লুপ্তপ্রায় খেলা
( ছবি -- সোমনাথ মুস্তাফি )
' তালা -চাবি '
' তালা -চাবি '
তালা বলে চিৎকার করে ওঠত কেউ । পরক্ষণেই কারও গলায় শোনা যেত চাবি বলে চিৎকার। একসময় গ্রামগঞ্জের অলিগলি মুখরিত থাকত কচিকাঁচাদের তালা - চাবি চীৎকারে। সেই চিৎকার আজ আর শোনা যায় না বললেই চলে। কারণ একসময় যে খেলার সুবাদে ছেলেমেয়েদের গলায় ওই চিৎকার শোনা যেত চর্চার অভাবে সেই খেলাটিই হারিয়ে যেতে বসেছে।অথচ ওই খেলাটি বছর ২০/২৫ আগেও ছেলেমেয়েদের খেলতে দেখা যেত। খেলাটির নাম ' তালাচাবি।'
১০/১২ জন ছেলেমেয়ে একত্রে কিম্বা আলাদা-আলাদা ভাবে ওই খেলা চলে। খেলার জন্য প্রয়োজন ছোটাছুটি করার মতো উপযুক্ত পরিসর যুক্ত স্থান। স্থানাভাবের কারণে অবশ্য বিপদজনক নয় , অর্থাৎ গরুর গাড়ি -সাইকেল ছাড়া তেমন যানবাহন চলে না এমন রাস্তাকেও খেলার জন্য বেছে নেওয়া হয়।
তবে খেলার জন্য একটা সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়।খেলতে খেলতে কেউ সেই সীমানার বাইরে চলে গেলে তার 'মোর ' হয়ে যায়।কোথাও কোথাও শাস্তি হিসাবে সেই ' দান ' অর্থাৎ ওই পর্বের খেলায় তাকে 'মরা ' খেলোয়াড় হিসাবে দর্শকের মতোই বাইরে বসে খেলা দেখতে হয়। নির্ধারিত সীমার মধ্যে ' মোর ' ঘর বলে একটি গোলাকার ঘর তৈরি করা হয়।পাতা ফোটানো বা পছন্দ সই কোন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রথমে একজন খেলোয়াড়ের ' মোর ' নির্ধারণ করা হয়।
' মোর ' নির্ধারণের পর ' মোরধারী ' তার নির্ধারিত ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। বাকি খেলোয়াড়রা তার ঘর ঘিরে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।তারপর ' মোরধারী ' তাদের ' রেডি ' বলে প্রশ্ন করে।
বাকি খেলোয়াড়রা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে তাদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ অর্থাৎ নিরাপদ দুরত্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো হয়ে গেলে ' রেডি ' বলেই জবাব দেয়। ' রেডি ' বলার পরই তারা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি সহ মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে কিম্বা টিকাটিপ্পনী কেটে ' মোরধারীকে ' রাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে।
তারপরই খেলা শুরু হয়ে যায়। খেলার নিয়ম হলো , ওইসব টিকাটিপ্পনী শুনে ' মোরধারী ' তিতিবিরক্ত হয়ে নিজের ঘর ছেড়ে ওইসব খেলোয়াড়কে ছোঁওয়ার জন্য ছুটে বেড়াবে। ছুটে গিয়ে ' মোরধারী ' যদি কাউকে নিজের নাগালের মধ্যে পেয়ে যায় অর্থাৎ ছুঁয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে তাহলে সেই খেলোয়াড়কে সঙ্গে সঙ্গে সেইখানেই মাটিতে বসে পড়তে হয়। দাঁড়ানো অবস্থায় ' মোরধারী ' তার মাথা ছুঁয়ে দিতে পারলেই তাকে ' মরা ' হয়ে খেলার মাঠ থেকে বাইরে গিয়ে বসতে হয়।কোথাও কোথাও আবার তার 'মোর ' খাটারও নিয়ম প্রচলিত আছে।সেক্ষেত্রে পূর্বের ' মোরধারী ' জীবন ফিরে পেয়ে খেলায় সামিল হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
অন্যথায় 'মোরধারী ' ছুটে গিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে ' তালা ' বলে চিৎকার করে ওঠে। সেক্ষেত্রে ওই খেলোয়াড় ' মরা ' কিম্বা ' মোর ' হিসাবে গন্য হয় না।
কিন্তু অনিদ্দিষ্ট কাল তাকে ওইভাবেই তালা বন্ধ অবস্থায় বসে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্যান্য খেলোয়াড়দের কেউ চাবি দিয়ে তার তালা খুলে না দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত ওইভাবে বসে তাকেও কার্যত দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হয়।তালা খোলার অর্থ হলো কোন একজন খোলোয়াড়কে ' মোরধারীর ' নাগাল কিম্বা ছোঁওয়া এড়িয়ে তার মাথায় হাত রেখে চাবি বলে চিৎকার করে উঠতে হবে।তবেই তালা চিহ্নিত খেলোয়াড় মুক্ত হয়ে খেলায় সামিল হওয়ার সুযোগ লাভ করে।
তবে চাবি নিয়ে তালা খুলতে যাওয়া কোন খেলোয়াড়কে যদি 'মোরধারী' তাড়া করে ছুঁয়ে ফেলতে পারে তাহলে তার ' মোর ' দশা শুরু হয়ে যায়।অন্যথায় যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত খেলোয়াড়কে তালা দেওয়ার কাজ সম্পূর্ণ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত 'মোর ' খাটতে হয় 'মোরধারীকে।' খেলাটি কোথাও কোথাও ' তালাবন্দী ', ' কুলুপ- কুলুপ ' সহ বিভিন্ন নামেও পরিচিত। কিন্তু সব নামগুলিই ভুলতে বসেছে বর্তমান প্রজন্ম।
No comments:
Post a Comment