লুপ্তপ্রায় খেলা
' ঘুটিং খেলা '
' মাঠান ' অর্থাৎ এঁটেল মাটি যুক্ত এলাকায় ছোট ছোট সাদা পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। একসময় আদিবাসীরা বিশেষ কায়দায় ওই পাথর পুড়িয়েই খৈনি খাওয়ার জন্য চুন তৈরি করতেন।চুন - সুরকির গাঁথনির বাড়ি তৈরির জন্যও বড় বড় চুল্লিতে ওই পাথর পুড়িয়েই চুন সংগ্রহ করা হত। ওই চুনাপাথরকে স্থানীয় ভাষায় ' ঘুটিং' বলা হয়। আর সেই পাথর দিয়ে একটি খেলার প্রচলিত নামই হলো ' ঘুটিং খেলা।' চর্চার অভাবে ওই খেলাটিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
ঘুটিং মূলত মেয়েদের খেলা।তবে কখনও কখনও দিদি কিম্বা বোনের সঙ্গে একেবারে বাচ্চা বয়সের ছেলেদেরও খেলতে দেখা গিয়েছে। খেলার জন্য প্রয়োজন ছোট আকারের ৫ টি ঘুটিং। খেলার আগে সেগুলিকে ঘষে ঘষে গোলাকার এবং মসৃণ করে নেওয়া হয়। ঘুটিংয়ের অভাবে ইট কিম্বা পাথরকুচির গুটি ব্যবহারেরও চল রয়েছে।সেক্ষেত্রেও খেলাটিকে ঘুটিং খেলাই বলে। এককভাবে নুন্যতম দু'জন বা ততোধিক খেলোয়াড় নিয়ে খেলা চলে।আবার জোড়ায় জোড়ায় জুটি বেঁধেও খেলা হয় । দু'জনের অধিক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে গোলাকার হয়ে বসে খেলা হয়। সেক্ষেত্রে প্রথমজনের খেলা সম্পূর্ণ হলে তার বাঁ পাশে থাকা খেলোয়াড় দান পায়। ওইভাবে চক্রাকারে বাঁ দিকে ' দান ' আবর্তিত হতে থাকে। দু'জন হলে মুখোমুখি দু'পা ছড়িয়ে বসে খেলতে দেখা যায় খেলোয়াড়দের। ঠাকুরদালান , বাড়ির ছাদ কিম্বা ফাঁকা বারন্দা ওই খেলার উপযুক্ত জায়গা হিসাবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন জায়গায় খেলার বিভিন্ন নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। ওই খেলাকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন রকম মজার মজার ছড়াও।এলাকা ভেদে ছড়াতেও ভিন্নতা রয়েছে।
সাধারনত সাতটি পর্যায় রয়েছে ঘুটিং খেলায়। পর্যায়গুলি হলো - মুই ,বড্ডু ,ছক্কু ,ফুল , ঝাপল, ভাই আর গজা। প্রতিটি পর্যায়ে পাঁচবার চাল নিতে হয়। মুলত শুন্যে গুটি ছোড়া এবং মাটিতে গুটি ছড়িয়ে তুলে নেওয়াই খেলার লক্ষ্য। তবে প্রতিটি পর্যায়ে গুটি তুলে নেওয়া এবং ছোড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। অন্যান্য খেলার মতোই এই খেলাতেও কে বা কোন দল আগে দান নেবে তা ঠিক করে নেওয়া হয় টসের মাধ্যমে।নিয়ম হলো , দানচালকারী ঘুটিংগুলি দু'হাতে নিয়ে একটি উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে বাকি চারটি মাটিতে নামিয়ে দেবে। পাশাপাশি ছুড়ে দেওয়া ঘুটিংটি মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিতে হবে।তারপর সেই ঘুটিংটিই ফের উপর দিকে ছুড়ে নিচের ঘুঁটিটিগুলি কুড়িয়ে নিয়ে সেটিকেও মাটিতে পড়ার আগে একই সঙ্গে লুফে নিতে হয়। পরে সব ঘুটিংগুলি নিজের সামনে ছড়িয়ে দিতে হয়। সেখান থেকে একটি বেছে নিয়ে একই কায়দায় সেটিকে উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে লুফে নেওয়ার পাশাপাশি একটিকে ফেলে রেখে তিনটিকে একত্রে হাতে তুলে নিতে হয়।