রামদাস বাউলের কথা
আদরের একমাত্র ছেলে কেঁদে ককিয়ে গেলেও একটি বারের জন্যও একতারাতে হাত ছোঁওয়াতে দিতেন না রামদাস বাউল। পাছে তারই মতো বাউলের নেশা ছেলের জীবনও অনিশ্চয়তায় ভরে যায় সেই আশংকায় সব সময় দূরে দূরে রাখতেন। কারণ তার যে জাত খুইয়েও পেট ভরে নি।
বীরভুমের ময়ুরেশ্বরের মনোহরপুর গ্রামে একচিলতে মাটির বাড়িতে ছিল রামদাসের বাস।একসময় তার বাড়ির দেওয়াল জুড়েও শোভা পেত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সংগে তোলা ছবি। কারণ ভারত উৎসবে দেশের প্রতিনিধি হিসাবে তিনিও বাউল গানে মাতিয়ে এসেছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা , রাশিয়া সহ বিভিন্ন দেশের মাটি। কিছু টাকা, শংসাপত্র আর চমকদার ছবি নিয়ে ফিরেছেন।
কিন্তু পেট ভরে নি তাতে। আদতে দিনমজুর ভল্লা পরিবারের ছেলে ছোট বেলায় মনের টানে বাউল হয়েছিলেন। তার উপরে বিদেশ ফেরত বাউলকে কেউ মজুর খাটতেও ডাকত না। খ্যাতির বিড়ম্বনা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন তিনি।বাউল গেয়ে পেট ভরে নি। জোটে নি দিনমজুরীও। শেষ বয়সে চরম কষ্টে দিন কেটেছে তার।বার বার আবেদন করেও কোন শিল্পীভাতা জোটে নি।
জুটেছিল মাসিক ৭০০ হারে কৃষি পেনশন। কিন্তু তাতে তেমন সুসার হয়নি সংসারে। কারণ দীর্ঘদিন পক্ষাঘাত গ্রস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। বাংলা ২০২১ সালের ২৭ শে চৈত্র অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় তার। এখন ছেলে ধনঞ্জয়ের দিনমজুরীর আয়ে জোড়াতালি দিয়ে সংসার প্রয়াত রামদাসের পরিবারের।
দারিদ্র সীমার নীচে বাস করা স্বত্ত্বেও বিধবাভাতা জোটেনি প্রয়াত শিল্পীর স্ত্রী ঠান্ডুদেবীর। রামদাসের বাড়ির দেওয়ালে আর সেই সব ঝাঁ চকচকে ছবি নেই। কিন্তু একতারাটি রয়েছে। চাইলে রামদাসের ছেলে এখন তাতে হাত ছোঁওয়াতেই পারে। কিন্তু বাবার পরিনতি দেখে সাহস হয় না।
----০----
বাঁকু পটুয়ার কথা
বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশা গ্রামে এক চিলতে কাদাছিটের চালা ঘরে ছিল তার বাস। সে ঘরের চালের ফুটো দিয়ে দেখা যেত রাতের তারাভরা আকাশ। বৃষ্টির জল অঝোর ধারায় ঝরনা হয়ে ঝরত সারা ঘরে। আর সেই বৃষ্টি ধারা থেকে বাঁচাতে কচি ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্ত্রী ঘরের একোন--ওকোন করতেন , তখন তিনি নিজের শিল্পকর্ম বুকে চেপে ঠাই ভিজেছেন। তিনি চিত্রকর বাঁকু পটুয়া। ওই পর্ণকুটিরে রাজার মেজাজে কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কারণ ওই কুটিরেরই চার দেওয়ালে শোভা পেত তারই সংগে ডিনারে রাজকীয় খাদ্য সামগ্রীর সামনে এক টেবিলে বসা দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজপুরুষদের ছবি। ওই ডিনারের একটি প্লেটের খরচেই অনায়াসে ছাওয়ানো হত তার ঘরের ফুটো চাল। আসলে ভারত উৎসবে দেশের প্রতিনিধি হিসাবে বিভিন্ন সময়ে পট এবং পটের গান