লুপ্তপ্রায় খেলা
বাঘবন্দী
ইট , পাথরকুচি বা তেঁতুলবীজি দিয়ে বিভিন্ন রকম গুটির খেলা প্রচলিত রয়েছে । সেই খেলাগুলির মধ্যে বাঘবন্দী অন্যতম।বাঘকে বন্দী করাই ওই খেলার লক্ষ্য বলেই বোধ হয় খেলাটির নাম বাঘবন্দী। দাবার সঙ্গে বেশ কিছুটা মিল রয়েছে এই খেলার। দাবার মতোই দুজন খেলোয়াড় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই খেলায় মেতে থাকতে পারে।বড়সড় অমিল যেটা রয়েছে সেটা হল , সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দাবা খেলা আর্ন্তজাতিক মর্যাদা লাভ করেছে।
বাঘবন্দী খেলার পৃষ্ঠপোষকতা দুরের কথা , সরকারি কোন স্বীকৃতিই নেই।তাই চর্চার অভাবে খেলাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।অথচ এক সময় ছোট বড়ো সকলেরই দীর্ঘক্ষণ সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল বাঘবন্দী খেলা।বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা খেলাটির নিয়মকানুন দুরের কথা , নামই জানে না।
দাবার মতো এই খেলায় অবশ্য বাজারে কোন বোর্ড কিম্বা গুটি কিনতে পাওয়া যায় না। মেঝেতেই চক - খড়ি কিম্বা ইট কুচি দিয়ে ছক কেটে নিতে হয়। বর্গাকার ওই ঘর সোজাসুজি , লম্বালম্বি , কোনাকুনি , পাশাপাশি সহ বিভিন্ন সরলরেখায় বিভক্ত থাকে। ওইসব রেখার ছেদ কিম্বা কৌনিক বিন্দু সহ বর্গাকার ঘরটিতে সবমিলিয়ে ২৫ টি অবস্থান বিন্দু তৈরি হয়। দাবার রাজা , মন্ত্রী কিম্বা নৌকা প্রভৃতির পরিবর্তে এই খেলায় ২৫ টি সম আকৃতির ইট , পাথরকুচি , তেঁতুলবীচি বা ওই ধরণের কোন ফলের বীজ গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।খেলার পরিভাষায় ওই গুটিগুলিকে বলা হয় ছাগল। অপেক্ষাকৃত মোটা আরও দুটি গুটি লাগে ওই খেলায়।ওই গুটি দুটিকে বলা হয় বাঘ। দু'জন খেলোয়াড়ের মধ্যে কে বাঘ আর কে ছাগল হবে তা টসের মাধ্যমে ঠিক করে নেওয়া হয়।
দু'জন খেলোয়াড় মুখোমুখি বসে শুরু হয় খেলা। খেলায় বাঘের মূল লক্ষ্য হল ছাগল খেয়ে নাশ করা।আর ছাগলের লক্ষ্য ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে সৈন্য সমাবেশ করে বাঘকে বন্দী করে ফেলা।অবস্থান বিন্দুগুলিই এক্ষেত্রে ঘাঁটি হিসাবে বিবেচিত হয়।
প্রথমে ছকের মাঝামাঝি চারটি অবস্থানবিন্দুতে পাঁচটি করে ছাগল রাখা হয়। দুইদিকের ছাগলের মাঝে দুটি অবস্থান বিন্দুতে থাকে বাঘ।তারপরই শুরু হয় ছাগল খাওয়া এবং বাঘবন্দীর প্রক্রিয়া।তবে দুটি প্রক্রিয়াই খুব একটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছাগলের পক্ষে বাঘবন্দীর বিষয়টি তো যথেষ্ট মাথা খাটানোর বিষয়। বাঘের ক্ষেত্রেও প্রথম দিকে ছাগল খাওয়াটা কিছুটা সহজ হলেও যত সময় যায় তত দুরহ হয়ে ওঠে।উল্টে ভুল চালে ছাগল খেতে গিয়ে তার বন্দী হয়ে পড়ার আশংকা থাকে।