তারপর ফের সেগুলিকে ছড়িয়ে দিয়ে মটিতে পড়ে থাকা ঘুটিংটিকে নিয়ে একই কায়দায় উপরের দিকে ছুড়ে অন্য একটি ঘুটিং ফেলে বাকি তিনটি সহ উপরের দিকে ছোড়া ঘুটিংটি কুড়িয়ে নিয়ে নিতে হয়। শেষে একটি ঘুটিং উপরের দিকে ছুড়ে সেটি লুফে নেওয়ার পাশাপাশি মাটিতে পড়ে থাকা ঘুটিংটিও তুলে নিয়ে নিজের হাতে পাঁচটি ঘুটিং সংগ্রহ করে নিতে পারলেই ' মুই ' পর্যায়ের খেলা শেষ হয়।ওই পর্যায় চলাকালীন দানচালকারীকে মুই তেল্লা একটা , দুই তেল্লা দুটি , তিন তেল্লা তিনটে , চার তেল্লা চারটে , পাঁচ তেল্লা পাঁচটা বলে ছড়া আউড়ানোর মতো আউরাতে শোনা যায়।ওই ধরণের ছড়া আউরানোর মাধ্যমে খেলায় মনোযোগ এবং গতি আসে বলে মনে করা হয়।
মুইয়ের পর শুরু হয় বড্ডু পর্যায়। ওই পর্যায়ে প্রথমে সব ঘুটিংগুলি ছড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর একটি উপর দিকে ছুড়ে সেটি নিচে পড়ার আগেই লুফে নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা দুটি ঘুটিং তুলে নিতে হয়। সেখান থেকেই একটি ছুড়ে একই কায়দায় একটি তুলে নিতে হয়। তারপর হাতের চারটিকে মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে আগে মাটিতে পড়ে থাকা ঘুটিংটি কুড়িয়ে উপরের দিকে ছুড়ে দিয়ে প্রথমে দুটি হাতে তুলে তার মধ্যে একটি ছুড়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা বাকিটিকেও তুলে নিতে পারলেই বড্ডু পর্যায় শেষ।এক্ষেত্রেও দান চালার পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে মুইয়ে বড্ডু একটা , মুয়ে বড্ডু -- দুটি , মুয়ে বড্ডু -- তিনটি , মুয়ে বড্ডু--চারটি এবং মুয়ে--বড্ডু পাঁচটি বলে ছড়া আউরানোর চল রয়েছে।বড্ডুর পরে আসে ছক্কু পর্যায়।ওই পর্যায়ে দানচালকারী হাতে ঘুটিংগুলি তুলে নিজে ফু দিয়ে অন্যদের মুখের সামনে ধরবে। তারাও ঘুটিংগুলিতে ফু দেবে । তারপর দানচালকারী আগের মতোই ঘুটিংগুলি সামনে ছড়িয়ে দেবে।তার মধ্যে একটি তুলে উপরে ছুড়ে দেবে । সেটি পড়ার আগে লুফে নিয়ে মাটি থেকে প্রথমে একটি তুলে নেবে। পরে হাতের মধ্যে সংগৃহিত একটি ঘুটিং ছুড়ে আরও দুটি তুলবে । শেষে হাতের চারটি ছড়িয়ে দিয়ে যেটি পড়ে ছিল সেইটি তুলে উপরের দিকে ছুড়ে প্রথমে একটি তার দুটি তারপর একটি তুলে নেবে । প্রতিবারই একটি করে ঘুটিংটি ছুড়েই ওই ভাবে লুফতে হয়। তাহলেই ছকু পর্যায় সমাপ্ত হয়। এক্ষেত্রেও ' ছক্কু মক্কু দাদাটি / গায়ে গুচ্ছের কাদাটি / গা ধুয়ে এসো গা / তেল মাখিয়ে দেব গা / গা মুছিয়ে দেব গা / কোলে তুলে নেব গা / ছড়া আউরানো হয়।
ফুল পর্যায়েও নিজের ফু সহ অন্যদের ফু নিয়ে আগের মতোই ঘুটিং ছড়িয়ে দিতে হয় । তারপর একটি ঘুটিং তুলে উপরের দিকে একটি করে ছুড়ে পরপর তিনটি ঘুটিং তুলে নিতে হয়। তারপর হাতের চারটি ছড়িয়ে দিয়ে পড়ে থাকাটি ক্রমান্বয়ে তুলে উপরের দিকে ছুড়ে ছুড়ে একটি একটি করে সব ঘুটিং তুলে নিতে হয়। একই প্রক্রিয়া ৪ বার হবে । পাঁচবারের সময় একটি করে তুলে উপরের দিকে ছুড়ে একসংগে সবগুলিকে তুলে নিতে হয়। পাশাপাশি চলে ' ফুল টন টন ফুলের রশি / বট তলায় গিয়ে বসি / বটের আঁঠা পড়ে / জান ধুক ধুক করে / দাদু দিদিমা বসে আছে ঘরে ' জাতীয় ছড়া আউরানো।