নিয়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, রাশিয়া , ফান্স প্রভৃতি দেশ মাতিয়ে এসেছেন। এদেশের লোকশিল্পকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ওইসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সংগে রাজকীয় ডিনার টেবিলে বসা তার ছবি উঠেছে। কিছু টাকা , ওইসব ছবি, আর শংসাপত্র নিয়ে ফিরেছেন তিনি। তাতে পেট ভরে নি। পট নিয়ে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করেছেন। মন চাই নি, তবু ক্ষুন্নিবৃত্তির তাগিদে তাকে আঁকতে হয়েছে স্বাক্ষরতা, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক পট। বাঁধতে হয়েছে গানও। তাতেও হাল ফেরেনি সংসারে। শেষ বয়েসে মাসিক ১০০০ টাকা অক্ষম ভাতা বরাদ্দ হয়েছিল তার নামে। ওই টাকাটুকু ওষুধ কিনতেই খরচ হয়ে গিয়েছে। তাই বৃদ্ধ বয়েসে অসুস্থ শরীরে তাকে পট নিয়ে ঘুরতে হয়েছে গ্রামে গ্রামে।
২০০৬ সালের ১৪ জুলাই মৃত্যু হয় তার। স্ত্রী ভৈরবী পটুয়ার এখন স্বামীর ভাতার টাকাটুকুই সম্বল। ৫ ছেলের মধ্যে ২জনই মাত্র পট আঁকেন। একজন মাসিক যৎসামান্য কিছু শিল্পী ভাতা পেলেও অন্যজনের তা জোটেনি। দুজনকেই পট নিয়ে আজও গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হয়। নিত্য নতুন শিল্পভাবনার অবকাশই পাননা তারা। ক্ষুন্নিবৃত্তির তাগিদে তাদেরও আঁকতে হয় শৌচাগারের ফরমায়েশি পট।বাঁকু পটুয়ার আঁকা পটচিত্র আজও আলোকিত করে রয়েছে বহু শৌখিন মানুষের বাড়ির ড্রইয়িং রুমের দেওয়াল। তবু আজও আঁধার ঘোচে নি পটুয়া পরিবারে।
-----০-----
মনোজের কথা
সবাই যদি মনোজ দাসের মতো হতো ? সেদিন বীরভূমের কীর্ণাহার থেকে সিউড়ি গামী বাসে পাশের সিটের তরুণীর কথোপকথন শুনে প্রশ্নটা মনে জাগল। কথোপকথন থেকে জানা গেল , ওই তরুণী কীর্ণাহার বাসস্ট্যাণ্ড এলাকায় তার স্মার্ট ফোনটি কোনও ভাবে হারিয়ে ফেলেছে। অন্য একটি ছোট ফোন থেকে বার বার কল করে ক্রমাগত সুইচ অফ শুনতে শুনতে শেষে অন্য একজনকে ফোন করে বলে, মামা ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি, সিমটা লক করে দাও। তার চোখে মুখে তখন হতাশার ছাপ।
হয়তো টাকা জমিয়ে কিনেছিল শখের ফোন। তার ওই হতাশাগ্রস্থ চোখ মুখ দেখে আমার আচমকাই মনোজ দাসের কথা মনে পড়ে। বীরভুমেরই সাঁইথিয়া থানার হরিহরপুর গ্রামে এক দিনমজুর পরিবারের ছেলে মনোজ স্থানীয় মৃতদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। একদিন ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে স্কুলের গেটের সামনে একটি দামী স্মার্ট ফোন কুড়িয়ে পায়। সঙ্গে সঙ্গে সে ফোনটি শিক্ষক মশাইদের জমা দেয়।
মোবাইলের তথ্য ভাণ্ডার ঘেটে শিক্ষক মশাইরাও ফোনটি মালিকের হাতে তুলে দিয়েছেন। একে অভাবের সংসার, তার উপরে বর্তমান যুগে বাচ্চাদের কাছে চরম আর্কষণের সামগ্রী হলো মোবাইল। কিন্তু হেলায় সব প্রলোভন জয় করে আমদের দেখিয়ে দিয়েছে মনোজ।
