস্যদের নিয়ে। অসুর এবং তার বাহনকে নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না। তাকে ধরেই নিতাম শত্রু পক্ষের লোক। তাই তাকে সন্তুষ্ট করার কথা ভাবতাম না। কিন্তু কার্ত্তিক -গনেশ ? তারাও তো দেবতা। তাই তাদেরও বাবা যোগে সহায়
লিখতাম।
শেষে মনে হোত দেবতার বাহনেরাই বা কম যায় কিসে ? দেবতার বাহন যখন , তখন নিশ্চয় তাদেরও কিছু ক্ষমতা আছে। তাদের সহায় না লিখলে তারা যদি রেগে যান ? যদি পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার পাওয়ার ব্যবস্থা করেন ? তাদের নামেও সহায় লিখতাম। সমস্যা হোত লিঙ্গ ভেদের সম্বোধন নিয়ে। কার বাহনকে পিতা , কার বাহনকে মাতা লিখব তা নিয়ে তখন চরম দোটানায় পড়তে হত। ছোট্ট মাথা ঘামিয়ে বের করতাম সহজ সমাধানও।
দেবীদের বাহনকে মাতা আর দেবতাদের বাহনকে পিতা সম্বোধনে সহায় লেখাই যুক্তযুক্ত বিবেচনা করতাম। সেই হিসাবে গনেশের বাহনকে পর্যন্ত ইঁদুর বাবার সহায় লিখে মনে হোত যাক বাবা আর কারও মনক্ষুন্ন হওয়ার উপায় নেই।খুব জানতে ইচ্ছে করে , বর্তমান প্রজন্মও কি পরীক্ষায় ফেলের ভয়ে ইঁদুর পিতার সহায় লেখে ? ইঁদুরকেই তো তাদের হাতের মুঠোয় আজ্ঞাবহ দাসের মতো কাজ করতে দেখি। সেই মনটাই কোথাই যেন হারিয়ে গেল।
লিখতাম।
No comments:
Post a Comment