তারপর আসে ঝাপল পর্যায়।ওই পর্যায়ে আগের মতোই ঘুটিং ছড়িয়ে দেওয়ার পর সেগুলির থাকা মধ্যে থেকে একটি ছুড়ে দিয়ে মাটি থেকে একটি এবং ক্রমান্বয়ে একসঙ্গে দুটি ছুড়ে দুটি, তিনটি ছুড়ে তিনটি তুলে নেওয়া হয়। শেষে চারটি ছুড়ে চার নংটি তুলে নেওয়ার পর সবগুলি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে মাটিতে থাকা ৫ নং টি তুলে উপরে ছুড়ে একটি তুলে দুটি ছুড়ে তিন নং তিনটি ছুড়ে ৪ নং এবং শেষে চারটি ছূড়ে ৫ নং টি তুলে নিতে পারলেই ওই পর্ব শেষ হয় । এই পর্বে আউরানো হয় ' ঝাঁপ ঝাঁপ ঝাপলি / মামার বিটি কাকলি / ধান ভাঙ্গে সীতারাম / সেঁকে দিচ্ছে বলরাম / বুড়োবুড়ি পাঁচখান ' জাতীয় ছড়া।
' ভাই' পর্যায়ে প্রথমে সব ঘুটিংটিগুলি তালুতে নিতে হয়। তারপর একসঙ্গে উপর দিকে ছড়িয়ে দিয়ে হাত ঘুরিয়ে অর্থাৎ তালুর উল্টো দিকে লুফে নিতে হয়।ফের উপরে ছুড়ে হাত সোজা করে তালুর মধ্যে লুফে নিতে হবে। কিন্তু হাতের তালুর উল্টো দিকে লুফে নেওয়ার সময় যদি এক বা একাধিক গুটি পড়ে যায় তাহলে হাতের তালুর উল্টো দিকে থাকা অবস্থাতেই একটি ঘুটিং রেখে বাকিগুলি কাছাকাছি মাটিতে সাজিয়ে দিতে হয়। সাজানোরও কায়দা রয়েছে।হাতের উল্টো পিঠে থাকা ঘুটিংগুলি পড়ে যাওয়া ঘুটিং থেকে সামান্য দুরে একটি রেখে মাঝে দুটিকে একত্রে রাখতে হয়। এবার হাতের ঘুটিংটি উপরে ছুড়ে ক্রমান্বয়ে চার বার জোড়া ঘুটিংটি তুলে পঞ্চম বারে সবগুলিকে তুলে নিতে পারলেই ভাই পর্যায় শেষ হয়।তবে পাশের গুটি দুটিতে জোড়া যদি বসানোর সময় ঠেকে যায় তাহলে মোর হয়ে যায়।গজার ক্ষেত্রে দানচালকারী গজা হিসাবে একটি ঘুটিং প্রতিপক্ষকে ধরতে দেয়। সেক্ষেত্রে চারটি গুটি নিয়ে খেলা শুরু হয়। সেক্ষেতে একটি ছুড়ে তিনটি নামিয়ে দেবে। একই ভাবে চার বারের পর বিপক্ষ গজা মানে ঘুটিংটি খেলার স্থলে বসিয়ে দেবে। তখন দানচালকারী একটি ঘুটিং ছুড়ে সবগুলিকে তুলে নিতে পারলেই গজা খেয়ে যায় বিপক্ষ । গজার ক্ষেত্রেও ' মম গজার গাছটি ধরো / দ্রব্য গজার গাছটি ঢোড় / গজার গাছের নেই চর্ম / গজার গাছটি ঘরে / জোড়া লাগে না পরে ' জাতীয় ছড়া আউরানো হয়। গজা স্বীকার করিয়ে নেওয়ারও নিয়ম রয়েছে। দানচালকারী জিজ্ঞেস করবে --- এলু / প্রত্যুত্তরে বিপক্ষেও বলতে হবে এলু / তখন দান চালকারী তাচ্ছিল্যের সংগে বলে, বসে বসে এক গজা খেলু / বিপক্ষ বলে - গজা খেলু। গজা শেষে পরের জন বা পরের জুটি দান নেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু যেকোন পর্যায়ে একটি গুটি তোলার সময় অন্যগুটি নড়ে গেলে বা গুটি লুফে নেওয়া ব্যর্থ হলে তার আর দান নেওয়া হয় না। তখন বিপক্ষ খেলোয়াড় বা জুটি দান নেওয়ার সুযোগ লাভ করে। তবে কোথাও অন্য নিয়মও চালু আছে। ওই নিয়মানুযায়ী জোড়ায় জোড়ায় খেলায় সঙ্গী খেলোয়াড় মাঝপথে ওই দুই কারণে খেলা সম্পূর্ণ করতে অকৃতকার্য হলে সহযোগী নিজের দান সম্পূর্ণ করে অকৃতকার্য সঙ্গীর দান নিয়েও গজা করে পারে ।
No comments:
Post a Comment