লুপ্তপ্রায় খেলা
( ছবি -- সোমনাথ মুস্তাফি )
পিট্টু
'পিট্টু -উ --পিট্টু-উ -- পিট্টু-উ' । এক সময় কচিকাঁচাদের গলায় ওই শব্দে মুখরিত হয়ে উঠত গ্রামগঞ্জের অলিগলি । সেই শব্দটাই আজ আর শোনা যায় না বললেই চলে।কারণ যে খেলার সুবাদে শব্দটি প্রচলিত ছিল সেই খেলাটিই আজ চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে।খেলাটির নাম ' পিট্টু।' উচ্চারণ ভেদে কোথাও কোথাও খেলাটি ' পিন্টু ' নামেও পরিচিত। ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে কিম্বা আলাদা আলাদা ভাবে ওই খেলা চলে। খেলার জন্য প্রয়োজন ছোটাছুটি করার মতো পরিসর যুক্ত জায়গা। স্থানাভাবে পাড়ার রাস্তাতেও ছেলেমেয়েদের ওই খেলায় মেতে উঠতে দেখা যেত। ৮/১০ জন করে সমান সংখ্যক খেলোয়াড় বিশিষ্ট দুটি দলে ওই খেলা হয় ।
এজন্য প্রথমে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে দুটি দল গঠন করে নিতে হয়। খেলার জন্য প্রয়োজন একটি দলে যতজন খেলোয়াড় থাকে তত সংখ্যক খোলামকুুুচি বা টালি ভাঙা ঘষে ঘষে তৈরি একটু বড় আকারের গোলাকার গুটি।আর প্রয়োজন ছোট্ট আকারের রাবারের বল।কোন দল আগে দান নেবে তা টসের মাধ্যমে স্থির করে নেওয়া হয়। মাঠ অথবা রাস্তার মাঝে চক কিম্বা কাঠি দিয়ে তৈরি করা হয় একটি গোলাকার ঘর। সেটিকে গুটির ঘর বলে। গুটির ঘর থেকে ৮/১০ ফুট দুরত্বে একটি সরলরেখা টানা হয়।সরলরেখাটি 'দানে'র ঘর হিসাবে পরিচিত।
খেলার নিয়মানুযায়ী , গুটিগুলিকে টসজয়ী দলের খেলোয়াড়রা গুটির ঘরের ভিতরে পর পর থাক দিয়ে সাজিয়ে দেয়। টসজয়ী দলের একজন বল হাতে দান নেওয়ার জন্য চলে যায় দানের ঘরে। বাকিরা গুটির ঘরের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।বিপক্ষরাও তাদের ধারে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর শুরু হয়ে যায় 'দান' নেওয়ার পালা।' দান ' নেওয়ার নিয়ম হলো , দানের ঘরে অবস্থানকারী খেলোয়াড়কে নিশানা করে বল ছুড়ে গুটি ফেলতে হয়। একজন খেলোয়াড় কত বার বল ছুড়তে পাবে তা আগে নির্ধারণ করে নেওয়া হয়। নির্ধারিত সংখ্যক বার বল ছুড়ে কোন দানকারী গুটি ফেলতে না পারলে তখন তারই দলের খেলোয়াড়রা ক্রমান্বয়ে দান নেওয়ার সুযোগ লাভ করে। কোন ক্ষেত্রে টসজয়ী দলের একজন খেলোয়াড়ও যদি নির্ধারিত সংখ্যক বারের মধ্যে বল ছুড়ে গুটি ফেলতে না পারে তাহলে প্রতিপক্ষ দল ' দান ' নেওয়ার সুযোগ লাভ করে।
তবে গুটি ফেলার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বনের ব্যাপার রয়েছে।সব সময় বল ছুড়ে গুটিঘরের কাছাকাছি যত কম সংখ্যক গুটি ফেলা যায় সেই চেষ্টা করতে হয়।কারণ তাদের দলের খেলোয়াড়দেরই বিপক্ষ দলের আক্রমণ এড়িয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে থাকা সমস্ত গুটি আগের মতোই পর পর সাজিয়ে দিতে হয়। এজন্য কম সংখ্যক গুটি কাছাকাছির মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে বিপক্ষের আক্রমণ এড়িয়ে দ্রুত গুটি সাজিয়ে ফেলার সুযোগ থাকে। আর সমস্ত গুটি পর পর সাজিয়ে দিয়ে 'পিট্টু' বা 'পিন্টু' বলে চিৎকার করে উঠতে পারলেই বিপক্ষ দল 'চিক ' খেয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ফের 'টস' জয়ী দলই দান নেওয়ার সুযোগ লাভ করে।কোথাও কোথাও আবার নতুন করে দল গঠন কিম্বা পুরোন দলেই 'টস' করে খেলার নিয়মও প্রচলিত আছে।
