লুপ্তপ্রায় খেলা
( ছবি -- সোমনাথ মুস্তাফি )
' বুড়ির লাঠি '
' -- বুড়িমা বুড়িমা যাচ্ছ কোথায় ?
-- যাচ্ছি আমি গঙ্গাস্নানে ।
-- সে তো বহুদুর ।
--- হলেই বা , উপায় কি আছে ?
--- কেন , এইতো আছে পুকুর কাছে ।
--- পুকুর তো ছোট্ট বড়ো।
--- এসো পয়সা ফেলে বড়ো কর।'
ছড়ার মতো করেই প্রশ্নোত্তরের কায়দায় একসময় কচিকাঁচাদের মুখে মুখে ফিরত ওই শব্দবন্ধগুলি। এখন আর তেমন একটা শোনা যায় না বললেই চলে। আসলে যে খেলার সুবাদে কচিকাঁচারা ওই ছড়া আউড়াত , চর্চার অভাবে সেই খেলাটিও এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। খেলাটির নাম ' বুড়ির লাঠি।' কোথাও কোথাও খেলাটির ভিন্ন নামও প্রচলিত রয়েছে। গঙ্গাস্নানযাত্রী বুড়িকে আটকে তার লাঠি হাতানোটাই ওই খেলার মূল লক্ষ্য।
১০/১২ জন ছেলেমেয়ে একত্রে অথবা আলাদা আলাদা ভাবে ওই খেলা চলে। খেলার জন্য প্রয়োজন ১০/১২ জন ছেলেমেয়ের বৃত্তাকারে ঘোরা এবং ছুটে পালানোর মতো পরিসর যুক্ত স্থান।অন্যান্য খেলায় 'মোর' নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতি অনুসারে এই খেলাতেও একজন খোলোয়াড়কে ' বুড়ি ' নির্বাচন করা হয়। তবে অন্যান্য খেলায় 'মোর' হওয়াটা দুর্ভাগ্যের হলেও এই খেলায় ' বুড়ি ' হওয়াটা কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার হিসাবে বিবেচিত হয়। কারণ ' বুড়ির লাঠি'টিই এই খেলায় সব থেকে আর্কষণীয় সামগ্রী। অন্যান্য খেলায় ' মোর ' এড়াতে মোরধারীর ছোঁওয়া বাঁচাতে অন্যান্য খেলোয়াড়দের ছুটে পালাতে হয়। আর এই খেলায় লাঠি হাতানোর জন্য অন্যান্য খেলোয়াড়দেরই 'বুড়ির ' পিছনে ছুটতে হয়।
' বুড়ির লাঠি ' মূলত একক কৃতিত্ব অর্জনের খেলা। একটি ' গেমে ' যে সব থেকে বেশি লাঠি হাতাতে পারে সেই বিজয়ী হয়। সর্বাধিক কত সংখ্যক লাঠি হাতানোর পর একটি গেম ধরা হবে তা খেলার প্রথমেই নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ঠিক করে নেওয়া হয়।খেলার নিয়ম হল , ' বুড়ি ' ছাড়া বাকি খেলোয়াড়রা হাত ধরাধরি করে বৃত্তাকারে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। সেখান থেকে ৩০/৪০ ফুট দুরে মাটিতে দাগ টেনে একটি ঘর কাটা হয়।ঘরটিকে বলা হয় ' বুড়ির ঘর।' সেই ঘর থেকেই ' বুড়ি ' লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কাল্পনিক গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আর তখনই শুরু হবে উপরিউক্ত প্রশ্নোত্তর। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর ' বুড়ি ' এসে খেলোয়াড়দের বৃত্তের মাঝে পয়সা হিসাবে একটি ' খোলামকুচি ' ফেলে দেবে।আর সঙ্গে সঙ্গে ওই সব খেলোয়াড়রা তাদের হাত প্রসারিত করে বৃত্তটি আরও বড় করে তুলবে।
সেই বৃত্ত অর্থাৎ জলাশয়ে স্নান করার জন্য একজন হাতের বাঁধন খুলে 'বুড়িকে' ঢো
কার সুযোগ করে দিয়েই ফের পরস্পর শক্ত করে নিজেদের হাত ধরে নেবে। কিছুতেই আর 'বুড়িকে' বাইরে যেতে দেবে না।' বুড়ি ' তখন বৃত্তের ভিতের পাকে পাকে ঘুরে একে একে খেলোয়াড়দের দুহাতের বাঁধনে ঝাঁকুনি দিয়ে বলবে ' এই বাঁধটি কাটব।' প্রত্যুত্তরে অন্যান্য খেলোয়াড়রা সমস্বরে বলে উঠে ' শিল ছুড়ে মারব।' কখনও বা ' নোড়া ' কিম্বা ' পাথর ' ছুড়ে মারবও বলা হয়।
ওই ভাবে উতোরচাপানের মাধ্যমে কোন খেলোয়াড়ের অন্যমনস্কতার সুযোগ পেলেই বাঁধ কেটে অর্থাৎ হাতের বাঁধন ছিন্ন করে ' বুড়ি ' লাঠি নিয়ে তার ঘর অভিমুখে ছুটে পালানোর চেষ্টা করে। আর বাকি খেলোয়াড়রা তখন নিজেদের হাতের বাঁধন ছেড়ে ' বুড়ির ' পিছু ধাওয়া করে।
' বুড়ি'কে তার ঘরে পৌঁছোনোর আগে যে প্রথম ছুঁতে পারে সেই খেলোয়াড় পায় লাঠির দখল।পাশাপাশি সেই খেলোয়াড়ই হয় পরবর্তী ' বুড়ি। ' সেক্ষেত্রে তার একটি লাঠি বা পয়েন্ট সংগৃহিত হয়। অন্যথায় ' বুড়ি ' কারও ছোঁওয়া এড়িয়ে নিজের ঘরে পৌঁছতে পারলেই তার একটি ' পয়েণ্ট ' সংগৃহিত হয়। ফের ' বুড়ি ' হওয়ারও সুযোগ লাভ করে সে। কখনও কখনও লাঠি হাতাতে সবার আগে দৌড়ানোর সুযোগ নেওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে হাতের বাঁধন আলগা করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। সেক্ষেত্রে অসৎ উপায় অবলম্বনের জন্য অভিযুক্ত খেলোয়াড়কে একটি ' গেমের ' জন্য বরখাস্ত করারও নিয়ম রয়েছে। একটি গেমে যে সর্বাধিক লাঠি বা ' পয়েন্ট ' সংগ্রহ করতে পারে সেই খেলোয়াড় বিজয়ী হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
No comments:
Post a Comment