লুপ্তপ্রায় খেলা
কাঠি খোঁজাখুঁজি
' কী মজা কী মজা
ভজা খেল গজা।
গজার ভিতর পোঁকা ,
ভজা বড়ো বোকা ।'
একসময় কচিকাঁচাদের মুখে মুখে ফিরত এই জাতীয় ছড়া। আজ শুধু প্রবীণ-প্রবীণাদের মনের মনিকোঠায় স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে আছে ওই জাতীয় ছড়া। কারণ যে খেলার সুবাদে ওই ছড়ার উৎপত্তি হয়েছিল , চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই খেলাটি। খেলাটির নাম ' কাঠি খোঁজাখুঁজি ' বা ' কাঠি গোঁজাগুঁজি।'
ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কিম্বা আলাদা আলাদা ভাবে ওই খেলা চলে । তবে ' কাঠি খোঁজাখুঁজি ' মূলত দুই প্রতিযোগীর খেলা।তাই ভাই - বোন , দাদা-দিদি প্রভৃতি সম্পর্কযুক্ত একই পরিবার ভুক্ত ছেলেমেয়েদের কাছে খেলাটি খুব প্রিয় ছিল।কারণ স্বল্প পরিসরে বাড়ির মধ্যেও খেলাটি সম্ভব। পছন্দসই কোন গণনা পদ্ধতি বা টসের প্রথমেই দুই প্রতিযোগীর মধ্যে একজনের 'মোর ' নির্ধারণ করা হয়।এই খেলায় ' মোরধারী ' ' ভজা ' নামে পরিচিত হয়। খেলায় বিপক্ষের লুকোনো কাঠি খুঁজে বের করাই 'ভজার ' কাজ।
খেলার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু বালি অথবা ধুলো এবং ছোট্ট আকারের একটি কাঠি। প্রথমে বালি অথবা ধুলো দিয়ে সহজেই লুকিয়ে ফেলা যায় সেই রকম মোটা এবং দেড় ফুট লম্বা একটি বাঁধ তৈরী করতে হয়।
'ভজার ' প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় হাতের তালুর আড়াল করে কাঠিটি ওই বাঁধের ভিতর খুব সন্তর্পনে লুকিয়ে ফেলে। 'ভজা'কে বিভ্রান্ত করতে সে এক জায়গায় কাঠিটি লুকিয়ে বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় খালি হাত চালাচালি করে।উদ্দেশ্য হোল, ঠিক কোন জায়গায় কাঠিটি লুকোনো হয়েছে তা যেন ' ভজা ' অনুমান করতে না পারে।
দুই হাত আঙুল বদ্ধ অবস্থায় বাঁধের উপর চাপা দিয়ে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের লুকোনো কাঠিটির সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করাই হোল 'ভজা'র কাজ। তার চিহ্নিত করণ সঠিক হলে বিপক্ষকে এক ' চিক ' দেওয়ার সুযোগ লাভ করে ভজা। সেক্ষেত্রে সে ' দান ' অর্থাৎ কাঠি লুকোনোর অধিকার লাভ করে। অন্যথায় তার চিহ্নিতকরণ ভুল হলে সে নিজেই এক ' চিক ' খেয়ে যায়।
'চিকে'র সংখ্যা অনুযায়ী ' গজা ' বা 'গেম ' নির্ধারিত হয়।
কত ' চিকে ' এক গজা বা ' ' গেম ' সূচিত হবে তা অবশ্য খেলা শুরুর আগেই আলোচনা স্বাপেক্ষে স্থির করে নেওয়া হয়।সেই অনুযায়ী যে নির্ধারিত পরিমাণ ' চিক ' খায় তাকেই ' গজা ' খেতে হয়। ' গজা ' খাওয়ার অর্থ হল , ' ভজা ' অর্থাৎ ' মোরধারীকে ' ভিক্ষা চাওয়ার কায়দায় প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের সামনে দু'হাত পেতে দাঁডাতে হয়। আর প্রতিপক্ষ বাঁধ থেকে ধুলো বা বালি নিয়ে তার হাত ভর্তি করে দেয়। তারপর হাতের ধুলো বা বালির মধ্যে খেলায় ব্যবহৃত কাঠিটি গুঁজে দেয়।
তারপর ' ভজার ' চোখে হাত চাপা দিয়ে ধরে কোন গোপন স্থানে ধুলো-বালি সহ কাঠিটি ফেলা করিয়ে ফের একই ভাবে তাকে খেলার স্থানে ফিরিয়ে আনে। হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখার আশংকা থাকলে রুমাল বা কাপড়ের টুকরো দিয়ে চোখ বাঁধার চলও রয়েছে।
তারপর 'ভজা'র চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে 'ভজা'কে গোপনস্থান তার থেকে ফেলে দিয়ে আসা কাঠিটি খুঁজে বের করে নিয়ে আসতে হয়।ওই সময়ে তার মনোঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটানোর উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন ছড়া বা টিকাটিপ্পনী কেটে তাকে উত্যক্ত করতে থাকে। 'ভজা'কে তা নীরবে হজম করতে হয়। সব উপেক্ষা করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গোপন স্থান থেকে কাঠিটি খুঁজে বের করতে হয় তাকে। শুধু কাঠি খুঁজে বের করলেই চলে না , গোপনস্থানে ফেলে আসা ধুলো-বালি কুড়িয়ে খেলার স্থানে ফিরিয়ে আনতে হয়।তবেই তার ' ভজা ' অর্থাৎ ' মোর ' দশা ঘোচে।অন্যাথায় নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলে ফের 'ভজা ' হতে হয় তাকে। চর্চার অভাবে হারাতে বসেছে ছেলেমেয়েদের প্রিয় এই খেলাটিও।
No comments:
Post a Comment