সবিনয়ে সে জানিয়েছে , শিক্ষক মশাইরাই শিখিয়েছেন না বলে অন্যের জিনিস নেওয়া পাপ। পড়ে থাকা জিনিসও তো অন্যের। ছোট্ট মনোজ আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজকে গালে থাপ্পড় মেরে শিখিয়ে দিল, মনের জোর থাকলে সব প্রলোভন জয় করা যায়। ভাবের ঘরে চুরি করতে হয় না। আসুন প্রার্থনা করি , মনোজের মতো ছেলে ঘরে ঘরে জন্মাক। তাহলে হয়তো ওই তরুণীর মতো আর বহু মুখে হাসি দেখতে পাবো।
----০----
হীরক চিত্রকরের কথা
বছরের পর বছর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলেছেন হীরক চিত্রকর।যে হাতে দেবী দুর্গাকে সাজাচ্ছেন সেই হাতেই সাজিয়ে তুলছেন মহরমের তাজিয়া । অর্থাভাবে সাজানো হয় না শুধু নিজের মাকে । অথচ তারই বাড়িতে একই ছাদের নীচে দেবী দূর্গাকে সাজানোর পাশাপাশি তৈরি হছে তাজিয়া সাজানোর উপকরণও । তবুও অভাব ঘোচে না পরিবারে । তাই শুধু মাটির মাকেই সাজিয়ে চলেছেন শিল্পী। কারণ তার পরিশ্রমের গুড় মহাজনে খায়। আর অভাবের হাজারটা হাঁমুখ গ্রাস করে নেয় তাদের পুজোর আনন্দ ।
নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই । আমোদপুর সুকান্তপল্লীতে সুগারমিলের পরিত্যক্ত কোয়ার্টারে তাদের সাত সদস্যের অভাবের সংসার । শোলার কাজই জীবিকা অর্জণের একমাত্র পথ । মামা তন্ময় চিত্রকরের কাছে হাতেখড়ি হীরকবাবুর। বছর দশেক আগে নিজে স্বাধীনভাবে শোলার মুর্তি তৈরির কাজ শুরু করেন । প্রথমে তৈরি করেন গনেশ । তারপর থেকেই তৈরি করেন পূর্ণাঙ্গ দূর্গা মূর্তি। গত বছর তার তৈরি মূর্তি পাড়ি দিয়েছিল প্যারিস । এবারে মূর্তি গড়েছেন ২০ টি । সেগুলির অধিকাংশই ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে দিল্লি-তমলুক । তবু দম ফেলার ফুরসত নেই চিত্রকর পরিবারের । কারণ দূর্গার সাজ সেট তৈরির পাশাপাশি চলছে মহরমের তাজিয়া নির্মাণের কাজ । ওই কাজ করেই তাদের যোগাড় করে নিতে হয় সারা বছর বেঁচে থাকার রসদ ।
দিন রাত কাজ করে যা লাভ তার সিংহভাগই চলে যায় মহাজনের পেটে । কারণ উপকরণ কেনার জন্য তার কাছেই চড়া সুদে টাকা ধার নিতে হয় । আবার তৈরি শিল্পসামগ্রী পুঁজির অভাবে ধরে রেখে নিজে বিক্রি করতেও পারেন না । পাইকারি দামে অন্যকে বিক্রি করে দিতে হয় । দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য নানা সরকারি প্রকল্প চালু আছে , কিন্তু তার নাগাল পাননি ওই শিল্পী । এমন কি কোন সরকারি ভরতুকি যুক্ত ঋণও জোটে নি তার ভাগ্যে । একবার ঋণ বরাদ্দ হয়েছিল কিন্তু ডিপোজিট মানি জমা দিতে পারেননি বলে তা'ও হাতছাড়া হয়ে যায় বলে অভিযোগ ।
হীরকবাবু জানান , লাভের একটা বড়ো অংশই বেরিয়ে যায় । হাতে যা থাকে তাতে পেটের ভাতটুকুই হয় । অধিকাংশ বছর পুজোতে নিজের মাকে একটা কাপড় পর্যন্ত কিনে দিতে পারি না । অথচ বহু মন্ডপে গিয়ে মাটির মাকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে দিয়ে আসি ।
---০---
No comments:
Post a Comment