Short story, Features story,Novel,Poems,Pictures and social activities in Bengali language presented by Arghya Ghosh

পঞ্চরসের কথা


                                       

                          অধীর মন্ডলের কথা 

                                                 
                                                     
 
                                                  

                                 অর্ঘ্য ঘোষ        


     গানের নাম শুনলে এখনও নাক সিঁটকানো ভাবটা রয়েই গিয়েছে তথাকথিত ভদ্রসমাজে । সপরিবারে গানের আসরে যাওয়া দুরে থাক , পারলে শত হাত পিছিয়ে যান সমাজের একটা বড়ো অংশ । সেই ছুঁৎমার্গ দুরে সরিয়ে পঞ্চরসকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অধীর মন্ডল ।


               পঞ্চরসকে কোথাও কোথাও আলকাপ বা ছ্যাঁচড়া বলা হয় । তরকারির মতোই বর্জনীয় উপকরণ দিয়ে সাজানো হয় বলেই বোধ হয় ওই ধারার সংস্কৃতিকে ছ্যাঁচড়া বলা হয় বলে মনে করেন বহু শিল্পী। ওই গান আদিরসের আধিক্য দোষে দুষ্ট বলে প্রচার রয়েছে জনসমাজে । তাই প্রকাশ্যে কেউ তথাকথিত ভদ্রসমাজে নিন্দা হওয়ার আশংকায় ওই গানের আসরে যাওয়ার সাহস দেখান না বলেই শিল্পীদের অভিমত । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই অভিযোগ সত্য হলেও চটুল গান আর আদি রসাত্মক পরিবেশনই পঞ্চরসের একমাত্র উপলক্ষ্য নয় । 


                 বরং সারা রাত্রি ব্যাপী সংস্কৃতির পাঁচটি রস সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে পঞ্চরসে । কি নেই পঞ্চরসে ? পুরো মাত্রায় নাচ , গান , হাস্যরস , যাত্রা আর আদিরস। কিন্তু একটা আদিরসের আঁধার হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া পঞ্চরস আজও তথাকথিত সভ্য সমাজে অছুৎ হয়েই রয়ে গিয়েছে । মূলত: পিছিয়ে পড়া তফশিলী , আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বিনোদনের ওই মাধ্যমটি। সরকারি স্তরেও পঞ্চরসের তেমন কোন স্বীকৃতি নেই বললেই চলে । 

  
      
       নিচু নজরে দেখা ওই পঞ্চরসকে জাতে তুলতে দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন অধীরবাবু। এমনিতেই নিত্য নতুন বিনোদনের দাপটে একের পর এক বিপন্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন লোকশিল্পের অস্তিত্ব।হারিয়ে যাচ্ছেন শিল্পীরা। তার উপরে ছুঁৎমার্গের বেড়াজালে পঞ্চরসের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়েছে । দল ছেড়ে পঞ্চরস গানের  শিল্পীরা ক্ষুন্নিবৃত্তির তাগিদে দিনমজুরি করছেন নয়তো ভটভটি চালাচ্ছেন । এই নৈরাশ্যের মাঝেও সমকালীনতার বার্তাবাহকের কাজ করে পঞ্চরস গানের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন অধীর মণ্ডল । টিকিয়ে রেখেছেন দলের শিল্পীদেরও ।


      ‘ বীরভূমের ওই সূচপুর/ নানুর থেকে নয়কো দুর । সেথায় যেতে আর লাগে ভালো রে / ওরা খুঁচিয়ে ১১ মানুষ মেলো রে। কিম্বা অজয় আর ময়ূরাক্ষী বানে / গরীব গুনো মলো ধনে প্রানে । তারই মাঝে কেউ বগল বাজায় / বান-খরাতে হয় ওদের মজাই । ১৯৮৫ সালের বন্যার ক্ষতিপূরণে আর্থিক দুনীতি কিম্বা ২০০০ সালে সূচপুরে হাড়হিম করা গণহত্যা নিয়ে অধীর মন্ডলের লেখা ওইসব পঞ্চরস গান একসময় বীরভূম তথা রাজ্যের মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে । ওইসব পঞ্চরস গানেই সমকালীন বিভিন্ন বিষয়কে জেনেছেন এলাকার মানুষজন। সেই ধারায় আজও লোটো গানের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন ওই শিল্পী । 
        
