লুপ্তপ্রায় খেলা
' গুটির খেলা '
বাসস্ট্যান্ড কিম্বা রেলস্টেশনে অপেক্ষামান যাত্রী , হাসপাতালে রোগীর পরিজন কিম্বা আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া মানুষজনের কাছে এককালে সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম ছিল বিভিন্ন গুটির খেলা। কারণ এই খেলার জন্য তেমন কিছু উপকরণ এবং জায়গা লাগে না বললেই চলে।সব ধরণের গুটির খেলাই মূলত দুজনে খেলা হয়।তাই দুজনে মুখোমুখি বসার মতো জায়গা হলেই চলে।তবে অন্যান্য খেলার মতো পক্ষে-বিপক্ষে দু'চারজন উৎসাহদাতা দর্শক না থাকলে খেলা ঠিক জমে না। সেক্ষেত্রে খেলার জন্য আর একটু পরিসর যুক্ত জায়গা হলেই ভালো হয়। খেলা অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন দু'রঙের গুটি অর্থাৎ ইট কুচির সঙ্গে পাথরকুচি কিম্বা কালো রঙের তেঁতুলবীচির সঙ্গে লাল রঙের চন্দনের ফল বা ওই জাতীয় গুটি হলেই চলে। মাটিতে কিম্বা কংক্রিটের চাতালে ছক কেটে ওই খেলা হয়। মুলত গ্রামাঞ্চলেই গুটির খেলা প্রচলিত ছিল। খেলাটা এতটাই প্রিয় ছিল যে , বাড়িতে সিমেন্টের কাজ করার সময় অনেকে যেমন ফুল-লতা পাতা কিম্বা দেবদেবীর ছবি আঁকিয়ে নিতেন তেমনই গ্রামাঞ্চলে পুকুটঘাট , উঠোন , সেতু কিম্বা পুকুরের গার্ডওয়াল বাঁধাই করার সময় গ্রামবাসীরা রাজমিস্ত্রীর কাছে আবদার করে গুটিখেলার ছক তৈরি করে নিতেন।তারপর সেই ছকেই বছরের পর বছর চলত খেলা। চর্চার অভাবে ওইসব গুটির খেলা আর চোখে পড়ে না বললেই চলে। কিন্তু আজও চোখ মেলে চাইলেই বহু জায়গায় দেখা যায় সিমেন্ট চিঁড়ে কাটা সেদিনের সেই গুটি খেলার ছক।আর ওইসব ছক দেখেই রীতিমতো নস্টালজিক হয়ে পড়েন বহু প্রবীণ মানুষ। একসময় কৌশোর কিম্বা যৌবনে ওইসব ছকেই গুটি খেলেছিলেন তারা।


( ন ' গুটি )
( তিন গুটি )
গুটির সংখ্যা অনুযায়ী মূলত তিন গুটি , ন'গুটি আর ষোল গুটি নামে তিন ধরণের গুটির খেলা প্রচলিত রয়েছে। তিনটি খেলায় ছকও তিন ধরণের। গুটিরখেলা সাধারণত ছেলেদের খেলা।তবে তিনগুটির খেলায় মেয়েদেরও অংশ নিতে দেখা যেত।তিনগুটি মূলত কচিকাঁচাদেরই খেলা।
ওই খেলায় প্রায় ১/১ ফুট বর্গাকার ঘরকে কোনাকুনি , পাশাপাশি এবং লম্বালম্বি চারটি রেখা দ্বারা ভাগ করে ৯ টি ঘর বিশিষ্ট ছক কাটা হয়। দুজন খেলোয়াড় নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী রঙের তিনটি করে গুটি সংগ্রহ করে নেয়। কে আগে দান নেবে তা টসের মাধ্যমে ঠিক করে নেওয়া হয়।তারপর ছকের মুখোমুখি বসে দুই খেলোয়াড় নিজ নিজ সামনের তিনটি ঘরে নিজেদের গুটি সাজিয়ে নিয়ে খেলা শুরু করে। উভয়ের সামনেই গুটি সরানোর জন্য সাকুল্যে তিনটি ঘর থাকে। কিন্তু টসজয়ীই প্রথমে ওই তিনটি ঘরের মধ্যে নিজের একটি গুটি সরানোর চাল দেওয়ার সুযোগ পায়।
