লুপ্তপ্রায় খেলা
( ছবি -- সোমনাথ মুস্তাফি )
লাললাঠি ও লাঠি গাদাগাদি
লাললাঠি ও লাঠি গাদাগাদি
খেলা দুটি মূলত রাখাল বালকদের খেলা। এক সময় রাখাল বালকদের মধ্যে খেলা দুটির ব্যাপক প্রচলন ছিল।মাঠে গরু চড়াতে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য রাখাল বালকদের ওই খেলায় মেতে উঠতে দেখা যেত।কখনও কখনও খেলতে খেলতে গরু চড়ানোর কথা বেমালুম ভুলে যেত রাখাল বালকেরা।তখন গরুতে জমির ফসল খাওয়ার জন্য চাষির বকুনি এমন কি মার পর্যন্ত খেতে হত।অন্যথায় গরু খোঁয়াড়ে গেলে মুনিবের কাছে একই শাস্তি প্রাপ্য হত।খোঁয়াড় থেকে গরু ছাড়ানোর জরিমানার টাকাও রাখাল বালকদের প্রাপ্য বেতন থেকে কেটে নেওয়ার ঘটনাও ঘটত।আর তারই জেরে বাবা-মায়ের কাছেও শাস্তি বরাদ্দ ছিল রাখাল-বালকদের।তবুও সব ভুলে ফের খেলায় মেতে উঠত রাখাল বালকেরা।
বর্তমানে যন্ত্রের বহুল ব্যবহারের কারণে গৃহস্থের গোয়াল থেকে হারিয়ে গিয়েছে গরু। কমে গিয়েছে গোচারণ ভূমিও।তাই গরুর পাল নিয়ে রাখালদের মাঠে যাওয়া আর গোধূলি বেলার পড়ন্ত আলোয় ফেরার সেই ছবিটাও হারিয়ে যেতে বসেছে। আর তারই সঙ্গে রাখাল বালকদের সেই প্রিয় খেলা দুটিও হারিয়ে যেতে বসেছে। খেলা দুটির নাম ' লাল লাঠি ' বা 'লালাঠি' এবং ' লাঠি গাদাগাদি ' বা ' গাই গোদানি।' বিভিন্ন জায়গায় খেলা দুটির ভিন্ন নামও প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নিয়মকানুনও।
তবে ' লাল লাঠি' খেলায় অধিকতর প্রচলিত নিয়মটি হচ্ছে , প্রথমেই একজনের ' মোর ' নির্ধারণ করা হয়।এক্ষেত্রে 'মোর ' নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি বেশ বৈচিত্রপূর্ণ। এজন্য রাখালবালকদের পাঁচনগুলি ( গরু ডাকানোর জন্য বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি ফুট ২/৩ লম্বা সুন্দর মসৃণ লাঠি ) একত্রিত করা হয়। তারপর পাঁচনগুলি ছুড়ে দেওয়া হয় উপরের দিকে।যার পাঁচন সব থেকে আগে মাটিতে পড়ে সে নিরাপদ অবস্থানে অর্থাৎ ' মোর ' আওতার বাইরে চলে যায়।ওই ভাবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় একে একে বাকি সব খেলোয়াড় ' মোর ' আওতার বাইরে চলে যাওয়ার পর শেষজনকে ' মোর ' বরণ করতে হয়। ' মোর ' নির্ধারণ হয়ে যাওয়ার পর ' মোরধারীকে ' তার পাঁচনটির দুই প্রান্ত দু'হাত দিয়ে হালকা করে ধরে তুলে রাখতে হয়।সেই অবস্থায় বাকি খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ একজন তার নিজের পাঁচন দিয়ে ' মোরধারীর' পাঁচনটিকে দুরের দিকে ছুড়ে দেয়।বাকিরাও নিজ নিজ পাঁচন দিয়ে সেই পাঁচনটিকে আরও দুরে পাঠানোর চেষ্টা করে।কিন্তু এক্ষেত্রে ওইসব খেলোয়াড়দের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন।
' মোরধারীর ' লাঠি দুরে পাঠানোর সময় নিজ নিজ পাঁচনের একটি প্রান্ত নিরাপদ স্থানে স্পর্শ করিয়ে রাখতে হয়।জমির মধ্যে থাকা কেটে নেওয়া ধান গাছের গোঁড়ার অংশ , ইট , পাথর , গাছের ডাল কিম্বা প্ল্যাস্টিক সামগ্রীর অংশ বিশেষ নিরাপদ স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়।পাঁচন দুরে পাঠানোর সময় ' মোরধারী ' কোন খেলোয়াড়ের দিকে ছুটে গেলেই সেই খেলোয়াড়কে দ্রুত নিজের পাঁচনের একটি প্রান্ত ওইসব নিরাপদ স্থানে ঠেকিয়ে দিতে হয়। নাহলে 'মোরধারী' ছুঁয়ে দিলেই 'মোর' খাটতে হয় সেই খেলোয়াড়কে। আর 'মোরধারীর ' খেলায় সামিল হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ এক্ষেত্রে শুধু কাউকে ছুঁয়ে দিতে পারলেই ' মোর ' দশা ঘোচে না। দুরে পাঠানো পাঁচন ' মোরধারীকে ' না ধরে মাথায় নিয়ে খেলা শুরুর জায়গায় পৌঁছে দিতে হয়