নিয়ম হলো , প্রথমে ছাগলকে একটি চাল দিতে হয়। চাল দেওয়ার অর্থ হলো চার জায়গায় থাকা ৫ টি গুটির যে কোন অবস্থানের জায়গা থেকে একটি ছাগলকে বাঘের মুখ থেকে নিরাপদ স্থানে সরানো। নিরাপদ স্থান অর্থাৎ আড়াআড়ি , কোনাকুনি বা পাশাপাশি যে কোন দিকেই সরে যাওয়া হোক না কেন সব সময় লক্ষ্য রাখতে হয় অবস্থান বিন্দু বা ঘর থেকে পরেই যেন কোন ফাঁকা ঘর না থাকে। তাহলেই বাঘ ছাগলটিকে খেয়ে অর্থাৎ টপকে সেই ঘরে অবস্থানের সুযোগ পায়। ওই ভাবে ক্রমান্বয়ে পাঁচটি করে গুটি রাখা ঘরগুলি থেকে অথবা ইতিপূর্বে সরানো গুটিও সুযোগ এবং সুবিধা মতো চাল দিতে হয়। সুযোগ সুবিধা বলতে বোঝায় বাঘের পেটে না যাওয়ার পাশাপাশি বাঘকে বন্দী করার চেষ্টা করা। বাঘকে ঘিরে চারিদিকে পরপর দুটি ছাগল বা সৈন্য বসাতে পারলেই বাঘ বাবাজী জব্দ। কারণ পিছনে ফাঁকা ঘর না থাকলে সে ছাগল খেয়ে বেরোনোর পথ পায় না।
আবার একই বাঘের মুখ থেকে একঘর বাদ দিয়ে ছাগল বসানো হলেও তা খেতে পারে না বাঘ। সেক্ষেত্রে বাঘকেও পরবর্তী দানে ছাগলের দিকে একঘর এগিয়ে যেতে হয়।নিজের দানে ছাগলও তখন এক ঘর পিছিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ লাভ করে। তবে বাঘের পেটে যাওয়া ছাগল কিন্তু ছকে থাকার সুযোগ পায় না। সে বাঘের মুঠো বন্দী হয়ে থাকে। প্রথম দিকে অবশ্য কিছু ছাগলের বাঘের পেটে যাওয়া আটকানো যায় না। কিন্তু বুদ্ধি করে চাল দিতে পারলে অর্থাৎ সৈন্যের মতো একটি ঘরের পিছনে আর একটি ঘরে ছাগল বসাতে পারলে বাঘ ছাগল খাওয়ার পর বসার ঘর পায় না।তাই তার ছাগল খাওয়াও হয় না।উল্টে সে বন্দী হয়ে পড়ে।
কিন্তু ছাগল সাজানো ভুল হয়ে গেলে তাকে বন্দী করা যায় না। নিয়মানুযায়ী , খেলায় ক্রমান্বয়ে একবার ছাগল আর একবার বাঘ দান পায়।কিন্তু কোথাও কোথাও ছাগল খেতে পারলে বাঘ ফের দান নেওয়ার সুযোগ লাভ করে। সুযোগ থাকলে অর্থাৎ এক ঘর থেকে ছাগল খাওয়ার পরও মুখের সামনে যদি ফের ছাগল পড়ে এবং তার পিছনে অবস্থান করার মতো খালি ঘর থাকে তাহলে একসঙ্গে বাঘের একাধিক ছাগল খাওয়ার নিয়মও আছে।তবে সেক্ষেত্রে একবারই ' বোনাস দান ' বা উদ্বৃত্ত দান নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি ছাগলের জন্য উদ্বৃত্ত দান নেওয়ার সুযোগ নেই। খেলা শেষে ছাগল যদি বাঘকে বন্দী করতে পারে তাহলে সে জয়ী হয়। অন্যথায় বাঘ যদি সব ছাগলকে খেতে পারে তাহলে সে জয়ী হয়।
No comments:
Post a Comment