                                     নানুরের দাসকলগ্রামের চাষি পরিবারে জন্ম অধীরবাবুর । বাবা প্রয়াত নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল গ্রামেরই শিশির ঘোষের কৃষ্ণযাত্রার দলে অভিনয় করতেন । ওইদলেই মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই প্রথম পাদপ্রদীপের আলোর নীচে পা রাখেন বালক অধীর। ওইসময় বর্ধমান থেকে গ্রামে আসে একটি পঞ্চরস গানের দল । সেই গান শুনে আকৃষ্ট হন অধীরবাবুরা । তারা কৃষ্ণযাত্রার দলের মালিককে পঞ্চরস গানের দল খোলার আর্জি জানান । সেই মতো কৃষ্ণযাত্রার দলটি রূপান্তরিত হয় পঞ্চরস গানের দলে । মহিলা চরিত্রে অভিনয় দিয়ে পঞ্চরস  গানের আসরেও পা রাখেন অধীর । পরে অবশ্য নিজেই দল খোলেন । 


                                   তাদের গানে মুগ্ধ হয়ে চুরুলিয়ার নজরুল অ্যাকাডেমি , শান্তিনিকেতন পৌষমেলায় প্রয়াত শান্তিদেব ঘোষ পুরস্কৃত করেন । সেই থেকে পৌষমেলায় অধীরের রামকৃষ্ণ অপেরার আসন পাকা হয়ে যায়। বর্তমানে সব মিলিয়ে দলে শিল্পীর সংখ্যা ২৮ জন । যার মধ্যে মহিলা রয়েছেন ৮ জন। তাদের অধিকাংশই ওই গানের মাধ্যমেই খুঁজে পেয়েছেন জীবন জীবিকা । বোলপুরের সিয়ানের ৬২ বছরের গীতা রায় , বর্ধমানের বলগোনার ৪৫ বছরের ঝর্ণা ঘোষরা জানান , আমরা   অনেকেই একদিন ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে সমাজের মূলস্রোত থেকে ছিটকে পড়েছিলাম । কোথাও কিছু না পেয়ে পঞ্চরস গানের দলে নাম লিখিয়েছিলাম । যে সমাজ আমাদের কোন সুযোগ দেয়নি সেই সমাজের লোকেরাই আমাদের নিচু নজরে দেখে । কিন্তু পঞ্চরস গানের দলেই অভিনয় করেই আমরা খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি।


                                  শুধু ওইসব মহিলারাই নন , একসময়ের কলকাতা যাত্রাদলের অভিনেতা নানুরের চিৎগ্রামের উজ্বল রায় , সিউড়ির শ্যামল খয়রা , লাভপুরের আবাদের মিলন বাগদিরাও জানিয়েছেন একই কথা । তারা জানান , পঞ্চরস গান তো বটেই , নিত্য নতুন বিনোদনের দাপটে অধিকাংশ লোকশিল্পই বিপন্ন হয়ে পড়েছে । শিল্পীরা মজুর খাটছেন কিম্বা রিক্সা টানছেন । কিন্তু আমাদের গানের দল সমান জনপ্রিয় । এখনও গড়ে বছরে ২০০ পালা গান হয় ।

   ভিন্ন ধারার রসায়নটা ব্যাখ্যা করলেন স্বয়ং অধীর । তিনি জানান , মানুষ ঘরের কাছের সমকালীন বিষয়কে মঞ্চে দেখতে বেশি পছন্দ করেন । তাই আমরা সমকালীন বিষয় নিয়ে গান কিম্বা হাস্যকৌতুক লিখে পরিবেশন করি । ঘটনা এমনও ঘটে একই মঞ্চে কোন গান বা কৌতুক দর্শকদের অনুরোধে একাধিকবার পরিবেশন করতে হয়েছে । পরিবেশন ভঙ্গিতেও আনা হয়েছে মার্জিত ছাপ।

                       তার একটাই আক্ষেপ ভদ্র সমাজের মানুষজন বাইরে থেকে ধরেই নেন পঞ্চরস তাদের দেখার যোগ্য নয় । ওসব ছোটলোকদের দেখার জিনিস । কিন্তু হাল আমলের সিনেমা - থিয়েটার কিম্বা সিরিয়ালগুলোতে যা পরিবেশন করা হয় তার শালীনতার কখনও কখনও পঞ্চরসকেও ছাড়িয়ে যায় । কিন্তু সেক্ষেত্রে কেউ নাক সিটকান না। 

                   তিনি জানান , প্রকাশ্যে পঞ্চরসের নামে নাক কুঁচকালেও রাত গভীর হলে মুখে গামছা ঢাকা দিয়ে ভদ্রসমাজের বহু মানুষজনকে চুপিসারে পঞ্চরসের আসরে ঢুকতে দেখা যায় । ওইসব মানুষজন যাতে একদিন মুখের গামছা খুলেই সপরিবারে পঞ্চরসের আসরে আসেন , পঞ্চরসকে সেই মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করার  জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়ে যাব । 


                   ----০---                                         



No comments:

Post a Comment