।যদি ওইভাবে নিয়ে আসার সময় পাঁচন মাটিতে পড়ে যায় তাহলে ছোঁওয়া পড়া খেলোয়াড় বাদে বাকিরা ফের একই প্রক্রিয়ায় তা দুরে পাঠানোর সুযোগ পায়।' মোড়ধারীও' একইভাবে অন্যদের ছুঁয়ে 'মারার' সুযোগ লাভ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ' মোরধারী ' নির্বিঘ্নে তার পাঁচন যথাস্থানে পৌঁছে দিতে না পারে ততক্ষণ তার মোর দশা ঘোঁচে না।কিন্তু ঠিকঠাক পাঁচন পৌঁছে দিতে পারলেই মোরধারী প্রথম যাকে ছুঁয়েছিল তাকেই বরণ করে নিতে হয় ' মোর '। কোথাও কোথাও আবার প্রতিবার লাঠি পড়ে যাওয়ার জন্য একজন করে ' মরা ' খেলোয়াড়ের জীবন ফিরে পাওয়ার নিয়ম চালূু রয়েছে। সেক্ষেত্রে সফল ভাবে পাঁচন পৌঁছোনোর পর অবশিষ্ট ' মরা ' খেলোয়াড়দের মধ্যে যে আগে মরেছে তাকেই বরণ করে নিতে হয় 'মোর।'
লাঠি গাদাগাদি খেলাটির জন্য বেছে নেওয়া হয় সদ্য শুকিয়ে যাওয়া পাঁক যুক্ত পুকুর -গড়ে , ভেজা নরম জমি প্রভৃতি। ৭/৮ জন রাখালবালক মিলে ওই খেলা চলে। ' মোর ' নির্ধারণের মতোই এই খেলায় পাতা ফোটানো বা ওই ধরণের কোন পদ্ধতির সাহায্যে একজনকে দলপতি নির্বাচন করা হয়। একই ভাবে অন্যরাও কে কার পর দান নেবে তাও নির্ধারণ করে নেওয়া হয়। তারপর একটি নির্ধারিত দুরত্ব থেকে দলপতি তার পাঁচনটিকে সজোরে ছুড়ে ভেঁজা মাটিতে গেঁথে দেয়।
পরবর্তী খেলোয়াড় ন দলপতির পাঁচনটিকে নিশানা করে নিজের পাচঁনটি ছুড়ে মারে। লক্ষ্য থাকে তার পাঁচনের আঘাতে যেন দলপতির পাঁচনটি অনেকটা গুণ চিহ্নের মতো পাশে গিয়ে বসে যায় বা কাত মেরেশুয়ে পড়ে। তাহলেই দলপতির পাঁচনটি তার হয়ে যায়।অন্যথায় দলপতি নিজের পাঁচনটি তুলে নিয়ে দ্বিতীয় জনের পাঁচন একই কায়দায় তাক করে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যার চেষ্টা সফল হয় সে দখল করা পাঁচন নিজের হাতে রেখে নিজের পাঁচনটি নিয়ে একইভাবে তৃতীয় জনের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠে।যদি প্রথমোক্ত দু'জনই একে অন্যের পাঁচন করায়ত্ত করতে ব্যর্থ হয় তখন তৃতীয় জন একে একে তাদের দুজনের পাঁচন একই কায়দায় করায়ত্ত করার সুযোগ লাভ করে।কিন্তু সেও ব্যর্থ হলে ক্রমান্বয়ে পরবর্তী জন সুযোগ পায়।আবার সফল হলেও পরবর্তী জনের সঙ্গে তাকে একই ভাবে চ্যালেঞ্জ লড়তে হয়।
ওইভাবে ধারাবাহিক পদ্ধতিতে যে খাোলোয়াড় সমস্ত পাঁচন করায়ত্ত করে সে একে একে সমস্ত পাঁচন দুরে ছুড়ে ফেলে দেয়। আর খেলোয়াড়রা নিজ নিজ পাচঁন খুঁজতে ছোটে।সেই ফাঁকে সমস্ত পাঁচন জয়ী খেলোয়াড় তার নিজের পাঁচনটিও কোন গোপন স্থানে লুকিয়ে দেয়। নিয়ম হলো , নিজ নিজ পাঁচন খুঁজে নিয়ে এসে সমস্ত খেলোয়াড়কে গোপনস্থান থেকে বিজয়ীর পাঁচনটি খুজেঁ বের করতে হয়।তারপর নিজের পাঁচন সেই পাঁচনটিকে স্পর্শ করাতে হয়।সবার শেষে যে খেলোয়াড় বিজয়ীর পাঁচন স্পর্শ করায় তাকে মাথায় করে বিজয়ীর পাঁচন পৌঁছে দিতে হয়।পড়ে গেলেই বাকিরা সেই পাঁচন নিজেদের পাঁচন দিয়ে ফের দুরে পাঠানোর চেষ্টা করে।বিজয়ীর পাঁচন পৌঁছে দিতে না পারা পর্যন্ত ওই খেলোয়াড়ের নিস্কৃতি মেলে না। বিজয়ীর কাছে তার পাঁচন দিলে তবেই নতুন করে খেলা শুরু হয়।কোথাও কোথাও পাঁচন পৌঁছে দেওয়ার পর শেষোক্ত খেলোয়াড়েরই খেলা শুরু করার নিয়ম প্রচলিত আছে।
No comments:
Post a Comment