সে চাল দেওয়ার পর প্রতিপক্ষ গুটি সরানোর সুযোগ পায়। গুটি সরানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট মাথা ঘামাতে হয়। সবসময় নিজের নিজের তিনটি গুটিকে কোনাকুনি , পাশাপাশি বা লম্বালম্বিভাবে কাল্পনিক সরলরেখা বরাবর তিনটি ঘরে বসানোর লক্ষ্যে চাল দিতে হয়। কিন্তু কখনোই একে অন্যের গুটি বা ঘর টপকে চাল দেওয়া যায় না। অনেক সময় দেখা যায় ভুল চালের জন্য বিপক্ষের গুটির মাঝে এক বা একাধিক গুটি ঘরবন্দী হয়ে পড়ে।সেক্ষেত্রে বিপক্ষ গুটি না সরানো পর্যন্ত ঘর থেকে ওইসব গুটি বের করে চাল দেওয়ার সুযোগ মেলে না। আর সেই সুযোগে বিপক্ষ অনায়াসেই এক সারিতে তার তিনটি গুটিই সাজিয়ে ফেলে। যে প্রথম এক সারিতে নিজের গুটি বসিয়ে দিতে পারে সেই খোলোয়াড প্রতিপক্ষকে এক চিক দেয়। খেলা শেষে চিকের সংখ্যা অনুযায়ী জয়ী নির্ধারিত হয়।
ন'গুটির খেলায় ভিন্ন ভিন্ন রঙ কিম্বা আকৃতির ৯ টি করে মোট ১৮ টি গুটির প্রয়োজন।এক্ষেত্রে কোনাকুনি রেখা টেনে সাতটি বিভেদ রেখা যুক্ত করে মোট ১৯ টি ঘর বিশিষ্ট ছক কাটা হয়। মাঝের ঘরটি বাদ দিয়ে দুইদিকের ত্রিভুজাকার ঘরে নিজ নিজ ৯ টি করে গুটি বসিয়ে মুখোমুখি বসে খেলা শুরু হয়। টসের মাধ্যমেই কে আগে দান চালবে তা স্থির করে নেওয়া হয়। তিনগুটি খেলার ক্ষেত্রে আগে দান চালার সুযোগ সৌভাগ্যের বিবেচিত হলেও এক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ প্রথমেই টসজয়ীকে গুটি সরাতে হয় দুই ত্রিভুজাকার ঘরের সংযোগস্থলের মধ্যবর্তী ঘরে। আর সেই সুযোগেই পিছনের ঘর খালি পেয়ে গুটিটি কেটে দেয় বিপক্ষ।অর্থাৎ ছক থেকে গুটিটি বিপক্ষের হাতের মুঠোয় চলে যায়।
নিয়ম হল , দান চালার সময় বিপক্ষের গুটির পিছনের ঘর খালি পেলেই সেই ঘরে গুটি বসিয়ে বিপক্ষের গুটিটি কেটে নেওয়ার সুযোগ পায় দান চালকারী।তারপর দান পায় বিপক্ষ।কোথাও কোথাও গুটি কাটার জন্য একটি অতিরিক্ত দান পাওয়ার নিয়মও চালু রয়েছে।কোথাও আবার সুযোগ থাকলে অর্থাৎ বিপক্ষের একাধিক গুটির পিছনে গুটি বসানোর ফাঁক থাকলে একটি গুটি দিয়েই অর্থাৎ একটি চালেই একাধিক গুটি কাটারও নিয়ম রয়েছে। সেক্ষেত্রেও অবশ্য একটির বেশি অতিরিক্ত দান বরাদ্দ নেই। ওইভাবে ধারাবাহিক কাটাকাটিতে যার সমস্ত গুটি আগে কাটা পড়ে সেই খেলোয়াড় ' চিক ' খায়।একই প্রক্রিয়ায় খেলা হয় ১৬ গুটিরও । ওই খেলায় দুটি ভিন্ন রঙের ৮ টি করে গুটি প্রয়োজন। তবে ছকটি সম্পূর্ণ আলাদা। এক্ষেত্রে ৮ টি রেখা দ্বারা বিভক্ত একটি বর্গাকার ঘরের সঙ্গে দুটি রেখা দ্বারা বিভক্ত দুটি ত্রিভুজাকার ঘর দু'দিকে যুক্ত থাকে। কিন্তু খেলার নিয়ম কানুন অধিকাংশ জায়গায় প্রায় এক। অধিকতর বেশি গুটির খেলা বলে ওই খেলার দান শেষ হতেও বেশি সময় লাগে।বড়োদের কাছেও খেলাটি আর্কষনীয় ছিল।চর্চার অভাবে সেই খেলাটিও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
No comments:
Post a Comment