কিন্তু বিপক্ষের আক্রমণের মুখে পড়লেই সর্বনাশ ঘটে। বিপক্ষের আক্রমণের বিষয়টি বেশ মজাদার। ' দান ' চালকারী খেলোয়াড়ের ছোড়া বলে গুটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সাজিয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে তার দলের খেলোয়াড়রা।কিন্তু সেই সময় যদি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা বল ছুড়ে প্রতিপক্ষের কোন খেলোয়াড়ের গায়ে ছুড়ে মারতে পারে তাহলে গোটা দলটাই ' মরা ' হয়ে যায়। তখন বিপক্ষ দল ' দান ' নেওয়া সুযোগ লাভ করে। এজন্য গুটি সাজানোর সময় খুব সজাগ থাকতে হয়।কারণ প্রতিপক্ষ দলের লক্ষ্যই হয়ে উঠে তাদের বল ছুড়ে মারা।
এজন্য তারা নিজেদের মধ্যে বল লুকোলুকির কৌশল অবলম্বনও করে। অর্থাৎ গুটিঘরের কাছাকাছি গোল হয়ে দাঁড়িয়ে একজনের পোশাকের আড়ালে বল লুকিয়ে রাখে।স্বাভাবিক ভাবেই ওই খেলোয়াড়ের পোশাক উঁচূ হয়ে থাকে। তাই বাকি খেলোয়াড়রাও তারই মতো পোশাক উঁচু করে ধরে থাকে যাতে মনে হয় যেন তারই কাছে বল রয়েছে। তাই ' দানচালকারী ' দলের খেলোয়াড়রা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে । কার কাছে বল আছে তা আন্দাজ করতে না পেরে গুটি সাজানোর জন্য গুটি ঘরের কাছে যাওয়ার সাহস পায় না তারা। সেই সুযোগে বিপক্ষের খেলোয়াড়রা সবাই তাদের তাড়া করে বেড়ায়। আর তারাও ভয়ে ছুটে দুরে পালায়। তারই মাঝে গুটি সাজানোর চেষ্টা চলে।
সেই সময় যার কাছে বল নেই এমন খেলোয়াড়ও গুটি সাজাতে ব্যস্ত খেলোয়াড়কে ভয় দেখাতে তার কাছে বল আছে এমন ভান করে ছুটে আসে।তখন গুটি সাজানো ফেলে ছুটে পালনোর পথ পায় না 'দানচালকারী' দলের খেলোয়াড়রা।কিন্তু যদি আন্দাজ করতে পারে ওই খেলোয়াড়ের কাছে বল নেই তাহলে তার জারিজুরি ধরা পড়ে যায়।তখন নিরাপদে গুটি সাজিয়ে দেওয়ার সুযোগ ঘটে।কারণ যার কাছে সত্যি সত্যি রয়েছে সে হয়তো সেই সময় অন্য কোন খেলোয়াড়কে তাড়া করে দুরে চলে যায়। তাই ক্রিকেটের রান নেওয়া আটকানোর মতোই গুটি সাজানো রুখতে হয় সে বল নিয়ে গুটিঘরের দিকে ছুটে আসে কিম্বা গুটিঘরের কাছে অবস্থানকারী দলীয় খেলোয়াড়কে বলটি ছুড়ে দেয়। সেই বল নিয়ে দলীয় খেলোয়াড় যদি গুটি সাজানো কোন খেলোয়াড়কে ছুড়ে মারতে পারে তাহলেই তাদের ' দান ' নেওয়ার সুযোগ ঘটে।অন্যথায় বিপক্ষ দল গুটি সাজিয়ে ফেললে ' চিক ' খেতে হয় তাদের। আবার উল্টোটাও হতে পারে। খেলা শেষে যে দল বিপক্ষকে বেশি ' চিক ' বা পিট্টু দিতে পারে সেই দলই জয়ী হিসাবে পরিগনিত হয়।
No comments:
Post a Comment